নিরাপদ সড়ক: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

সড়ক দুর্ঘটনায় মুহুর্তে কর্মক্ষম জনসম্পদ বা প্রাণগুলো হারিয়ে সংখ্যায় পরিণত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (যিড়) প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৫ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২১ হাজার ৩১৬ জন প্রাণ হারিয়েছে। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৪ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। ১৫০ জনের বেশি মানুষ আহত হচ্ছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে দেখা গেছে, বিগত ২০১৫ সালে ৬ হাজার ৫৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জন নিহত, ২১ হাজার ৮৫৫ জন আহত হয়েছিল।

২০১৬ সালে ৪ হাজার ৩১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৫ জন নিহত, ১৫ হাজার ৯১৪ জন আহত হয়েছিল। ২০১৭ সালে ৪ হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৩৯৭জন নিহত, ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত হয়েছিল।

২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জন নিহত, ১৫ হাজার ৪৬৬ জন আহত হয়েছিল। ২০১৯ সালে ৫ হাজার ৫১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮৫৫ জন নিহত, ১৩ হাজার ৩৩০ জন আহত হয়েছিল।

২০২০ সালে করোনা সংক্রমণে বছরব্যাপী লকডাউনে পরিবহন বন্ধ থাকা অবস্থায় ৪৮৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৬ জন নিহত ও ৮ হাজার ৬০০ জন আহত হয়েছে। বিগত ৬ বছরে ৩১ হাজার ৭৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ হাজার ৮৫৬ জন নিহত, ৯১ হাজার ৩৫৮ জন আহত হয়েছে।

সংখ্যা যাই হোক, সড়কে মৃত্যুর মিছিল যে থামানো যাচ্ছে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতিসংঘ ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সালকে সড়ক নিরাপত্তা দশক ঘোষণা করে সদস্য দেশগুলোর সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করে। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অঙ্গীকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে।

এসব সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণকালে দেখা যায়, বর্তমান সরকারের সময়ে সড়ক-মহাসড়কে উন্নয়নের ফলে যানবাহণের গতি বেড়েছে, এই সময়ে বেপরোয়া গতিতে গাড়ী চালানো এবং বিপদজনক অভারটেকিং বেড়ে যাওয়ার কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে।

এ সময়ের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও প্রাণহানী অর্ধেকে নামিয়ে আনার বিষয়ে সদস্য দেশগুলো একমতও হয়েছে। এটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) তে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে। সড়ক নিরাপত্তা দশককে কেন্দ্র করে পৃথিবীর দেশে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে নানামূখী উদ্যোগ গ্রহন ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে ইতোমধ্যে বহুদেশে সড়ক নিরাপত্তায় দৃশ্যমান অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

কিন্তু বাংলাদেশ এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যথাযথ কোন পরিকল্পনা তৈরী করেনি। সড়ক নিরাপত্তায় যুক্ত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে নেওয়া পরিকল্পনা গুলো ছিল গতানুগতিক। এর মাধ্যমে কী অর্জিত হয়েছে আর কী অর্জিত হয়নি বা কী অর্জন করা প্রয়োজন তার সঠিক কোন ব্যাখ্যা নেই।

সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠান (এআরআই) এর গবেষণায় দেখা গেছে ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বেপরোয়া গতি। কিন্তু গতি নিয়ন্ত্রণ, মহাসড়কে ছোট যানবাহন বন্ধ ও বেপরোয়া যানবাহন চলাচল বন্ধে সাফল্য নেই। এখনো দেশের সড়ক মহাসড়কে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে ১০ লক্ষ নছিমন-করিমন-ইজিবাইক।

অবাধে আমদানী হচ্ছে অটোরিক্সা, ব্যাটারি চালিত রিক্সা, ইজিবাইক। দেশব্যাপী ৫ লক্ষ ফিটনেসবিহীন বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, হিউম্যান হলার অবাধে চলছে। নিবন্ধনবিহীন ৮ লক্ষ অটোরিক্সা ও মোটরসাইকেল চলাচল করছে সড়ক-মহাসড়কে। এসব যানবাহন সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান উৎস।

দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানীর প্রায় ৪৭ শতাংশ পথচারী। আমাদের সড়ক-মহাড়কে স্বল্প খরচে ফুটপাত, জেব্রা ক্রসিং, আন্ডারপাস, ওভারপাস নির্মাণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে প্রাণহানী অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। ফুটপাত দখল মুক্ত করে পথচারীর যাথাযাত নিশ্চিত করা গেলে এই বিশাল অর্জন সম্ভব।

উন্নত বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যেসব পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সেগুলো খুবই সুনির্দিষ্ট হয়। কিন্তু বাংলাদেশে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন দায়সারা গোছের। কত বছরে কি পরিমান দুর্ঘটনা ও প্রাণহানী কমানো হবে। কিভাবে তা অর্জিত হবে, কারা তা সফল করবে। এটা স্পষ্ট করা দরকার।

পরিকল্পনা করে রেখে দিলে বা প্রতিদিন নতুন নতুন কথার ফুলঝুড়ি দিলে বা রাস্তায় রাস্তায় লিফলেট দিলে দুর্ঘটনা কমে যাবে এটা আশা করা ঠিক নয়। আইন প্রয়োগের দূর্বলতা। সড়ক মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খলা। চালক-মালিকদের বেপরোয়া মনোভাব এই সেক্টরকে দিন দিন অনিরাপদ করে তুলছে। সরকার জনবান্ধন যে কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে তারা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে সড়ক নিরাপত্তা আজ মারাত্বক হুমকির মুখে।

দেশের বিভিন্নস্থরের জনসাধারণের মাঝে সড়ক নিরাপত্তা ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে প্রতিবছর নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করা হচ্ছে। এই জন্য আমরা সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। দেশে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ সড়কে প্রাণ দিচ্ছে, আহত হচ্ছে, পঙ্গু হচ্ছে। তাদের সুরক্ষা দিতে এই দিবসটি অন্যান্য জাতীয় দিবসের ন্যায় গতানুগতিকভাবে একদিন পালন না করে, নিরাপদ সড়ক দিবসকে কেন্দ্র করে মাসব্যাপী স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, নিরাপদ সড়ক ব্যবহার সংক্রান্ত আলোচনা সভা, মসজিদ-মন্দির-গীর্জায় সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহতা সংক্রান্ত আলোচনাসহ দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে সমাজের সকল স্তরে নিরাপদ সড়কের বার্তা পৌঁছে দেওয়া গেলে দিবসটি উদযাপনের সুফল পাওয়া যাবে।

জনগণের বহুল প্রত্যাশিত সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাস্তবায়নের পরেও সড়কে কাঙ্খিত উন্নয়ন লক্ষ্য করা যায়নি। বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, ভাড়া নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানী ঠিক আগের মতোই বিদ্যমান। ফলে যাত্রী ভোগান্তি, যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনা দিনদিন বেড়েই চলেছে। সড়কে এহেন পরিস্থিতি বহাল রেখে নিরাপদ সড়ক দিবস পালন নেহায়াত বেমানান। একই সাথে বর্তমান সরকারের নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার নির্বাচনী অঙ্গীকার জরুরী ভিত্তিতে বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি।

পাশাপাশি সড়ক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচীর বাজেট বাড়ানো, গবেষণা, সভা-সেমিনার, প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে গণসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি সড়কে চাঁদাবাজী বন্ধ করা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ ও ট্রাফিক বিভাগের অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করা। দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা ১২ লক্ষ ড্রাইভিং লাইসেন্স দ্রুত চালকের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে দুর্নীতির লাঘাম টেনে ধরে এসব সংস্থাসমূহের সচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরী।

সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে জাতিসংঘের অনুস্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সড়কে পথচারীর মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণ করা গেলে এই অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মনে করি।

লেখক:
মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী
মহাসচিব
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি

Leave a Comment

error: Content is protected !!