স্ট্রোক থেকে সতর্ক থাকুন

আজ বিশ্ব স্ট্র্র্রোক দিবস। এ বছরের থিম ‘জানুন স্ট্রোকের লক্ষণ, মিনিটেই বাঁচিয়ে দিন বহু জীবন’। স্ট্রোক থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। নিজেকে আরও সক্রিয় ও সুস্থ রাখা এবং আরও বেশি করে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অঙ্গীকার করুন এই দিনে।

আমাদের দেশে প্রচলিত একটি ধারণা আছে, স্ট্রোক একটি হৃৎপিন্ডের রোগ। বাস্তবে তা সত্য নয়। স্ট্রোক মস্তিষ্কের রোগ। মস্তিষ্কের রক্তবাহী নালির দুর্ঘটনাকেই স্ট্রোক বলা যায়। এ দুর্ঘটনায় রক্তনালি বন্ধও হতে পারে, আবার ফেটেও যেতে পারে। এর ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়। স্ট্রোক সম্পূর্ণই মস্তিষ্কের রক্তনালির জটিলতাজনিত রোগ। স্ট্রোকে আক্রান্তদের মধ্যে ৪০ ভাগ মারা যান, আর ৩০ ভাগ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তারা বেঁচে থেকেও দুর্বিষহ জীবনযাপন করেন।

স্ট্রোকে আক্রান্তের হার দিন দিন বেড়ে চলছে। অনেক ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাবে এ রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের দেশে এখন ১৫ থেকে ২০ লাখ স্ট্রোকের রোগী রয়েছে। প্রতি হাজারে গড়ে তিন থেকে পাঁচজন স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন। সাধারণত পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্তের হার বেশি লক্ষ্য করা গেলেও যে কোনো বয়সেই তা হতে পারে। ৫০ বছর বয়সের পর প্রতি ১০ বছরে স্ট্র্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়।

আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি। মহিলাদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্তের হার কম। ফাস্টফুডে আসক্তদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। শিশু ও তরুণদের অনেকে খাদ্যাভ্যাসের কারণে স্ট্রোক ঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন।

স্ট্র্রোক কেন হয়? অনেক কারণেই স্ট্রোক হয়। যেমন-

  1. ক. অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপ স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় কারণ।
  2. খ. ধূমপান, তামাক পাতা, জর্দা, মাদক সেবন।
  3. গ. অতিরিক্ত টেনশন, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, রক্তে বেশিমাত্রায় চর্বি।
  4. ঘ. অলস জীবনযাপন করা, স্থুলতা বা অতিরিক্ত মোটা হওয়া, অতিরিক্ত মাত্রায় কোমল পানীয় গ্রহণ।
  5. ঙ. কিছু কিছু ওষুধ যা রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা কমিয়ে দেয় যেমন অ্যাসপিরিন, ক্লপিডগ্রেল প্রভৃতি ব্যবহারে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
  6. চ. ঘুমের সময় নাক ডাকা, ঘুমের সময় শ্বাসকষ্টজনিত উপসর্গ।
  7. ছ. যে কোনো ধরনের প্রদাহ অথবা ইনফেকশন ও জন্মগতভাবে ব্রেনে কিংবা মস্তিষ্কে সরু রক্তনালি থাকা।
  8. জ. অনেক সময় বংশানুক্রমে কিংবা আগের স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ও দূরবর্তী রক্তনালি বন্ধ হওয়ার কারণেও স্ট্রোক হতে পারে।

স্ট্রোকের লক্ষণসমূহ-

  1. ক. শরীরের কোথাও বা একাংশ অবশ ভাব লাগা কিংবা দুর্বলবোধ করা।
  2. খ. কথা বলার সমস্যা অর্থাৎ কিছুক্ষণের জন্য কথা জড়িয়ে যাওয়া, অস্পষ্ট হওয়া ও একেবারে কথা বলতে বা বুঝতে না পারা।
  3. গ. এক চোখ বা দুই চোখেই ক্ষণস্থায়ী ঝাপসা দেখা বা একেবারেই না দেখা।
  4. ঘ. মাথা ঝিমঝিম করা, মাথা ঘোরা, দৃষ্টি ঘোলা লাগা, হঠাৎ করে কিছুক্ষণের জন্য হতবিহ্‌বল হয়ে পড়া, বমি বমি বোধ অথবা বমি করা।
  5. ঙ. পা দুটিতে দুর্বল বোধ করা।
  6. চ. স্ট্রোকের মারাত্মক উপসর্গ হচ্ছে অজ্ঞান হওয়া, খিঁচুনি, তীব্র মাথাব্যথা ও বমি।

স্ট্রোক হলে কী চিকিৎসা দিতে হবে-

  1. ক. স্ট্রোক হয়ে গেলে চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল। রোগীর উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। যদি খেতে না পারেন তবে নাকে নল দিয়ে খাবার ব্যবস্থা করা হয়। প্রস্রাব ও পায়খানা যাতে নিয়মিত হয় সে ব্যবস্থা নিতে হবে, প্রয়োজনে প্রস্রাবের রাস্তায় ক্যাথেটার দিতে হবে। চোখ, মুখ ও ত্বকের যত্ন নিতে হবে। বেডশোর প্রতিরোধ করার জন্য নিয়মিত পাশ ফেরাতে হবে।
  2. খ. উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
  3. গ. পাশাপাশি অনেক স্ট্রোক রোগীর হার্টের রোগ থাকে। এসব ক্ষেত্রে কার্ডিওলজিস্টের পরামর্শের প্রয়োজন হয়।
  4. ঘ. অন্যান্য চিকিৎসা স্ট্রোকের ধরন অনুযায়ী করা হয়। যেমন-ইশকেমিক স্ট্রোকের বেলায় এসপিরিন, ক্লোপিডগ্রিল জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। রক্তক্ষরণের কারণে স্ট্রোক হলে অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে।
  5. ঙ. সব হাসপাতালেই থাকা উচিত একটি স্ট্রোক কেয়ার ইউনিট, যেখানে ডাক্তার, নার্স, থেরাপিস্ট এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে স্ট্রোক রোগীর চিকিৎসা দেবেন।
  6. চ. একজন স্ট্রোক রোগীর প্রয়োজন হয় নিউরোলজিস্ট এবং নিউরোসার্জনের। অনেক স্ট্রোক রোগীর অপারেশন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
  7. ছ. অনেক রোগীর শ্বাসকষ্ট, বেডশোর প্রভৃতি সমস্যা দেখা দেয়। সুতরাং রেসপিরেটরি মেডিসিন স্পেশালিস্ট, প্লাস্টিক সার্জনসহ সবার সহযোগিতার প্রয়োজন হতে পারে।
  8. জ. রোগীর অঙ্গ সঞ্চালন করে জড়তা কাটিয়ে তুলতে রিহ্যাবিলিটেশন বা পুনর্বাসনের জন্য ফিজিওথেরাপিস্ট প্রয়োজন হয়।
  9. ঝ. রোগী কথা বলতে না পারলে প্রয়োজন স্পিচ থেরাপিস্টের। ঞ. স্ট্রোক কেয়ার ইউনিট, সমন্বিত স্ট্রোক কেয়ার টিমের ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসায় আসবে সুফল, রোগী ও রোগীর স্বজন হবেন চিন্তামুক্ত, রোগী লাভ করবে আরোগ্য।

কীভাবে আমরা এই ভয়াল দানবকে রুখে দাঁড়াতে পারি? যেভাবে প্রতিরোধ সম্ভব : ‘স্ট্রোক প্রতিরোধযোগ্য রোগ’। স্ট্রোক ব্রেন বা মস্তিষ্কের কঠিন রোগ। ব্রেনের কোষগুলো একবার নষ্ট হলে পুনরায় পুরোপুরিভাবে কার্যকরী হয় না অথবা জন্মায় না। ‘চিকিৎসার চেয়ে এই রোগ প্রতিরোধই উত্তম’।

এই রোগ মস্তিষ্কের রক্তনালি থেকে উদ্ভূত হয়। স্ট্রোক হলে অনেক সময় রোগী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন। এর জন্য সুনির্দিষ্ট ও জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। গ্রামাঞ্চলে কিংবা শহরে যে কোনো হাসপাতালে এ রোগের চিকিৎসা সম্ভব। এ জন্য

  1. ক. নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
  2. খ. ধূমপান, মদ্যপান, মাদকদ্রব্য, তামাক পাতা ও জর্দা খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
  3. গ. হৃৎপিন্ডের রোগের চিকিৎসা, রক্তের চর্বি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
  4. ঘ. চর্বি ও শর্করাযুক্ত খাবার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ফাস্টফুড, বাদাম, সন্দেশ-রসগোল্লা, দুধ-ঘি-পোলাও-বিরানি, পাঙ্গাশ-চিংড়ি-কাঁকড়া, গরু বা খাসির মাংস, নারকেল বা নারকেলযুক্ত খাবার ইত্যাদি কম খাওয়া উচিত।
  5. ঙ. শাকসবজি, অল্প ভাত, পাঙ্গাশ-চিংড়ি-কাঁকড়া বাদে যে কোনো মাছ, বাচ্চা মুরগি ও ডিম খেলে কোনো ক্ষতি হয় না।
  6. চ. নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। বাড়তি ওজন কমাতে হবে।

লেখক: প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক।

Leave a Comment

error: Content is protected !!