আমার পোশাক কেমন হবে -সাদেক আহমেদ

আমার পোশাক কেমন হবে -সাদেক আহমেদ। পৃথিবীতে মানবের আগমন ও তার যাপিত জীবনের নানা সময়ে নানা প্রয়োজনে নানা কিছুর ব্যবস্থা তাকে করতে হয়েছে। খিদের তাড়নায় তাকে খাদ্যের অনুসন্ধানে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে বনবাদাড়ে,পাহাড়-পর্বতে ও জলে-স্থলে।

নিজের দেহের সৌন্দর্য ও লজ্জাস্থান ঢেকে রাখার প্রয়োজনে সে কখনো গাছের পাতা, গুল্মলতা ও গাছের ছাল ব্যবহার করেছে। কিন্তু মানুষ যখন সুতা বানাতে শিখলো তখন সে বাহারি রঙ ও ডিজাইনের পরিধেয় বস্ত্র বানাতে শিখে। কিন্তু তখনও তারা জানতো না কোন পোশাক পুরুষের জন্য আর কোন পোশাক নারীর জন্য।

ইসলাম প্রচারের মাধ্যমে আল্লাহর রাসূল হযরত মোহাম্মদ (সা.) কোরআনের আলোকে শিখিয়ে দিলেন নারীর জন্য কেমন পোশাক হবে আর পুরুষের জন্য কেমন পোশাক হবে। আমাদের দেহের বাহ্যিক দিক সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলে আরও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে আমাদের পোশাক। তাই বলে যেমন খুশি তেমন সাজ এই মানসিকতায় নারী পুরুষ বিবেচনা না করে পোশাক পরিধানের অনুমতি ইসলাম দেয় না।

বিখ্যাত সাহাবী হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, যেসব পুরুষ মহিলাদের মতো ও মহিলারা পুরুষের মতো পোশাক পড়ে রসুল (সা.) তাদের অভিশাপ দিয়েছেন। (আবু দাউদ, আবু সুনান) মহিলাদের জন্য পুরুষের পোশাক, পুরুষের জন্য মহিলাদের মতো পোশাক কখনো ইসলাম সমর্থন করে না।

সুরা আরাফ এর ২৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে, হে আদমসন্তানগণ! তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকার ও বেশভ‚ষার জন্য আমি তোমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ দিয়েছি এবং তাকওয়ার পোশাকই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। পোশাক পরিধান, লজ্জাস্থান আবৃত করা ও সাজসজ্জার আসল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন ও খোদাভীতি। পোশাকে যেন কখনো অহংকার বা গর্বের ভঙ্গি না থাকে। অপব্যয় না থাকে। মহিলাদের জন্য পুরুষের পোশাক, পুরুষের জন্য মহিলাদের মতো পোশাক না হওয়াই উচিৎ।

সুরা নাহল এর ৮১ নং আয়াতে আল্লাহ আরও বলেন, তিনি তোমাদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন পরিধেয় বস্ত্রের, যা তোমাদেরকে তাপ থেকে রক্ষা করে এবং বিপদে তোমাদেরকে রক্ষা করে। হজরত হাসান (রা.) বলতেন, আল্লাহ সৌন্দর্য পছন্দ করতেন তাই আমি প্রতিপালকের সামনে সুন্দর পোশাক পরে হাজির হই।

রাসুল (সা.) বলেন, পুরুষের নাভির উপর থেকে হাঁটু পর্যন্ত এবং মহিলাদের মুখমণ্ডল, হাতের তালু ও পা দুটি ছাড়া (টাখনুর নিচে) পুরো শরীর ঢাকার নামই হলো লজ্জাস্থান ঢাকার বিধান। এটি ছাড়া সালাতই হয় না। রসুল (সা.) আরও বলেন, তোমাদের পোশাকের মধ্যে সাদা পোশাক পরিধান কর। কেননা পোশাকের মধ্যে তা-ই উত্তম পোশাক। আর এতে তোমাদের মৃতদের কাফন দাও। (আবু দাউদ, তিরমিজি)

কোরআনে মেয়েদের পোশাকের ক্ষেত্রেও আয়াত নাজিল হয়েছে। বলা হয়েছে, হে নবী! আপনি আপনার পত্নীগণ, কন্যাগণ ও মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের বুকের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে, ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। (সুরা আহজাব, আয়াত ৫৯)

ইমাম ইবনে জারির তাবারি বলেন, ভদ্রঘরের মেয়েরা যেন নিজেদের পোশাক-আশাকে বাদিদের মতো সেজেগুজে ঘর থেকে বের না হয়। তাদের চেহারা ও কেশদাম যেন খোলা না থাকে। বরং তাদের নিজেদের ওপর চাদরের একটি অংশ লটকে দেওয়া উচিত। তাতে কোনো ফাসেক তাদের উত্যক্ত করার দুঃসাহস করবে না। (জামেউল বায়ান)

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ কেয়ামতের দিন ওই ব্যক্তির দিকে রহমতের দৃষ্টি দেবেন না, যে ব্যক্তি অহংকারবশত ইজার (পরিধেয়) টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে পরে (বুখারি)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, যেসব পুরুষ মহিলাদের মতো ও মহিলারা পুরুষের মতো পোশাক পরে রসুল তাদের অভিশাপ দিয়েছেন। (আবু দাউদ, আবু সুনান) পোশাক বা সাজসজ্জার ক্ষেত্রে আল্লাহ নারীদের জন্য স্বর্ণ ও রেশম হালাল করেছেন কিন্তু পুরুষের জন্য তা করেছেন হারাম, এবং নিষেধ করেছেন নারীরা যেন তা পরিধান করে নিজেকে প্রদর্শন বা অন্যকে আকৃষ্ট না করে।

আল্লাহ বলে দিয়েছেন তোমরা যত খুশি সাজো কিন্তু স্বামী, পিতা, ভাই ছাড়া অন্য কোনো মাহরাম পুরুষের সামনে তা প্রদর্শন করো না। আমাদের মনে রাখতে হবে, পোশাক মানবদেহকে সর্বক্ষণ আবৃত করে রাখে এবং তার মানসিক অনুভ‚তিগুলো নিয়ন্ত্রিত ও পরিশীলিত করে। এজন্য রসুল (সা.) বারবার বিনয় ও সরলতা প্রকাশ পায় সে ধরনের পোশাক পরিধানের নির্দেশ দিয়েছেন। আজকাল অনেকে হাঁটু খোলা প্যান্ট পরে নিজেকে সুন্দর ও স্মার্ট ভাবেন। আমাদের মনে রাখতে হবে রসুল (সা.) হাঁটু অনাবৃত রাখতে যেভাবে নিষেধ করেছেন তেমনি টাখনুও আবৃত করতে নিষেধ করেছেন।

বিশ্বায়নের ধারণার ফলে সমগ্র বিশ্বে পণ্য ও সেবার অবাধ প্রবাহ এবং বিনিয়োগ সংগঠিত হচ্ছে। শিক্ষা, গবেষণা, কর্মসংস্থান, উৎপাদিত পণ্য, সংস্কৃতি এখন আর কোন নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। পৃথিবীর নানা প্রান্তে এখন বাঙালির বিচরণ। জীবনের প্রয়োজনে মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাচ্ছে। সেদেশের কৃষ্টি-কালচার মেনে নিয়ে সেখানে বসবাস করে নিজ উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করে। তবে নিজেকে যখন আমি একজন মুসলমান মনে করি তখন আমি অবশই ইসলাম ও কোরআন হাদীসের শিক্ষা যা আমার জন্য অবশ্যই পালনীয় তা পালনে যদি সেখানের রাষ্ট্রীয় কোন বাধা বিপত্তি না থাকে তবে আমার উচিৎ নিজের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে যথাযথভাবে পালন করা। এই মানুষগুলো যখন নিজদেশে প্রত্যাবর্তন করে তখন সে আবারও সেই বাঙালি যেমনটা আগে ছিলো তার পিতা, মাতা, দাদা, দাদী ও অন্যরা।

জীবন বোধের এমন ধারনাই প্রত্যাশিত। তবে বিপত্তি ঘটে তখনই যখন দেখা যায় নিজ ভূমিতে এসেও তাদের কেউ কেউ সেই বিদেশী কৃষ্টি-কালচারের চর্চা বজায় রাখতে চায়। নারী পুরুষ নির্বিশেষে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর গেঞ্জি পড়ে জন সমক্ষে ঘুরে বেড়ায়। এর প্রভাব পড়ে এদেশের যুবসমাজের উপর পড়তে বাধ্য । কারণ তারুণ্যের সময়ে সকলেরই নতুনত্বের প্রতি আকর্ষণ একটু বেশি থাকে। না দেখা জিনিষ দেখার মন চায়, আর একটু ভালো করে দেখে নেই। নিজে না করা কাজ অন্য কেউ করতে দেখলে মন বলে করে দেখি কেমন মজা লাগে।

এভাবেই ক্রমান্বয়ে আমরা অনেক দূরে সরে যাই নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার, সংস্কৃতি ও জীবন বোধ থেকে। বিষয়টি আজকের যুবসমাজের মধ্যে মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে। এসকল সমস্যার অধিকাংশই দেখা যায় ভিনদেশী এই সকল কৃষ্টি-কালচার, সংস্কৃতি ও জীবনবোধের অন্ধ অনুকরণের ফলে। বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু আছে। এখানে বসবাস করে নানা ধর্মে বিশ্বাসী মানুষজন। রাষ্ট্রও প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীকে তার ধর্মীও সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ দিয়েছে কোন প্রকার বৈষম্য না করেই। তাই এদেশে চালু আছে মুসলিম পারিবারিক আইন ও হিন্দু পারিবারিক আইন ও নানা জাতিগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় বিধি বিধান।

তাই যদি বলি আমি একজন মুসলমান আমার সংস্কৃতি হবে মুসলিম সংস্কৃতি যা কোরআন ও হাদিস দ্বারা স্বীকৃত। আমি তা মেনে চলবো তবে রাষ্ট্র কখনো কোন প্রকার বাধা প্রদান করবে না। উপরন্তু রাষ্ট্র আমার ধর্মীয় আচার আচরণ পালনে সর্বদা সকল প্রকার সহযোগিতা করবে। ইসলাম এমন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম যেখানে একজন মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের নানা স্থরে প্রয়োজনীয় সকল সমস্যার সুস্পষ্ট সমাধান রয়েছে। একজন মুসলমানের আচার ব্যবহার কেমন হবে, তার পোশাক কেমন হবে, তার পারিবারিক জীবন কেমন হবে, তার পেশাগত জীবন কেমন হবে এসবের সকল বিষয়ে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বর্ণনা রয়েছে।

আমরা আমাদের সন্তানদের সে বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে উদাসীন। তাই যখন দেখি আমাদের সন্তান ভিনদেশী সংস্কৃতি চর্চায় অভ্যস্ত তখন হতাশা প্রকাশ করে দায়টা তার উপরেই চাপিয়ে দেই। আমরা যদি আমাদের সন্তানদের ইসলামী কৃষ্টি কালচার শিক্ষা না দেই তবে তার কাছ থেকে মুসলমানের আচার ব্যবহারের প্রত্যাশা করাটা যে নিতান্তই অমূলক। আর তা বুঝবার জন্য ইসলামী গবেষক হবার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে কোরআন-হাদিসের আলোকে পোশাক পরিধান ও জীবন পরিচালনার তৌফিক দান করুন। আমিন

Leave a Comment

error: Content is protected !!