তেরো ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৯টিতেই নৌকার ভরাডুবির সম্ভাবনা

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ১৩ ইউনিয়নের ৯টিতেই সরকারি দলের ভরাডুবির সম্ভাবনা রয়েছে। দলীয় মনোনয়নে আর্থিক লেনদেন, প্রার্থী বাছাইয়ে স্বজনপ্রীতি, কোন্দল, কম ব্যক্তি ইমেজসম্পন্ন ও দুর্নীতিবাজ প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়াসহ নানা কারণে ভরাডুবি হতে পারে বলে ভোটাররা জানিয়েছেন। গত তিনদিনে ফুলবাড়িয়ার ১৩ ইউনিয়নের বেশ কিছু ভোটারের সঙ্গে কথা বলে ও সরেজমিন খোঁজ-খবর নিয়ে মিলেছে এসব তথ্য।

আগামী ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বিতীয় ধাপে ফুলবাড়িয়া উপজেলার ১৩ ইউনিয়নের নির্বাচন। এবারের নির্বাচনে ১৩ ইউনিয়নে সরকারি দলের ১৩ জনসহ সর্বমোট ৭৫ জন চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

১নং নাওগাও ইউনিয়নের ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী আব্দুর রাজ্জাক তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ। শুধুমাত্র অর্থের বিনিময়ে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি। এই ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সাবেক চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেন মোজা। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, তিনি নৌকার মনোনয়ন পেলে বিজয় সুনিশ্চিত ছিল।

২নং পুটিজানায় বর্তমান চেয়ারম্যান ময়েজ উদ্দিন তরফদার পেয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ।

এই ইউনিয়নেও ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী (বিএনপি) ছাইদুর রহমান রয়েল এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আব্দুল আলীম আব্দুল্লাহ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ ইউনিয়নে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ত্যাগী নেতা আরিফ রব্বানী নৌকার মনোনয়ন চেয়েছিলন।

এলাকার একাধিক ভোটারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি মনোনয়ন পেলে বিজয় ছিনিয়ে আনা অনেকটাই সহজ ছিল। এ ইউনিয়নে ত্রিমুখী লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

৩নং কুশমাইলে সরকারি দলের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান শামছুল হক। তার বিরুদ্ধে রয়েছে চরম অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ। অত্র ইউনিয়নে গত ৫ বছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করেননি তিনি। এই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল বাতিন পুলু। এলাকায় তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। তিনি মনোনয়ন পেলে বিপুল ভোটে জয়ী হতেন। এলাকার অন্তত ১০ জন ভোটার জানিয়েছেন, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে নৌকার প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হতে পারে। এই ইউনিয়নে আবদুল বাতিন পুলুর বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ।

৪নং বালিয়ানে চেয়ারম্যান পদে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পেয়েছেন হাজেরা খাতুন। এ ইউনিয়নে জেলা আওয়ামী লীগের উপ প্রচার সম্পাদক ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মফিজ উদ্দিন মণ্ডল ও বর্তমান জনপ্রিয় চেয়ারম্যান শামীমা সুলতানা হচ্ছেন আলোচিত ও যোগ্য প্রার্থী।

দু’জনের যেকোনো একজনকে মনোনয়ন দিলে নৌকার জেতার সম্ভাবনা ছিল শতভাগ। হাজেরা খাতুনের ব্যক্তি ইমেজ না থাকা, স্বল্প পরিচিতিসহ দলীয় কোন্দলের কারণে ভয়াবহ ভরাডুবির সম্ভবনার কথা জানিয়েছেন ভোটাররা। এ ইউনিয়নে স্বতস্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান পলাশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন। এই ইউনিয়নেও ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভবনা রয়েছে।

৫নং দেওখোলায় আওয়ামী লীগের নৌকা পেয়েছেন সাবেক চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম বাবলু। তার বিরুদ্ধেও ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার ব্যাপক অভিযোগ আছে। এ ইউনিয়নে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জয়নাল আবেদীন ও বর্তমান চেয়ারম্যান আতাউর রহমান হাদী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন। এখানেও রয়েছে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা।

ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নে মোট প্রার্থী ৫ জন। নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের রুহুল আমিন, বর্তমান চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন বাদল ও সিরাজুল হক স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এই ইউনিয়নে। মূলত এখানেও লড়াই হবে ত্রিমুখী। জয়নাল আবেদিন বাদলের বিরুদ্ধে ব্যাপক টাকা-পয়সা বিতরণের অভিযোগ আছে। জনশ্রুতি আছে, অর্থের বিনিময়ে ভোটারদের প্রভাবিত করার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এই ইউনিয়নে নৌকা পরাজিত হলে সেটা হবে অর্থের কাছে।

৭নং বাক্তায় নৌকা প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন নাজমুল হক সোহেল, বর্তমান চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা ফজলুল হক মাখন, স্বতন্ত্র প্রার্থী আতিকুর রহমান খান ও জাহাঙ্গীর আলম আকন্দ। দীর্ঘ দুই যুগের ত্যাগী নেতা আব্দুস ছালাম বিএসসি এ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু টাকার কাছে হেরে যান তিনি। প্রায় অর্ধ কোটি টাকার বিনিময়ে নাজমুল হক সোহেল নৌকার টিকিট বাগিয়ে নেন। এই ইউনিয়নে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। ভোট সুষ্ঠু হলে নৌকার অবস্থান ৪র্থ হতে পারে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

৮নং রাঙ্গামাটিয়ায় নৌকা প্রতীকে কামরুজ্জামান দুলাল, ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম চৌধুরী মুক্তা, সাবেক চেয়ারম্যান শাজাহান সিরাজ সাজুসহ ৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে নৌকার প্রার্থী তৃতীয় অবস্থানে থাকতে পারে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এখানেও প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল সিদ্ধান্ত ও মনোনয়ন বাণিজ্যের বলি হয়েছেন রফিকুল ইসলাম চৌধুরী মুক্তা।

৯নং এনায়েতপুর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে মোট প্রার্থী ৮ জন। এখানে নৌকার বুলবুল হোসেন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী কবীর হোসেন তালুকদার এর মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে। এই ইউনিয়নে নৌকা বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

১০নং কালাদহ ইউনিয়নে সরকারি দলের প্রার্থী হয়েছেন ইমান আলী মাস্টার, স্বতন্ত্র নজরুল ইসলাম ও নুরুল ইসলাম মাস্টারসহ মোট ৭ জন। এখানেও স্বজনপ্রীতি ও মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে নৌকার ভরাডুবি হতে পারে। কালাদহে নুরুল ইসলাম মাস্টারকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দিলে বিজয় সহজ হতো।

রাধাকানাই ইউনিয়নে মোট প্রার্থী ৫ জন। নৌকা প্রতীকে বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া তারফদার শিমুল, বিদ্রোহী প্রার্থী সারোয়ার আলম রুকন তরফদার ও বিএনপি সাইফুল ইসলাম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এখানে নৌকা বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আছিম পাটুলীতে চেয়ারম্যান পদে মোট প্রার্থী ৩ জন। নৌকা বর্তমান চেয়ারম্যান এস এম সাইফুজ্জামান, ইউনিয়ন যুবদলের সহ সভাপতি ইমরুল কায়েস ও জহিরুল ইসলাম। এখানে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী চশমা প্রতীক ইমরুল কায়েসের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে।

সর্বশেষ ১৩নং ভবানীপুর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে মোট প্রার্থী ৮ জন। নৌকার জবান আলী সরকার, বিদ্রোহী সাবেক জেলা ছাত্রলীগের সদস্য আজাহারুল ইসলাম ও আওয়ামী লীগ নেতা ডা. কামরুজ্জামান। এখানেও প্রার্থী বাছাইয়ে স্বজনপ্রীতি ও অবৈধ অর্থ লেনদনের অভিযোগ রয়েছে। জবান আলী সরকার ও ডা. কামরুজ্জামানের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে বলে জানা গেছে।

এদিকে, নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ভোটারদের মধ্যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা ততই বাড়ছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি স্থানে বিচ্ছিন্ন কিছু সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। প্রশাসনের কড়া নজরদারির কারণে এখন অনেকটাই শান্ত হয়ে এসেছে পুরো এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি।

Leave a Comment

error: Content is protected !!