বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের অংশ মুজিবনগর

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের অংশ মুজিবনগর। স্বাধীনতা শব্দটি প্রত্যেকের মনকে ভিন্নভাবে আন্দোলিত করে এবং শিহরণ জাগায়। আর আমাদেও স্বাধীনতা মানেই পাকিস্তান থেকে কেবল আলাদা হওয়া নয়। স্বাধীনতা প্রাপ্তি মানেই বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ভূখন্ড একটি লাল সবুজের পতাকা আর মাথা উঁচু বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্ন।

আর সেই স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে যে কয়টি বিষয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো মুজিবনগর সরকার। আর সেটির সাথে উচ্চারিত হচ্ছে মুজিবনগর ও মুজিবনগর নামের একটি দিবস।

মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা যা পরবর্তী সময়ে মুজিবনগর নামে নাকরণ করা হয়। মুজিবনগর এলাকা, সরকার ও দিবস যা বঙ্গবন্ধুর নামানুসারেই প্রস্ফুটিত হচ্ছে সবসময়। এ সরকারের নামকরণ যেন মুজিবুরের প্রতিচ্ছবি। এমনিতেই মুজিবনগর নামটি অন্যান্য এলাকার মতোই সাধারণ একটি নাম। কিন্তু অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে শপথের এ আয়োজন আজকে এ এলাকাকে বিশেষভাবে পরিচিত করে তোলেছে আমাদের মাঝে।

কিন্তু এ পরিচিতির স্থায়িত্বকাল হয়নি বেশি দিন কারন স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭৫ সালে ১৫ ই আগস্টের ঘটনার মাধ্যমে এদেশের স্বাধীনতার অনেক বিষয়ই আমাদের মাঝ থেকে বিলীন হওয়ার পথে ছিল।

ঢাকা পড়েছিল স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস হারিয়ে গিয়েছিল ১৭ই এপ্রিলের মতো ঘটনাবলি যেটা কিনা স্বাধীনতার সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ন অংশ। এ দিবসটি আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের এক গৌরব উজ্জ্বল অধ্যায়। আশার কথা হলো বর্তমান সরকার দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এদেশের মানুষকে স্বাধীনতার উল্টো ইতিহাস বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল।

পরবর্তী পর্যায়ে অনেক আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পর স্বাধীনতার সত্যিকারের ইতিহাস জানার জায়গা তৈরি হয় বর্তমান প্রজন্মের মাঝে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ ঢেকে যাওয়া ১৭ই এপ্রিলের মতো ইতিহাস নিয়ে কথা বলছি। ইতিহাস বলছে এই অস্থায়ী সরকার ও শপথের বিষয়টি একদিনে তৈরি হয়নি।

বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ২৬ শে মার্চ যখন স্বাধীনতার ঘোষণা আসে তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে এদেশের সাধারণ মানুষ। এ যুদ্ধকে একটা ছকে আনা বা দেশের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য একটি সরকার ব্যবস্থা জরুরি হয়ে পড়ে। ২৬শে মার্চের কিছু দিন পরই ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল গঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম প্রবাসী সরকার যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত পায় শপথের পরে।

মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় আম বাগানে ১৭ই এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে। সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করার গণপরিষদের স্পীকার মো. ইফসুফ আলী।

প্রথমেই বলে রাখা উচিত ভারত সরকারের আশ্রয় এবং সহযোগিতায় এই সরকার গঠিত হয়েছিল পরবর্তীতে নয় মাস ভারতে বসেই রাজনৈতিক সামরিক এবং কূটনৈতিক বিষয়গুলো পরিচালনা করে আসছিল এ অস্থায়ী সরকার। শেখ মুজিবুর রহমান এই সরকারের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। তিনি ছিলেন সে সময় পাকিস্তানের কারাগারে বন্ধি। তার অনুপস্থিেিত উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। আর সে সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন তাজউদ্দিন আহমেদ। মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামান।

উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে জানা যায় পরে সেখানে এ সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন আনসার বাহিনীর সদস্য পিসি ইয়াদ আলী, ফকির মোহাম্মদ, নজরুল ইসলাম, মফিজ উদ্দিন, কিসমত আলী , মহিউদ্দিন, সাহেব আলী, অস্থির মল্লিক, আজিমুদ্দিন শেখ, সিরাজুল ইসলাম, হামিদুল ইসলাম ও লিয়াকত আলী। এসব আনসার সদস্যরা আজ আমাদের ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন। এ সরকার গঠনের পর থেকেই আপামর জনসাধারণের মাঝে আশার সঞ্চার হয়। মানুষ মুক্তিযুদ্ধে নিজের জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করে।

অন্যদিকে এই সরকার দেশের প্রতি সমর্থণ আদায়ের লক্ষে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে থাকে এবং যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকে। সত্যিকার অর্থেই তখনকার সময়ে দেশ পরিচালনা করা ছিল একটি অগ্নি পরীক্ষা। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন ধরণের অস্থিরতা ও সমস্যাকে মোকাবেলা করতে হয়েছে এ সরকারকে।

আজকের ১৭ই এপ্রিল সম্পর্কে আলোচনার পর্যায়ে যে নামটি বিশেষ গুরুত্ববহন করে তার মধ্যে অন্যতম যিনি এ শপথ পাঠের আয়োজনে বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন তখনকার সময়ের মেহেরপুরের সাবডিভিশনাল অফিসার তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। তার মুখের থেকে তখনকার আমবাগন সম্পর্কে কয়েকটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।“ ওই আমবাগনটা খুব ঘন আমবাগান। অনেক পুরনো আমাগাছ- গাছে গাছ লেগে ছাতার মতো হয়ে থাকে। দিনের আলো ঝিলমিল করছিল, আনন্দঘন উৎসবের মতো লাগছিল। মনে হচ্ছিল প্রকৃতিও যেন এটাকে সমর্থন দিচ্ছে, আর রুপকথার মতো অনুষ্ঠানটি শেষ হলো।

অজপাড়াগায়ের একটি পল্লী- যে আমবাগানে কখনো কিছু হতো না- সেখানে একটা দেশের সরকারের প্রথম শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। আমরা সবাই যখন চলে গেলাম, তখন যেন রাজকন্যাকে সোনার কাঠি দিয়ে আবার ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হলো।” তখনকার সময়ের সে আম বাগান আজ পরিচিতি পেয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অংশ হিসেবে। তিনি বলেন নিরব স্থানটিকে বিভিন্ন কারনে বেছে নেয়া হয়েছিল সেসময় নিরাপত্তার স্বার্থে। কারন আম বাগানের নিচে কি হচ্ছে তা উপর থেকে দেখা যেত না।

যার ফলে উপর থেকে আক্রমনের কোন সুযোগ ছিল না। কে জানতো সে নিরব স্থানটি আজ হবে কালের স্বাক্ষী। এবং গঠিত সেই সরকারই হবে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করার সরকার। কঠিন প্রেক্ষাপটে এ সরকার যখন দায়িত্ব নেয় তখন থেকেই অভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক সকল ক্ষেত্রেই বিশেষ ভূমিকা পালন করে দেশের যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য দেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে এবং বহির্বিশ্বে যুদ্ধের সপক্ষে সমর্থন ও জনমত আদায়ের চেষ্টায় লিপ্ত হয় এবং সফলতাও অর্জিত হয় বেশ।

তৎকালীন সময়ে কলকাতা, দিল্লী, লন্ডন, ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, সুইডেনসহ বেশ কয়েকটি স্থানে মিশন স্থাপন করে দেশের পক্ষে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে এ মুজিবনগর সরকার।

জানা যায় এছাড়াও ১৯৭১ সালের অক্টোবরে মুজিবনগর সরকারের ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরির নেতৃত্বে ১৬ সদস্যে একটি প্রতিনিধি দলকে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের জন্য পাঠানো হয়। এই অধিবেশনে উপস্থিত ৪৭টি দেশের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘটনা শুনে সহানুভূতি প্রকাশ করেন। এভাবে মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় বহির্বিশ্বেও সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থনের ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে যাই।

এসব কর্মযজ্ঞ মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়ার ফলে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন দ্রুত হয়। এসরকারের এসব সফলতাকে দীর্ঘদিন মানুষের অন্তরালে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস কখনও নিরব থাকে না। চাপা দিয়ে রাখলেও সময় সুযোগে মানুষের সামনে চলে আসে। আর এই সরকারের ইতিহাসটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সরাসরি জড়িত।

এই সরকার ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা শব্দটি অর্জন করাই হতো কঠিন। তাই মুজিবনগর সরকারের ইতিহাস দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে স্পষ্ট হওয়া জরুরি কারন এটি আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের অংশ।

লেখক পরিচিতি
প্রভাষক নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার
শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী

Leave a Comment

error: Content is protected !!