ইমানি চেতনায় শুরু হোক নতুন বছর

ইমানি চেতনায় শুরু হোক নতুন বছর – ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা। সময়ের ধারাবাহিকতায় আরও একটি বছর শেষে নতুন বছরের অপেক্ষায় রয়েছে সবাই। বিগত বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে অনেকের অনেক রকম প্রস্তুতি চলছে। এ ক্ষেত্রে ইমানি চেতনা ইমানদারদের নতুন বছরের আগমন ভিন্ন দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করতে শেখায়। কারণ জীবনকে কাজে লাগানোই সবচেয়ে বড় বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। আর সে জন্য প্রয়োজন ইমানি চেতনায় নতুন বছরকে সমৃদ্ধ করে তোলা। নতুন বছরে মুমিনের কয়েকটি করণীয়ের কথা এখানে তুলে ধরা হলো:

ইমান নবায়ন

ইমান কমবেশি হয়। কখনো শূন্য হয়ে যায়। এ জন্য ইমান নবায়ন করতে হয়। মহান আল্লাহর স্মরণে ইমান বৃদ্ধি পায়। নতুন বছরকে ইমান নবায়নের সূচনায় পরিণত করা যেতে পারে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘তোমাদের ইমান নবায়ন করো।’ সাহাবায়ে কেরাম জানতে চাইলেন, ‘কীভাবে ইমান নবায়ন করব, হে আল্লাহর রাসুল?’ তখন তিনি বললেন, ‘বেশি বেশি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়তে থাকো।’ (মুসনাদে আহমাদ: ৮৭১০)

এ ছাড়া আল্লাহর কাছে ইমান নবায়ন করার প্রার্থনা করতে হয়। আবদুল্লাহ ইবন ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অবশ্যই তোমাদের হৃদয়ে ইমান জীর্ণ হয়, যেমন জীর্ণ হয় পুরোনো কাপড়। সুতরাং তোমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো, যাতে তিনি তোমাদের হৃদয়ে তোমাদের ইমান নবায়ন করে দেন।’ (মুসতাদরাক: ৫)

খাঁটি তওবা

অতীতের মন্দ কাজের জন্য বিশেষভাবে অনুতপ্ত হওয়াকে তওবা বলে। বিশুদ্ধ তওবা হলো—কৃত গুনাহের জন্য অনুশোচনা করা, আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং ভবিষ্যতে এসব গুনাহ না করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো—খাঁটি তওবা; সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কাজগুলো মোচন করে দেবেন এবং তোমাদের প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত।’ (সুরা তাহরিম: ৮)

আল্লাহর কাছে কল্যাণ কামনা

নতুন বছরের আগমনে মহান আল্লাহর কাছে ইহকালীন ও পরকালীন সুখ, শান্তি, সফলতা এবং কল্যাণ কামনা করা যেতে পারে। আল্লাহই বান্দার সুখ, শান্তি, সফলতা ও কল্যাণ প্রদান করেন। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আমি কি তাঁর (আল্লাহর) পরিবর্তে অন্যদের উপাস্যরূপে গ্রহণ করব? করুণাময় যদি আমাকে কষ্টে নিপতিত করতে চান, তবে তাদের সুপারিশ আমার কোনো কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে রক্ষাও করতে পারবে না। এরূপ করলে আমি প্রকাশ্য ভ্রষ্টতায় পতিত হব।’ (সুরা ইয়াসিন: ২৩-২৪)

জীবনের হিসাব মেলানো

আল্লাহ তাআলা মানুষকে সুনির্দিষ্ট একটি সময়কাল দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এই সময়কালের কোনো হেরফের বা কমবেশি হয় না। যার জন্য যতটুকু সময় নির্ধারিত, ততটুকু ফুরিয়ে গেলেই জীবন শেষ হয়ে মৃত্যুর ডাক এসে যায়। নতুন বছর আগমনকালে বিগত বছরের পর্যালোচনা করা খুবই যৌক্তিক বিষয়।

অতীতের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে নতুন বছরে নির্ভুল এবং পাপমুক্ত জীবন কাটানোর জন্য প্রত্যয়ী হওয়া উচিত। এভাবে পরকালে আল্লাহর সামনে হিসাব-নিকাশের মুখোমুখি হওয়ার আগে পৃথিবীতেই জীবনের হিসাব-নিকাশ করে নিতে হয়। নতুন বছরে ওমর (রা.) বলতেন, ‘তোমরা তোমাদের নিজেদের হিসাব করে নাও—তোমাদের হিসাব নেওয়ার আগে।’ (তিরমিজি: ২৪৫৯)

নতুন বছরের পরিকল্পনা

নতুন বছর আগমনকালে নতুন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। সঠিক পরিকল্পনা সফলতার পথ দেখায় আর সঠিক নিয়ত কাজের গতি বাড়ায়। কাজের শুরুতে নিয়তের গুরুত্ব অপরিসীম। নতুন বছর সামনে রেখে নিয়ত ঠিক করে পরিকল্পনা সাজাতে হবে। ইমানদারদের প্রথম পরিকল্পনা হওয়া চাই আমল ও আখলাক নিয়ে। বছরের প্রথম দিন থেকে নামাজ-রোজাসহ ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলো যথার্থভাবে আদায়ের পরিকল্পনা, কোরআন তিলাওয়াত ও ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের পরিকল্পনা, পরোপকার, দান-সদকা বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা ইত্যাদি।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সম্বোধন করে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘এবং কাজে-কর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো, এরপর তুমি কোনো সংকল্প করলে আল্লাহর ওপর ভরসা করবে; যারা ভরসা করে, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৫৯)

আল্লাহর নিদর্শন থেকে শিক্ষা

সূর্য ও চন্দ্র মহান আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি এবং অন্যতম নিদর্শন। বিশ্ব ব্যবস্থাপনা সূর্য ও চন্দ্রের গতি এবং আলোর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। সূর্য ও চন্দ্রের গতি ও নিজ নিজ কক্ষপথে বিচরণব্যবস্থা একটি বিশেষ হিসাব ও পরিমাপ অনুযায়ী চলছে। এর মাধ্যমেই রাত-দিনের পার্থক্য, ঋতুর পরিবর্তন এবং মাস-বছর নির্ধারিত হয়। সূর্যের গতি থেকে সৌরবর্ষ এবং চন্দ্রের গতি থেকে চান্দ্রবর্ষ হিসাব করা হয়। আকাশের চাঁদ দেখে চান্দ্রমাসের হিসাব সহজেই আয়ত্ত করা যায়।

এ জন্য ইসলামি শরিয়ত চান্দ্রমাসের হিসাব গ্রহণ করেছে। সে হিসাবেই রোজা, হজ ইত্যাদি সম্পাদিত হয়। এসব নিদর্শন থেকে শিক্ষা লাভ করে আল্লাহমুখী হওয়াই ইমানি চেতনার আবেদন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং এর মঞ্জিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো। আল্লাহ এসব নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এসব নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন।’ (সুরা ইউনুস: ৫)

ইসলামবিরোধী কাজকর্ম পরিহার

নতুন বছরকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানানো বা বিগত বছরকে বিদায় জানানোর সঙ্গে ইসলামের ইবাদত-বন্দেগি, রীতি-নীতি বা সভ্যতা-সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক নেই। ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ পালন বা এ-জাতীয় আচার-অনুষ্ঠান মুসলমানদের জন্য অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে অশ্লীলতা, নগ্নতা, মদ্যপান, যৌন-উন্মাদনাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘটে থাকে, যা ইসলামের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ। ইসলামে কোনো ধরনের অনৈতিক কাজের সুযোগ নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎকর্ম ও সীমা লঙ্ঘন; তিনি তোমাদের উপদেশ দেন—যাতে তোমরা শেখো।’ (সুরা নাহল: ৯০)

নতুন আরেকটি বছরের আগমন আমাদের জীবন আরও সংকীর্ণ করছে এবং মৃত্যুর কাছে নিয়ে যাচ্ছে। কাজেই জীবন ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই এটিকে মূল্যায়ন করতে হবে। বিগত বছরের পর্যালোচনা এবং নতুন বছরের ইমানকে সমৃদ্ধ করার কর্মপরিকল্পনাই হোক নতুন বছরের আগমনী বার্তা।

লেখক: ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা, সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Comment

error: Content is protected !!