ইমাম আবু হানিফার আদর্শিক লড়াই

আবু হানিফা আন নুমান ইবনুস সাবিত (রহ.) খ্রিস্টীয় ৬৯৯ সনে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের শাসনকালে কুফায় জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) যখন যৌবনে পৌঁছেন তখন উমর ইবনুল আবদিল আজিজের স্বর্ণযুগ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর নির্দেশে হাদিস সংগ্রহের যে অভিযান শুরু হয় তা পুরোদমে চলছিল। হাদিসবিশারদদের একদল ছিলেন সংগ্রাহক। অন্য দলে ছিলেন বিশ্লেষক। আবু হানিফা (রহ.) ছিলেন দ্বিতীয় দলের একজন।

খ্রিস্টীয় ৭৫০ সনে উমাইয়া খিলাফতের অবসান ঘটে। শুরু হয় আব্বাসীয় খিলাফত। আবু হানিফা (রহ.) আব্বাসীয় দ্বিতীয় খলিফা আবু জাফর আবদুল্লাহ আল-মানসুরের শাসনকালের মধ্যভাগ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।

এই সময় খারেজি, মুতাজিলা ও মুর্জিয়া নামে বিভিন্ন চিন্তাধারার নেতা ও কর্মীরা ঈমান, কুফর, খিলাফতে রাশেদা এবং সাহাবিদের মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়ে বিভ্রান্তিকর চিন্তা ছড়াতে থাকে। আবু হানিফা (রহ.) এসব মতবাদের ভ্রান্তি উন্মোচন করে সঠিক চিন্তাধারা উপস্থাপন করেন।

রাষ্ট্রদর্শনের অন্যতম মৌলিক বিষয় হচ্ছে সার্বভৌমত্ব। এই বিষয়ে ইসলামের সর্বজনস্বীকৃত মতবাদই ছিল আবু হানিফার মতবাদ। অর্থাৎ সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর। আইনের উৎস সম্পর্কেও তিনি সঠিক চিন্তার অধিকারী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কিতাবে কোনো বিধান পেলে আমি তা দৃঢ়ভাগে গ্রহণ করি। আল্লাহর কিতাবে সেই বিধানের সন্ধান না পেলে আল্লাহর রাসুলের সুন্নাহ গ্রহণ করি। আল্লাহর কিতাব ও রাসুলের সুন্নাহতে কোনো বিধান না পেলে আসহাবে রাসুলের (সাহাবিদের) ইজমা অনুসরণ করি। আর কোনো বিষয়ে তাঁদের মাঝে মতপার্থক্য থাকলে কোনো সাহাবির মত গ্রহণ করি এবং ভিন্নমত পোষণকারী সাহাবির মত গ্রহণ করি না। তাঁদের বাইরে অন্য কারো মত গ্রহণ করি না। বাকি রইল অন্যদের মত। ইজতিহাদের অধিকার তাঁদের যেমন আছে, তেমনি অধিকার আমারও আছে।’

খিলাফতে রাশেদার পর শুরাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অবিদ্যমানতার ফলে আইনব্যবস্থায় শূন্যতার সৃষ্টি হয়।

রাষ্ট্রের বিস্তৃতি ঘটছিল। নিজেদের সংস্কৃতি ও আচার-অনুষ্ঠান নিয়েই বহু জনগোষ্ঠী মুসলিম রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছিল।

কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক লেনদেন, শুল্ক, যুদ্ধ, সন্ধি ইত্যাদি বিষয়ক নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছিল। অথচ কোনো স্বীকৃত সংস্থা ছিল না যেখানে বসে মুসলিম বিশেষজ্ঞরা সেসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারতেন। এই শূন্যতা পূরণের জন্য আবু হানিফা (রহ.) একটি সংস্থা গড়ে তোলেন, যাকে একটি বেসরকারি আইন পরিষদ বলা যায়।

আবু হানিফা (রহ.)-এর কয়েক হাজার ছাত্রের মধ্যে বিশিষ্টতা লাভ করেছিলেন ৩৬ জন (মতান্তরে ৪০ জন)। তাঁদের মজলিস বসত প্রতিদিন। একটি সমস্যা নিয়ে কয়েক দিন কিংবা কয়েক মাস ধরে আলোচনা হতো। আলোচনান্তে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো। এই মজলিস হাজার হাজার সমস্যার সমাধান উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। আবু হানিফা (রহ.)-এর শিক্ষা মজলিস থেকে আহরিত জ্ঞান নিয়ে হাজার হাজার ছাত্র রাষ্ট্রের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েন।

বনু উমাইয়ার সর্বশেষ খলিফা মারওয়ান ইবনে মুহাম্মাদ কর্তৃক নিযুক্ত ইরাকের গভর্নর ছিলেন ইয়াজিদ ইবনে উমর ইবনে হুবাইরা। তিনি ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-কে বিচারপতি পদ গ্রহণ করার প্রস্তাব দেন। ইমাম সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এতে ইয়াজিদ ইবনে উমর খেপে যান। তাঁর নির্দেশে প্রতিদিন ১০টি করে ১১ দিন পর্যন্ত তাঁর পিঠে ১১০টি চাবুক মারা হয়। এত বড় শাস্তির পরও ইমাম আবু হানিফা (রহ.) তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। আব্বাসীয় খলিফা মানসুর আবু হানিফা (রহ.)-কে বিচারপতি বানাতে চান। তিনি রাজি হননি। এ জন্য তাকে বন্দি করা হয়। খ্রিস্টীয় ৭৬৭ সনে তিনি বন্দি অবস্থায় বাগদাদে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর ইন্তেকালের মাধ্যমে তাঁর আদর্শিক লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটে, কিন্তু তিনি সত্য থেকে পিছপা হননি।

Leave a Comment

error: Content is protected !!