ঈশ্বরদীর গণকবর -অধ্যাপক স্বপন কুমার কুন্ডু

ঈশ্বরদী উপজেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য গণকবর ও বধ্যভূমি। স্বাধীনতার ৫২ বছর কেটে গেলেও বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণে নেই কোনো উদ্যোগ। নেই শহিদদের তালিকা। পরিবারগুলো পায়নি শহিদ পরিবারের মর্যাদা।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বিহারিরা ঈশ্বরদী দখলের দুই দিন পর ১৩ এপ্রিল সকালে কর্মকারপাড়ায় চন্দ্রকান্ত পালের পরিবারের ওপর হামলা করে। চন্দ্রকান্ত পাল, তার দুই পুত্র, দুই পুত্রবধূ, ছয় নাতি-নাতনি, একজন দোকান কর্মচারীসহ ১২ জনকে কুপিয়ে হত্যা করে। সবাইকে বাড়ির কুয়ার মধ্যে ফেলে গণকবর দেওয়া হয়। পরিবারের সদস্য মাধব পাল শহিদ পরিবারের মর্যাদার দাবি জানিয়েছেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধে ঈশ্বরদীর সোনালি ইতিহাসের পাশাপাশি রয়েছে নির্মম নৃশংস ঘটনা। প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পৌর এলাকায় সে সময় প্রায় ২০ হাজার অবাঙালি (বিহারি) বাস করত। এদের অত্যাচারে বাঙালিরা শহরে যাতায়াত করতে পারত না। শহরে বাঙালিদের পেলেই ধরে নিয়ে হত্যা করা হতো।

মুক্তিযোদ্ধারা জানান, চিহ্নিত বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে প্রায় ৩০টি। বধ্যভূমির বাইরেও উপজেলা জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য গণকবর। গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো এখন অযত্ন, অবহেলা আর দৃষ্টিসীমার বাইরে। এসব স্থান এখন ঘাস, ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ, পরিণত হয়েছে গোচারণভূমিতে। বসতবাড়িও নির্মাণ করা হয়েছে। স্বজন হারানো শহিদ পরিবারের সদস্যদের দাবি বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করে স্মৃতিফলক নির্মাণের। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়ভাবে শহিদ পরিবারের মর্যাদা। আগামী প্রজন্ম যেন মহান মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমী মানুষের আত্মত্যাগ সম্পর্কে জানতে পারে।

একাত্তরের ১১ এপ্রিল থেকে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর অবাঙালি ও কতিপয় বাঙালি ঈশ্বরদীতে বাঙালি নিধনে মেতে ওঠে। পাকিস্তানি সেনাদের আগমনের কথা ছড়িয়ে পড়লে নিরাপত্তার জন্য কিছু মানুষ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আশ্রয় নেয়। তারা ভেবেছিল, মুসলিম তাই মসজিদে অন্তত হামলা হবে না। কিন্তু হানাদার বাহিনী বাঙালি নিধনে মসজিদেও হানা দেয়। ১২ থেকে ১৯ এপ্রিলের মধ্যে মসজিদে আশ্রয় নেওয়াদের ১৯ জনকে প্রেসক্লাব-সংলগ্ন কয়লা ডিপোতে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এছাড়া আশপাশের মহল্লা থেকে বাঙালিদের ধরে এনে এখানে হত্যা করে গণকবর দেয়।

পাকশী রেলওয়ে হাসপাতালের ডা. রফিক আহমেদকে তার তিন ছেলেসহ একই পরিবারের পাঁচ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১২ এপ্রিল পাকশীতে রেলের বাসায় হামলা করে এই নারকীয় গণহত্যা চালায় বিহারি ও হানাদার বাহিনী। বাসায় বেড়াতে আসা এক আত্মীয়কেও হত্যা করে। পাকশীতে পানির ট্যাংকির কাছে রাস্তার পাশে এদের সমাহিত করা হয় একটি গণকবরে। পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। পাকশী পেপার মিল, অফিসার্স মেস ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পুলিশ ফাঁড়িতে ক্যাম্প করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। এসব ক্যাম্পে বন্দিদের হত্যা করে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পদ্মা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো। পাকশী রেলস্টেশনের বাম দিকের জঙ্গলে ফেলা হয় বহু লাশ।

পরবর্তী সময়ে এটিকে গণকবর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১২ এপ্রিল অবাঙালিদের সহয়তায় লতিফ, আঁতু ও নান্নু—এই তিন সহোদরকে পাকশী রেল কলোনির ভেতরে হত্যা করে। কয়েক দিন পড়ে থাকার পর সুইপাররা লাশ তিনটি কলোনির মধ্যেই গর্ত করে মাটিচাপা দেয়, যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ বাঙালিরা ঈশ্বরদী রেল জংশন দিয়ে ট্রেনযোগে যাতায়াত করত। বিহারিরা ট্রেনে আগত যাত্রীদের ধরে জবাই ও গুলি করে হত্যা করত। রেলের ফাঁকা জায়গায় অসংখ্য বাঙালিকে হত্যার পর অবাঙালি ও রাজাকাররা মাটির নিচে চাঁপা দিয়ে রাখত। শহরের আলহাজ্ব মিলের পেছনের কাশবনে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা দুই শতাধিক নর-নারীকে হত্যা করে। এই বধ্যভূমি ও গণকবর আজও শনাক্ত করা হয়নি। ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা বাঘইল পশ্চিমপাড়ার একটি বাড়িতে ২৩ জন নর-নারীকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পরে গ্রামবাসী লাশগুলো একটি বিশাল গর্ত করে পুঁতে ফেলে।

বিহারি অধ্যুষিত ফতেহ মোহাম্মদপুর লোকশেডে পাকিস্তানি বাহিনীর ছত্রছায়ায় বিহারিরা ১২ ও ১৩ এপ্রিল অসংখ্য বাঙালিকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। এই হত্যাযজ্ঞে আজিজুল গনি, আব্দুল বারীসহ প্রায় ৩০-৩৫ জন শহিদ হন।

ফতেহ মোহাম্মদপুর রেলওয়ে কলোনি, অর্থাত্ লোকোশেড পাম্পহাউজ স্টেশনে একটি বধ্যভূমি রয়েছে। এখানে হত্যার জন্য গুলির পরিবর্তে ধারালো তরবারি বা ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। রেলওয়ের এই পরিত্যক্ত পাম্পহাউজে কত বাঙালিকে যে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। লোকশেডের উত্তর পাশে বর্তমানে পানির ট্যাংকির পেছনে খেলার মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণে ছোট বটগাছের নিচে রয়েছে একটি গণকবর। অথচ কোনো কবর বাঁধানো এমনকি নামফলক বা স্মৃতিচিহ্ন নেই, যা দেখে মানুষ বুঝতে পারবে এখানে মুক্তিযুদ্ধে জীবন উত্সর্গকারী বাঙালিরা ঘুমিয়ে আছে।

নূর মহল্লার খেলার মাঠের উত্তর কোণে রয়েছে একটি গণকবর। এই গণকবরে ১০-১২ জন শহিদ ঘুমিয়ে আছেন। মাজদিয়া মাদ্রাসাপাড়ার একটি স্থানে অসংখ্য নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়। এলাকাটি এখনও জামায়াত অধ্যুষিত বলে এই গণকবরগুলো চিহ্নিত করা হয়নি।

ঈশ্বরদী মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা চান্না মন্ডল জানান, মুক্তিযুদ্ধে ২৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ অসংখ্য বাঙালি শহিদ হন। এখনো পর্যন্ত শহিদদের কবর ও বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি। ১৬ ডিসেম্বর এলেই রণাঙ্গনে শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবরগুলোতে আমরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু তাদের কবরগুলোও রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। রাষ্ট্রের কাছে আমাদের দাবি, অতি শিগিগর মুক্তিযোদ্ধাদের কবর ও শহিদদের গণকবরগুলো চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করা এবং স্মৃতিফলক স্থাপন করা হোক। যাতে আগামী প্রজন্ম জানতে পারে এই গণকবরগুলো মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগী শহিদদের।

শহিদ হওয়া মোয়াজ্জেম হোসেনের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা তহুরুল আলম মোল্লা জানান, পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও বিহারিরা ১৭ এপ্রিল মসজিদে আশ্রয় নেওয়া তার পিতা মোয়াজ্জেম হোসেনসহ বহু মুসল্লিকে ধরে এনে প্রেসক্লাবের পাশে কয়লা ডিপোর কাছে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

মুক্তিযুদ্ধের গবেষক, লেখক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর স্থানীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে শহিদদের কবর চিহ্নিত ও সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা করে যেখানে-সেখানে লাশ ফেলে রাখতো। এসব লাশ সত্কারের লোক ছিল না। আত্মীয়স্বজনও মরদেহ নিয়ে যাওয়ার সাহস পায়নি। চরম অবহেলায় সুইপাররা লাশগুলো গর্ত করে পুঁতে ফেলত। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে এসব বধ্যভূমি, গণকবর সংরক্ষণ ও নামফলক নির্মাণ অত্যাবশ্যকীয়। বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সপক্ষের সরকার এসব বধ্যভূমি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবে এমনটি আশা করে শহিদ পরিবারগুলো।

লেখক: অধ্যাপক স্বপন কুমার কুন্ডু
সাবেক কলেজ শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী

Leave a Comment

error: Content is protected !!