একজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প

একজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প: পৌষের জোস্না রাত…….
চারদিকে ঘন কুয়াসায় ঢাকা আর তার সাথে পূর্নিমার আলোয় মিলেমিশে ভৌতিক এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে বিস্তৃত এই ফসলের মাঠের দিগন্তে।

এই পৌষের রাতে যে যেইভাবে পারে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমুতে যাবার কথা ছিলো, কিন্তু নাহ,, পাক আর্মির ক্যাম্প করেছে খালের ওপারে, যে কোন মুহুর্তে খাল পাড়ি দিয়ে ঢুকে পরতে পারে পেওরাইট গ্রামে। খালের এই পারেই এই বিস্তৃত ফসলের মাঠ,সারা মাঠে সরষে ক্ষেতের হলুদ ফুল গুলো জোস্নার আলোয় হলুদ রঙের সাগর মনে হচ্ছে।

গ্রামের মানুষ সব ভয়ে পালিয়ে গেছে জঙ্গলের ভেতর।।
এখন শুধু গ্রামে আছে মুক্তি বাহিনীর হাতে গনা দশেক তরুন।
এই তরুণ যুবকরা সবাই এই পেওরাইট গ্রামের বাসিন্দা।
মুক্তিবাহিনীর স্পেশাল গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে তারা ফিরে এসেছে নিজ দেশ কে শত্রু মুক্ত করতে।

সন্ধা রাতে দশ জনের মিটিংয়ে ব্রিফিং করছেন গ্রামের যুবক তিতুমীর, সে হচ্ছে কমান্ডার।
রাত্রে খাল পাড়ি দিবে পাঁচ জন,আর পাঁচ জন এইপাশ থেকে শেল্টার দিবে, যাতে নির্বিঘ্নে গ্রেনেড চার্জ আর ভূমি মাইন পেতে রেখে আসতে পারে।

মধ্য রাতে সরষে ক্ষেতে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলেছে তাঁরা দশজন,, পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিতুমীর সহ আরো চার জন কনকনে শীতের ঠান্ডা এই রাতে লুঙ্গী কাচা দিয়ে কচুরিপানা মাথায় বেঁধে নেমে গেলো খালের পানিতে।
পাক আর্মির চোখ ফাঁকি ঢুকে গেলো ক্যাম্প এড়িয়া,,

ভূমি মাইন পেতে রেখে হামাগুড়ি দিয়ে আরও কাছে গিয়েই শুরু করলেন ফায়ারিং,, এই দিকে আগে থেকেই বলাছিলো এইপাশ থেকে ফায়ারিং শুরু হবে ক্যাম্পে গ্রেনেড চার্জ করার পরে।

তারা পাঁচ জন নিজেদের কে শেল্টার দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পের আরো কাছে,সেই সাথে ফায়ারিং, পাক আর্মি ও পাল্টা জবাব দিতে শুরু করেছে ভারি অস্র, গোলা বারুদ দিয়ে।পাঁচ
জনের মাথার উপরে দিয়ে সাঁই সাঁই বেগে ছুটে যাচ্ছে যাঁকে যাঁকে বুলেট।

দ্রুত সিদ্ধান্তঃ নিয়ে নিলো তিতুমীর, গ্রেনেড চার্জ করে পিছু হটতে শুরু করলো তাঁরা,আর অপর দিকে অপেক্ষায় বসে থাকা বাঁকি পাঁচ জন ও শুরু করলো লক্ষভেদ করা গুলি।

শেল্টার পেয়ে দ্রুত পিছু হটতে শুরু করলো তাঁরা পাঁচ জন।
কিন্তু দূর্ভাগ্য দেখা দিলো খালের পাশে এসে, এতো ক্ষনে পাক হানাদার দের সার্চ লাইট অন্য দিকে ছিলো, কিন্তু এখন সার্চ লাইটের ঝলকানি আলোয় খালারে ভেতর দিনের আলো ফুটে উঠেছে, খালে নামলে নির্ঘাত গুলির বুকে নিতে হবে।
আবার খাল পাড়ি না দিলে নিশ্চিত মৃত্যু।

এখন সামনে পথ দুইটা, হয় মুখোমুখি লড়াই করে মৃত্যু আর নয়তো একজন শেল্টার দিবে বাকি চার জন খাল পাড়ি দিয়ে ওপারে চলে যাবে,,কেও একজনকে জীবন বাজি ধরতেই হবে।।

পাঁচ জনের কেও পিছু হটতে রাজি নয়,সবাই এক কথা সে শেল্টার দিবে,, অবশেষে তিতুমীর নিজে সবাইকে বুঝিয়ে নির্দেশ দিলেন পিছু হটতে, তিনিই থাকবেন শেল্টার দিতে।
বাকি চার জন অনিচ্ছা সত্যেও কমান্ডারের নির্দেশ পালন করতে বাধ্য হয়ে পিছু হটতে শুরু করলো।

তিতুমীর এগিয়ে যেতে লাগলো টাওয়ারের দিকে, লক্ষ্য সার্চ লাইট নিভিয়ে দেওয়া, যাতে সঙ্গীরা নির্বিঘ্নে খাল পাড়ি দিয়ে ওপারে পৌঁছাতে পারে।

এই দিকে তুমুল গোলাগুলিতে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠেছে,
বাতাসে শুধু বারুদের গন্ধ,,এই গন্ধেই তিতুমীরের রক্তে উন্মাদনায় আগুন ঝলে উঠলো।
দ্রুত এগিয়ে যেয়ে গুলি করে সার্চ লাইট নিভিয়ে দিলো,তারপর অন্ধকারে আড়াল হয়ে দেখে দেখে মারতে লাগলো পাক আর্মির একেকটা সদস্য কে।

এই দিকে বাকি নয়জন গুলি চালিয়ে যাচ্ছে অবিরাম, প্রচুর গুলাগুলিতে পাক আর্মির ক্যাম্পের ভেতর গোলাবারুদ রাখা তাবুতে আগুন লেগে গেল, পাক হানাদার বাহিনী তখন আগুন নেভাতে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
আর এই সুযোগ তিতুমীর শুরু করে দিলো মুহুর্মুহু আক্রমণ, গ্রেনেড চার্জ শুরু করে দিলো, সাথে পাকিদের কাছ থেকে পাওয়া এ এম জি দিয়ে ব্রাশ ফায়ার।

রক্তে যেন আগুন লেগে গেল আজ,মুখে জয় বাংলা স্লোগান নিয়ে আর মাথায় পতাকা বেঁধে তুমুল আক্রমণে মেতে উঠলো সে।

পাকিস্তান আর্মি আক্রমণে দিশেহারা হয়ে গেলো, এই দিকে গোলাবারুদের স্তুপে আগুন লেগে সব শেষ, তাই পালাতে শুরু করলো তারা, পালানোর সময় পুঁতে রাখা মাইন ফেটে ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে উড়ে গেলো অনেক হানাদারের দেহ।

হঠাৎ একটা গুলিবএসে লাগলো তিতুমীরের ডান পাশে বুকে, ফিনিক দিয়ে রক্তের একটা উষ্ণ ধারা বুক বেয়ে শুকনা মাটি ভিজিয়ে দিলো,
হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেলো এ এ এম জি টা।

তবুও তিতুমীর থেমে গেলো না আবার হাতে তুলে নিলো অস্র, বাম হাত দিয়েই গুলি চালিয়ে যাচ্ছিলো সে,আরেকটা গুলি এসে লাগলো তার বাঁম কাঁধে, ছিটকে গিয়ে দশ হাত দূরে পড়ে গেলো সে।

রক্তের স্রোতে ভিজে গেলো সারা দেহ, মাটি।

ধীরে ধীরে গুলাগুলি থেমে গেলো, পাকিরা সব পালিয়ে গেছে।।

খালের ওপারে জয় বাংলা, বাংলার জয় স্লোগানে স্লোগানে কাঁপিয়ে তুলেছে তাঁর সহযোদ্ধারা।

তিতুমীরের মাথাটা কেমন যেন শুন্য হয়ে আসছে, বাড়িতে সাত মাসের পোয়াতি বউকে শেষ গত সপ্তাহে দেখে এসেছিলো, বলেছিল খুব শীগ্রই সে দেশ স্বাধীন করে বাড়ি ফিরবে, আর এর ভেতরে যদি না ফিরে তবে ছেলে হলে যেন নাম রাখে বিজয় আর মেয়ে হলে মুক্তি।।
বুড়ো মা বাবার চেহারা টা ও ভেসে উঠেছে চোখের সামনে,
ছোট বোন কে ও খুব দেখতে মন চাচ্ছে,বোন টা শীতের জন্য একটা নকশি তোলা চাঁদর বানাচ্ছিলো তিতুমীরের জন্য,
বলেছিলো এবার বাড়ি গেলে যেন নিয়ে আসে,রাত বিরাতে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে হয়,শীতে কষ্ট হয় ভাইয়ের।

তিতুমীরের এখন কেন যেন শীত লাগছেনা, বুক কাঁধ থেকে রক্তের একটা ধারা বেয়ে এগিয়ে গিয়ে খালের পানিতে পড়েছে।
খালের ঠান্ডা পানিও যেন উষ্ণ হয়ে উঠছে রক্ত মিশে যেয়ে।

তিতুমীরের প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে এখন, চোখ জুড়িয়ে ঘুম আসছে, সে দেখছে তার মা তাকে মাথায় হাত ভুলিয়ে ঘুম পারাচ্ছে…
ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে যাচ্ছে তিতুমীর, এই ঘুম আর শেষ হবার নয়……….।।

লেখকঃ এম এ কাইয়্যুম ইসলাম, মালদ্বীপ প্রবাসী

Leave a Comment

error: Content is protected !!