একটি ঘর একটি স্বপ্ন

একটি ঘর, একটি স্বপ্ন। সে স্বপ্নের পথে হাঁটেন প্রায় সবাই। ধরতে পারেন কেউ কেউ। আবার ব্যর্থও হোন অনেকেই। কিছু মানুষ আবার স্বপ্ন দেখতেও ভয় পান। সে ভয় হয়তো বিরত রাখে স্বপ্ন দেখতেও। এই ভয় অযৌক্তিক নয়, পুরোপুরি যৌক্তিক। চরম বাস্তবতা তাদেরকে পরম এই সত্যকে মেনে নিতে শিখিয়েছে। তাই ‘স্বপ্ন সবার জন্য নয়’ মেনে, দু’মুঠো উদরপূর্তি করার পেছনে জীবন ব্যয় করার নিয়ম তৈরি করেন। কিন্তু সময় যে খুব শক্তিশালী! সময়ে পরিবর্তন হয় গতিপথ।

পরিবর্তিত গতিপথ এবার মিশেছে স্বপ্ন পূরণের মোহনায়। যে মোহনায়, নিয়মের বেড়াজাল ছিন্ন করে, স্বপ্ন দেখার বাস্তবতা তৈরি হয় প্রতিটি গৃহহীন পরিবারের। শুরু হয় মুজিববর্ষের আবাসন প্রকল্প। আশা বাঁধতে থাকে গরিব গৃহহীন পরিবারগুলো। তাঁরাও যে পেতে যাচ্ছে স্বপ্নের একটি ঘর। পূরণ হতে যাচ্ছে হৃদয় গহীনে লালিত ‘এক চিলতে স্বপ্ন’।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নোয়াখালী, বর্তমান লক্ষীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চরপোড়াগাছা গ্রামে ভূমিহীন-গৃহহীন, অসহায় ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুজিববর্ষ উপলক্ষে ঘোষণা দেন প্রতিটি গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন আওতায় আনার।

হিসেব করা হয় গৃহহীন পরিবারের। সারাদেশে দেখা যায়, ঘর নেই, জমি নেই এমন পরিবারের সংখ্যা ২ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬১। ভিটেমাটি আছে, ঘর জরাজীর্ণ কিংবা ঘর নেই এমন পরিবারের সংখ্যা ৫ লাখ ৯২ হাজার ২৬১। মুজিববর্ষ উপলক্ষে যে তালিকা করা হয়, সব মিলিয়ে সেই তালিকায় ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি পরিবার রয়েছে। হিসেব-নিকেশ শেষে শুরু হয় আবাসন প্রকল্প। পূরণ হতে থাকে অধরা স্বপ্নগুলো। বাদ যায়নি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলাও। বিভিন্ন পর্যায়ে এখানেও হয়েছে পুনর্বাসন।

এ পর্যন্ত মোট ২৮৭টি পরিবারের আবাসনের ব্যবস্থা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ৫০টি, দ্বিতীয় পর্যায়ে ৯০টি,তৃতীয় পর্যায়ে ৮৬টি ঘর প্রদান করা হয়েছে। চতুর্থ পর্যায়ে আরও ৬১টি ঘর প্রদান করা হবে। তবে চতুর্থ পর্যায়ের ঘরগুলো এখনও হস্তান্তর করা হয়নি,কাজ চলছে।

পরবর্তীতে আরও ঘর নির্মাণের জন্যে খাস জমি সন্ধান এবং মাটি ভরাট কার্যক্রম চলমান। নির্মিত ঘরগুলোর মধ্যে, তৃতীয় পর্যায়ের ৪০টি ঘরের জন্য ৮০শতক জমি ক্রয় করা হয়েছিল। মোট ঘরগুলোর মধ্যে, ঈশ্বরগঞ্জ ইউনিয়নে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে মাঝিয়াকান্দিতে ২৩টি, তৃতীয় পর্যায়ে আশ্রবপুরে ১৬টি এবং সঞ্চারপুরে ৩৫টি ঘর দেওয়া হয়েছে।

সোহাগী ইউনিয়নের মুক্তারপুরে প্রথম পর্যায়ে ১৩টি, দড়িবড়ভাগে তৃতীয় পর্যায়ে ২টি ঘর প্রদান করা হয়েছে। সরিষা ইউনিয়নের মারুয়াখালি এবং খানপুরে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে যথাক্রমে ৮টি ও ১৪টি ঘর দেওয়া হয়েছে। আঠারবাড়ি ইউনিয়নের আঠারবাড়ি গুচ্ছ গ্রামে প্রথম পর্যায়ে ২টি, বিষ্ণুপুরে দ্বিতীয় পর্যায়ে ১০টি, বাহত্তরীর তিনটি স্থানে ১২টি, মাইজবাগ ইউনিয়নের সাধারপাড়ায় দ্বিতীয় পর্যায়ে ৯টি, মগটুলা ইউনিয়নের ধীতপুরে দ্বিতীয় পর্যায়ে ০৪টি ঘর দেওয়া হয়েছে। রাজিবপুর ইউনিয়নের চরপাড়া, লাটিয়ামারি ও ভান্ডারী বাজারে দ্বিতীয় পর্যায়ে যথাক্রমে ৭টি,১৫টি ও ১২টি করে এবং ভাটিরচর নওপাড়া গ্রামে তৃতীয় পর্যায়ে ৫টি ঘর প্রদান করা হয়েছে।

উচাখিলা ইউনিয়নের মরিচারচর গ্রামে প্রথম তিন পর্যায়ে মোট ১৮টি ঘর দেওয়া হয়েছে। তারুন্দিয়া ইউনিয়নের মাটিখোলা এবং রামনগরে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে ৫টি করো মোট ১০টি এবং বড়হিত ইউনিয়নের নওপাড়া ও রঘুনাথপুর গ্রামে প্রথম পর্যায়ে যথাক্রমে ১টি ও ৪টি ঘর প্রদান করা হয়েছে। পৌরসভার শিমরাইল গ্রামে তৃতীয় পর্যায়ে ঘর দেওয়া হয়েছে ৬টি।

ঘরগুলো নির্মাণে ইট,বালি সিমেন্ট,টিন এবং আনুষঙ্গিক জিনিস ব্যবহারে আপোষহীনতা লক্ষ্য করা গেছে। কাজের মান রক্ষায় সর্বোচ্চ নজরদারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রথম দিকের ঘরগুলোতে বাজেট কম থাকলেও ধীরে ধীরে বেড়েছে প্রাক্কলিত ব্যয়। প্রথম পর্যায়ের ঘরগুলোর ব্যয় নির্ধারণ করা ছিল,১লাখ ৭১হাজার এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে এ খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ১লাখ ৯০ হাজারে। তৃতীয় পর্যায়ে ২লাখ ৫৯হাজার এবং চতুর্থ পর্যায়ে ২লাখ ৮৪হাজার।

সরেজমিনে দেখা যায়, বেশিরভাগ আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা হয়েছেন সচ্ছল। থাকার চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে শুধু খাওয়ার চিন্তা করায় কমেছে তাদের দুশ্চিন্তা, বেড়েছে জীবনমান। কেউ কেউ বাড়ির সামনে ঠুনকো জায়গাতেই করেছেন সবজি চাষ। নিজেদের চাহিদা মেটাতে পারছেন সহজেই। কেউ করছেন কবুতর পালন, কেউ হাঁস-মুরগি পালন করে কমিয়েছেন দারিদ্র্যতা।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা কুলসুম বেগম জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর অনেক অসহায় হয়ে পড়েন। ভাড়া বাসায় থাকতেন কোনরকম। স্বামী মারা যাওয়ায় ভাড়া দিতে পারতেন না। শুরু হয় চরম মানবেতর জীবনযাপন। প্রতীবন্ধী ছেলের নামমাত্র আয় দিয়ে চলে সংসার।এমন মহূর্তে সরকারি ঘর পেয়ে অনেক খুশি তিনি। অন্তত একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়ে কৃতজ্ঞতায় চোখ ভিজে আসে তার।

এবিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোসা. হাফিজা জেসমিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের মানুষগুলো আগে বাস্তুহারা ছিল। অন্যের জায়গায় থেকে শুনতে হতো কটুকথা। নিজের মালিকানায় পাওয়া ঘরগুলো মূল ধারার জীবনযাপনে ফিরে আসতে সহায়তা করছে।এতে করে তাঁরা নিজেদের গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে পারছে। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই ঈশ্বরগঞ্জকে ভূমিহীন মুক্ত বলে ঘোষণা করা যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

Leave a Comment

error: Content is protected !!