একমাত্র নারী ভাষা শহীদ

একজন কমলা ভট্টাচার্যকে কতজনে চেনে। যে নারী হয়েও শহীদ হয়েছেন শুধু মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্য। তিনিই একমাত্র নারী শহীদ যিনি ভাষার জন্য জীবনকে ত্যাগ করেছেন।

জানা যায়, কমলা ভট্টাচার্যর জন্ম ১৯৪৫ সালে তৎকালীন আসামের শ্রীহট্টে বর্তমানে সিলেটে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় এক বিতর্কিত গণভোটের মাধ্যমে আসামের শ্রীহট্ট জেলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। যার কারণে কমলাদের পরিবার পাকিস্তানেই থেকে যান।

কিন্তু ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের সার্বিক গণহত্যা আরম্ভ হলে সহিংসতা সিলেটেও এসে পড়ে। এসময় কমলার পরিবার শরণার্থী হিসেবে আসামে চলে আসতে বাধ্য হন। তারা সিলেটের পার্শ্ববর্তী আসামের কাছাড় জেলার শিলচরে এসে আশ্রয় নেন। এক কথায় একের পর এক লড়াই। কখনও ভিটে মাটি, কখনও অস্তিত্ব রক্ষা তো কখনও ভাষার জন্য। যে লড়াই কমলার রক্তেও মিশে যায়।

কমলারা থাকতেন শিলচর পাবলিক স্কুল রোডের একটি ভাড়া বাড়িতে। কমলার বড় দিদি বেণু নার্সের চাকরি পেয়ে শিমূলগুড়ি চলে যান প্রশিক্ষণ নিতে। কমলার মেজ দিদি প্রতিভা ছিলেন শিক্ষিকা। কমলার পরিবার তার মেজদিদির আয়ের উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল। শৈশবে কমলা ভর্তি হন শিলচরের ছোটেলাল শেঠ ইনস্টিটিউটে। ১৯৬১ সালে কমলা ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বসেন। তার ইচ্ছা ছিল পারিবারিক আর্থিক অনটন সত্ত্বেও তিনি স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়বেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষে তিনি টাইপরাইটিং শিখবেন বলে মনস্থির করেন।

ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার ঠিক পরেরদিন শিলচর রেল স্টেশনে মাতৃভাষা অর্থাৎ বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষার দাবিতে একটি পিকেটিংয়ের ডাক দেওয়া হয়। ঐতিহাসিক ১৯ মে`র সকালে কমলা পিকেটিং-এ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন। সকালে স্নান করে মেজদিদির রাখা শাড়িটা পড়ে নেন কমলা। মেজদিদি পিকেটিং-এ যেতে বারণ করলেও শোনেন না কমলা। এমন সময় ২০-২২ জনের একটি মেয়েদের দল কমলাদের বাড়িতে আসে কমলাকে নেওয়ার জন্য।

কমলার মা উদ্বেগ প্রকাশ করলে, তারা কমলার মাকে বুঝিয়ে রাজি করেন। কমলার মা কমলাকে এক টুকরো কাপড় দেন কাঁদানে গ্যাস থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। কমলার সাথে বেরিয়ে পড়েন কমলার ছোট বোন মঙ্গলা, ছোট ভাই বকুল ও বড়দির ছেলে বাপ্পা। দুপুরবেলা কমলার মা দুশ্চিন্তা করতে করতে নিজেই গিয়ে উপস্থিত হন রেল স্টেশনে। বকুল ও বাপ্পাকে একবার পুলিশ ধরেছিল আবার ছেড়েও দিয়েছে। মাকে দেখতে পেয়েই ছুটে আসেন কমলা। মায়ের সমস্ত দুশ্চিন্তা নিবারণ করে মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।

সেদিন সকালে রেল অবরোধ কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবেই সমাধা হয়। যদিও অবস্থানের সময়সূচি ছিল সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা। কিন্তু শেষ ট্রেনটি ছিল বিকেল চারটে নাগাদ। যার পরে গণঅবস্থান স্বভাবতই শিথিল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু দুপুরের পর থেকেই অসম রাইফেলসের জওয়ানরা জায়গাটা ঘিরে ফেলতে শুরু করে। বেলা ২.৩৫ নাগাদ বিনা প্ররোচণায় তারা অবস্থানকারী ছাত্রছাত্রীদের নির্মমভাবে লাঠি ও বন্দুক দিয়ে পেটাতে থাকে।

এলোপাথাড়ি লাঠিচার্জে অবস্থানকারী জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ও দিকবিদিকজ্ঞানশুন্য হয়ে যে যেদিকে পারে পালাতে থাকে। কমলার ছোটবোন মঙ্গলা পুলিশের লাঠির ঘায়ে মাটিতে পড়ে যায়। সাহায্যের জন্য কমলার উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে থাকে। ইতিমধ্যে অসম রাইফেলসের জওয়ানরা জনতার উপর গুলিবৃষ্টি শুরু করে।

মঙ্গলাকে বাঁচাতে কমলা ছুটে গেলে একটি গুলি তার চোখ ভেদ করে মাথা চুরমার করে দেয়। অন্যান্য আহত ও গুলিবিদ্ধ অবস্থানকারীদের সাথে কমলাকেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। মঙ্গলাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এক মাস বাদে তার জ্ঞান ফিরলেও বাকি জীবনটা তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে যান।

Leave a Comment

error: Content is protected !!