করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতে কেন এত ভয়াবহ

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতে কেন এত ভয়াবহ। ভেলোরের ক্রিশ্চান মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজিস্ট গগনদীপ কঙ্গও এই ধারণার সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, ‘ভাইরাসটি এবার হয়ত এমন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়েছে, যারা এর আগে (প্রথম ঢেউয়ের সময়) নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পেরেছে। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে আছে শহুরে উচ্চবিত্তরা, যারা প্রথম ঢেউয়ের সময়ে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রেখেছিল, তবে দ্বিতীয় ঢেউয়ে তা আর সম্ভব হয়নি।’

করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে ব্যাপক সংক্রমণে পর্যদুস্ত ভারত। দেশটিতে টানা নয়দিন ধরে তিন লাখের বেশি মানুষের দেহে এ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। শুক্রবার আগের সব রেকর্ড ভেঙে দৈনিক সংক্রমণ চার লাখ ছাড়িয়ে যায়। শনাক্তের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর দিক দিয়ে গত কয়েকদিনে অন্যান্য দেশকে পেছনে ফেলেছে ভারত।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী সায়েন্টিফিক আমেরিকানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতজুড়ে করোনা সংক্রমণের এই ঝড়ো গতিতে বিস্মিত দেশটির বিজ্ঞানীরা। হঠাৎ ব্যাপক সংক্রমিতের হার তাদের ধাঁধায় ফেলেছে।

ভারতে করোনা আক্রান্তদের চিহ্নিত করতে গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে বড় আকারে একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। দেহে অ্যান্টিবডির উপস্থিতির ভিত্তিতে ওই গবেষণায় অনুমান করা হয়েছিল, বড় বড় শহরের কয়েকটি অঞ্চলে জনসংখ্যার ৫০ ভাগই কোনো না কোনো সময়ে করোনা আক্রান্ত হয়েছে।

গবেষণায় নেতৃত্ব দেন চেন্নাইয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ এপিডেমিওলজির মহামারি বিশেষজ্ঞ মনোজ মুরেকার। গবেষণায় দাবি করা হয়, প্রথম ঢেউয়ে ভারতে ২৭ কোটি ১০ লাখ মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারে, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ।

এই পরিসংখ্যানে নিউ জার্সির প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির মহামারি বিশেষজ্ঞ রামনান লক্ষ্মণারায়ণের মতো অনেক গবেষকই আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। তাদের ধারণা ছিল, বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ায় ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ততটা মারাত্মক হবে না। তবে বাস্তবে তা একেবারেই ঘটেনি।

রামনান লক্ষ্মণারায়ণ বলছেন, ‘এর একটি ব্যাখ্যা হতে পারে, প্রথম ঢেউটি মূলত শহরাঞ্চলের দরিদ্রদের আক্রান্ত করেছিল। ফলে অ্যান্টিবডি গবেষণার ফলটি পুরো জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেনি। দরিদ্রদের বাইরের অন্য গ্রুপগুলো হয়ত অরক্ষিতই থেকে গেছে।’

ভারতের ভেলোরের ক্রিশ্চান মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজিস্ট গগনদীপ কঙ্গও এই ধারণার সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, ‘ভাইরাসটি এবার হয়ত এমন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়েছে, যারা এর আগে (প্রথম ঢেউয়ের সময়) নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পেরেছে। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে আছে শহুরে উচ্চবিত্তরা, যারা প্রথম ঢেউয়ের সময়ে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রেখেছিল, তবে দ্বিতীয় ঢেউয়ে তা আর সম্ভব হয়নি।’

ভারতে গত বছরের সেপ্টেম্বরের দিকে করোনা সংক্রমণ কমতে শুরু করে। চলতি বছরের মার্চের দিকে তা আবার বাড়তে শুরু করে। গত বছরের চেয়ে সংক্রমণ এবার দ্বিগুণেরও বেশি।

ভারতের মুম্বাইয়ে পি ডি হিন্দুজা হসপিটাল অ্যান্ড মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের পালমোনারি মেডিসিনের গবেষক জারির উদওয়াদিয়া বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দেখে মনে হচ্ছে, প্রথমটি বাথটাবে রাখা পানির ছোট ঢেউ ছিল।’

দেশটির হরিয়ানা রাজ্যের সনিপত শহরের অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভায়রোলজিস্ট শহিদ জামিলও করোনার বর্তমান ধাক্কার তীব্রতাকে বিস্ময়কর বলছেন। তিনি বলেন, ‘করোনার নতুন ধাক্কা আসছে, বুঝেছিলাম। কিন্তু তা এতটা শক্তিশালী হবে, স্বপ্নেও ভাবিনি।’

ভারতের কয়েকজন বিশেষজ্ঞের ভাষ্য, ভাইরাসের সংক্রমণের গতি ও মাত্রা হঠাৎ এত কেন বাড়ল, তা বিশ্লেষণ করতে বসলে করোনার নতুন ধরনের দিকেই চোখ যায়।

গবেষক জারির উদওয়াদিয়ার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ, এখন ঘরের কেউ একজন করোনায় আক্রান্ত হলে তার মাধ্যমে পরিবারের বাকি সদস্যরাও সংক্রমিত হচ্ছেন। করোনার প্রথম ধাক্কার চিত্র এমনটা ছিল না। পরিবারে একজনের করোনা পরীক্ষার ফল পজিটিভ এলেও বাকিরা সে সময় এতে বাকি সদস্যরা আক্রান্ত হতেন না।

এর জন্য উদওয়াদিয়া করোনার অতি সংক্রামক নতুন ধরনকেই দায়ী করছেন। তিনি বলেন, ‘পরিবারের কোনো একজনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দিলে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, বাকি সদস্যরাও ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছেন বা হবেন।’

জিনোমিক সারভিল্যান্সের ডেটায় দেখা যায়, যুক্তরাজ্যে প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনার বি.১.১.৭ ধরন ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ধরন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

গত বছরের শেষের দিকে করোনার নতুন আরেকটি ধরন বি.১.৬১৭ ভারতে শনাক্ত হয়। এটি এখন মহারাষ্ট্রে ব্যাপক হারে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। বি.১.৬১৭ ধরনটি বিশ্বজুড়েই এখন উদ্বেগ তৈরি করেছে। কারণ, এর মধ্যে দুটি মিউটেশন রয়েছে যা আগের ধরনের চেয়ে অনেক বেশি সংক্রামক। সেই সঙ্গে এটি মানবেদেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিতে সক্ষম। পৃথিবীর ২০টির মতো দেশে এরই মধ্যে এ ধরনটি শনাক্ত হয়েছে।

ভাইরাস বিশেষজ্ঞ শহিদ জামিল বলেন, ভারতের ল্যাবরেটরিতে করোনার বি.১.৬১৭ ধরন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। ধরনটি কত দ্রুত পুনরুৎপাদিত হয় ও টিকা নেয়া ব্যক্তির রক্ত এর সংক্রমণ ঠেকাতে পারে কি না, তা দেখতে বিজ্ঞানীরা ল্যাবে ধরনটির কালচার করার চেষ্টা করছেন।

তবে করোনার সংক্রমণ মোকাবিলায় স্বাস্থ্যবিধি না মানায় শনাক্তের হার বেড়েছে বলেও মনে করছেন কয়েকজন গবেষক।

দিল্লির পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়ার প্রধান শ্রীনাথ রেড্ডি বলেন, ‘মানুষজন দেখা করছে, বাধাহীনভাবে চলাচল করছে, ভ্রমণ করছে। এসব কারণে সংক্রমণ ফের প্রকট হয়েছে।’

দিল্লির মহামারিবিদ রামানন লক্ষ্মীনারায়ণ বলেন, ‘জনমনে এ ধারণা গেঁথে বসেছিল যে, ভারত করোনাকে হারিয়ে দিয়েছে। এ কারণে গত কয়েক মাসে বিপুল জমায়েত নিয়ে রাজনৈতিক সমাবেশ থেকে শুরু করে ধর্মীয় উৎসব ও বিয়ে অনুষ্ঠান উদযাপন হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘জানুয়ারিতে শুরু হওয়া ভারতজুড়ে করোনার টিকাদান কার্যক্রম সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে ভূমিকা রাখতে পারে। টিকা নেয়ার পর অনেকের মধ্যে এক ধরনের গা ছাড়া ভাব এসেছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তোয়াক্কা করছেন না তারা।’

Leave a Comment

error: Content is protected !!