কৃষি পণ্য ও শ্রমিকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে

কৃষি পণ্য ও শ্রমিকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি প্রধান আমাদের এই বাংলাদেশ যার ৮০ ভাগ সাধারণ মানুষই কৃষি সম্পৃক্ত পেশার মাধ্যমে জীবনজীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই আজ আমরা উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখছি।

কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন কারণে এ পেশায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে সাধারণ মানুষ। এর অনেক কারণের মধ্যে দুটি কারনকে অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এর একটি হলো কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া অন্যটি কৃষি ক্ষেত্রে শ্রমিকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত না হওয়া। প্রথম সমস্যাটির দিকে তাকালে দেখা যায় কৃষক তার জমিতে যে পরিমাণ ব্যয় করে উৎপাদন করছে সে পরিমাণ দাম তার হাতে পাচ্ছে না। আবার সাধারণ জনগণকে চড়া মূল্য দিয়েই কিনতে হচ্ছে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য।

মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্বের কারণে কৃষককের ন্যায্যমূল্য প্রপ্তির যে স্বপ্ন তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এক সময় কেবলমাত্র নিজের প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদন করার ক্ষেত্রে বেশি আগ্রহ দেখা যেত কৃষকদের। সময়ের পরিক্রমায় সে জায়গা থেকে সাধারণ মানুষ এখন অনেক অগ্রসর হয়েছে।

কৃষিকে কৃষক এখন জীবিকার এক নম্বর আসনে নিয়ে এসেছে। যার জন্য কৃষকের এ থেকে পর্যাপ্ত আয়ের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু বাজারে কৃষি পণ্যের মূল্য একেবারেই অস্থিতিশীল । কৃষক যখন পণ্য উৎপাদন করে তার সাথে সাথেই পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হয় দুটি কারনে। একটি হলো উৎপাদিত অনেক দ্রব্য পঁচনশীল হওয়া অন্যটি উৎপাদিত পণ্যের সাথে সম্পৃক্ত শ্রমিকের ব্যয় মিটানো এবং ঋণ শোধ করা। কৃষকের অনেক পণ্য বিশেষ করে উৎপাদিত সবজি সাথে সাথে বিক্রি করতে হচ্ছে।

এছাড়াও কিছু পণ্য সংরক্ষণ করতে না পারার কারণে কৃষক পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে এক্ষেত্রেও কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উৎপাদনের সময় বাজারে যোগানের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় চাহিদার পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে সঠিক দাম পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না এছাড়াও রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ব। কৃষককের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে বাজার ব্যবস্থ্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

আমাদের বাজার ব্যবস্থায় সরকারের যথোপযোযুক্ত নজরদারির অভাব সুস্পষ্ট। কৃষিতে উৎপাদিত পণ্য সমূহকে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাজারজাতকরণের ব্যবস্থাকে একটি কাঠামোতে আনা জরুরি। কৃষি উৎপাদিত পণ্য সঠিকভাবে বাজারে প্রেরণের ক্ষেত্রে কৃষকদেরকে পরিবহনের ও যোগাযোগ ব্যবস্থাতে সার্বিক সহায়তা প্রদান করতে হবে সরকারকে কিন্তু এক্ষেত্রে কৃষকরা সার্বিক সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এ কথা বলা যায়। কৃষি পণ্যগুলো গ্রামেই উৎপাদন হয়ে থাকে যার কারণে পণ্য ভোক্তার নিকট সহজভাবে পৌঁছানো অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না। সবচেয়ে বড়কথা এদেশের কৃষক সমাজ এখনও প্রান্তিক পর্যায়ে থাকায় তাদের জীবনমানের সেভাবে উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি।

এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের নিত্যসঙ্গী। যার ফলে প্রায় সময়ই আমাদের কৃষকদের বিভিন্ন বিপদের সম্মুখিন হতে হয়। সেক্ষেত্রে কৃষকদের আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে স্বাবলম্বী করতে হবে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকদের বিভিন্ন সময় বিভিন্নখাতে প্রণোদনা ও ভর্তুকি প্রদান কৃষক সমাজকে ব্যাপকভাবে প্রফুল্ল করছে এ কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তবে সরকারের সুনজর না থাকার ফলে বাজারে দ্রব্য মূল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলেও তা থেকে বঞ্চিত সাধারণ কৃষক সমাজ। সম্প্রতি দ্রব্যমূল্যের যে পরিমাণে দাম বেড়েছে সে তুলনায় লাভবান হয়নি কৃষক সমাজ।

এছাড়াও রয়েছে আমদানি নির্ভরতা। অনেক পণ্য রয়েছে যা আমাদের দেশে উৎপন্ন হলেও আমদানির কারণে দেশি পণ্য ভালো দামে বিক্রি করা যাচ্ছে না। তার মানেটা হচ্ছে কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণের সঠিক কোনো নীতিমালা নেই। যার ফলে বাজার ব্যবস্থায় একটি অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে সবসময় এবং ক্ষতিগ্রস্থ হয় এদেশের সাধারণ কৃষক। মোট কথা হচ্ছে কৃষির উন্নয়নের জন্য কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা জরুরি। আর এ মূল্য নিশ্চিত করা গেলে কৃষকের জীবনযাত্রার মান এ পরিবর্তন আসবে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ কৃষি উৎপাদন এখনও প্রকৃতি নির্ভর যার ফলে বারবার কৃষকরা ক্ষতির সম্মুখিন হয়ে থাকে। এসব ক্ষতি থেকে কৃষককে বাঁচাতে হলে কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি আরো বৃদ্ধি করতে হবে।

অন্যদিকে এদেশ কৃষি প্রধান দেশ হলেও কৃষি শ্রমিকরা সঠিক শ্রমমূল্য না পাওয়ার কারণে অন্য লাভজনক পেশাকে বেছে নিচ্ছে দিনদিন। যার ফলে ভরা মৌসুমে কৃষি শ্রমিকের সংকট দেখা দেয় অত্যধিক। যদিও বর্তমানে কৃষি যান্ত্রিকিরণের ফলে কৃষি শ্রমিকের চাহিদাও কমে আসছে। যারা প্রান্তিক পর্যায়ে নিজেকে কৃষিকাজে নিয়োজিত রেখেছে অনেকেই বিকল্প পথ না থাকায় এ পেশায় রয়েছে।

কৃষি পণ্যের মূল্য সঠিক রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে কৃষি শ্রমিক। আর বিশেষ করে সবক্ষেত্রে কৃষি যান্ত্রিকিকরণে না হওয়ার ফলে কিংবা না হওয়ার সম্ভাবনা থাকার কারণে মাঠ পর্য়ায়ে ব্যাপক শ্রমিকের ঘাটতি দেখা যায়। দেশে চলমান শিল্পায়নের ফলে দ্রুত কৃষি জমি কমে আসছে এবং বাড়ছে কৃষির নিবিড়তা। আস্তে আস্তে কৃষি জমি কমে আসছে এবং কৃষকরা তাদের জমির মালিকানা ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। এখন কৃষি জমির মালিকানা কৃষকদের কাছ থেকে চলে যাচ্ছে সমাজের বিত্তবানদের হাতে। কৃষি কাজ পারিবারিকভাবে ছোট হয়ে আসছে। একটা সময় নিজের প্রয়োজনই কেবল কৃষি কাজ করা হলেও আজ সময়ের প্রয়োজনে এখন কৃষিতে বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে। কৃষি এখন বাণিজ্যিকিকরণ হচ্ছে অতিমাত্রায়।

জিডিপিতে ব্যাপকভাবে অবদান রাখছে কৃষি। যার ফলে কৃষি এখন আর বর্তমানে নিম্ন স্তরের পেশা হিসেবে নেওয়ার সুযোগ নেই তাই এক্ষেত্রে সরকারের সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া জরুরি। নিজের সবটুকু জমি সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদনের জন্য মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে মানুষ সফল হলেও কৃষি শ্রমিকের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে না। আর বিশেষ করে আমাদের দেশের নারী কৃষি শ্রমিকরা এখনও সেভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে না।

কৃষি কাজের ক্ষেত্রে উৎপাদনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রচুর শ্রম দিয়ে থাকে এদেশের নারী সমাজ। সেক্ষেত্রে বেশির ভাগই সময়ই তাদের শ্রম আর্থিকভাবে নিরুপিত হয় না বা মূল্যায়ণ করা হয় না। যার ফলে এই শ্রম বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে নারীরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলে কিন্তু পারিবারিক কারণে করতে বাধ্য কিন্তু এই শ্রম বাড়ির অন্যান্য কাজের মতোই স্বাভাবিক কাজের মতো বিবেচিত হয়ে থাকে। এইভাবে বিবেচিত হওয়ার ফলে নারীরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় সমাজ ব্যবস্থায়।

শ্রমিক সংকটের ফলে মজুরি বৃদ্ধি পায় যার ফলে বেড়ে যায় উৎপাদন খরচ কিন্তু সে তুলনায় বাড়ে না উৎপাদিত পণ্যের দাম যার ফলে কৃষক সমাজ ক্ষতির সম্মুখি হয়। কৃষক, পণ্যের উৎপাদন, উৎপাদিত পণ্যের দাম ও কৃষি শ্রমিকের চাহিদা এবং শ্রমের মূল্য একটি আরেকটি বিষয়ের সাথে জড়িত এবং এগুলিকে ঠিক রাখার জন্য একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে এটা দৃশ্যমান। সরকারের পক্ষ থেকে অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তবে কৃষি প্রধান দেশে হিসেবে আমাদের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সমন্বিত কর্মসূচী গ্রহণ করা প্রয়োজন। এখনও এদেশের কৃষক সমাজ সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষ হিসেবে তাদের জীবনযাত্রা অব্যহত রেখেছে।

আশার বিষয় হলো সম্প্রতি সময়ে শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা অনেক আশা নিয়ে চাকুরিকে বেছে না নিয়ে কৃষিকে প্রধান পেশা হিসেবে নিচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের কাছে এ পেশাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশা হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হচ্ছে। তাদের এ উৎসাহ যেন হারিয়ে না যায় সে জন্য সরকারকে কৃষি সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো কৃষক সমাজকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। তারা যেন সামাজিকভাবে সম্মানের সহিত বসবাস করতে পারে সেক্ষেত্রে সরকারকে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কারন কৃষি নির্ভর দেশ হলেও কৃষকরা যথোপোযুক্ত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্মান থেকে বঞ্চিত।

লেখক পরিচিতি
প্রভাষক নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার
শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী

Leave a Comment

error: Content is protected !!