গ্রামীণ লকডাউন: আমি গ্রাম থেকে বলছি। গ্রাম্য প্রকৃতির কোলে আমার বেড়ে ওঠা। তাইতো বিধাতার কৃপা পেয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্য লাভ করে বড় হয়েছি।সকল সুখ স্মৃতির মাঝে একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা যুক্ত হলো এই করোনাই। স্বজাতির নিন্দা করছি না শুধুমাত্র আপন আক্ষেপটা একটু লাঘব করছি …
কি আর বলবো, সকল ক্ষোভ যেন সরকারের প্রতি গ্রামের লোকজনদের I কেননা সবসময় মুখের মাস্ক পড়ে রাখতে হয়, আর মাস্ক পড়লে নাকি দম বন্ধ হয়ে আসে । না পারে মাস্ক ছাড়া বাজারে যেতে, না পারে চায়ের দোকানে বসতে,না পারে গল্পগুজব করতে , সকল কিছুর মূলই তো ঐ মাস্ক এর ব্যবহার । অতএব ইহাই সরকারের প্রতি তিক্ততার কারণ । কিন্তু এটা বোঝার চেষ্টা করে না, তাদের করোনা হতে বাঁচাতে রাষ্ট্রই কত ধৈর্যশীলতা, সক্রিয়তা,নিষ্ঠার পরিচয় দিচ্ছে।
গ্রামের লোকজন তো এখনো করোনাকে গুজব মনে করে । বাতাস লাগা, কাক ডাকাকে যদিও এখনো সত্য মনে করে অশুভ ইঙ্গিত মনে করে । লকডাউন প্রেক্ষিতে সবাই তো আরো উৎসুক, বাজারে কি আজ পুলিশ আসছে কিনা? সেজন্য সাথে সাথে একটু আটটু টু মারে বাজারে ।কেউ ঠাট্টা করে যদি বলে পুলিশ আসছে ,এদিকে ওদিকে ছোটাছুটি Iসওদা তো দূরের কথা নিজের লুঙ্গি কি ঠিক জায়গায় আছে কিনা ,তার দিকে খেয়াল নেই I আর বাড়ি গিয়ে গিন্নির সাথে পুলিশের কথা শেয়ার না করলে তো রাতের ভাত হজম হবে নাI
আরো কত গুজব কল্পকাহিনী এবার যা হচ্ছে তা লিখলে হয়তো সম্পাদক সাহেবের পুরো পত্রিকাটি আমার লাগবে। অতএব সম্পাদকের কাগজ বাঁচানো আমার কর্তব্য । আর সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয় হল বাড়ির গিন্নি একটু সচেতন তাইতো জামা দিয়ে কিংবা একটু কাপড়ের টুকরা দিয়ে বানিয়ে দিয়েছে মাস্ক যাতে তার স্বামী পুলিশের যন্ত্রণা থেকে একটু রক্ষা পেতে পারে। এখন হয়তো মাস্ক বানানোর কাজটা তেমন হয়ে উঠে না। কারন ৫ টাকায় মাস্ক কিনা যায়। অতএব গিন্নিকে কষ্ট দেওয়া যুক্তি সংগত না। ক্রয় করা মাস্কটি কোন অনাদিকালে সে ক্রয় করেছিল তা বোধ হয় তার স্মরণ করা কষ্টকর হয়ে পড়বে। সর্বোপরি, মাস্ক তো লাগবেই।কারণ পুলিশ তো মাস্ক না দেখলে মার দিবে।
যাইহোক, স্বজাতিকে এত নিন্দে করলে স্বজাতিই হয়তো আমার দিকে তেড়ে আসবে। মাস্কের কথা এবার রাখি। আরেকটি বলি, বাপ চাচা বলে গ্রামে করোনা নাই, দাদা বলে গুজব। সত্যি অবাক করার মত কথা। অবাক তো তারাই হবে ,যারা কিনা কখনো গ্রামের সংস্পর্শে আসে নি । কিংবা মাঝে মাঝে আসে তাও আবার অল্পক্ষণের জন্য । কিন্তু আমার মত গ্রামীণ জনপদে বসবাস করা মানুষের কাছে যেন কথাটা স্বাভাবিক বিষয়।
মাঝে মাঝে আমার আশেপাশের লোকজনকে উৎসাহের বশে কথোপকথন করি করোনা নিয়ে। যখন জানতে চাই বাবা- চাচার বয়সের লোকজনের কাছে করোনা নিয়ে ।তখন মৃদু হাসি দিয়ে বলে,” গ্রামে করোনা নাই ।” নানা ধরনের অযথা যুক্তিও কলাগাছের মত সামনে দাড় করে। যদি একটু বুঝাতে চাই করোনাকে নিয়ে । তাহলে বেয়াদব হয়তো তখনই বনে যাব । সাথে কিছু নীতিকথাও শুনবো। তাই সেদিকে আর পা বাড়াই না। কিন্তু জমে উঠে দাদার বয়সী লোকজনের সাথে। করোনা নিয়ে যখন কিছু বলি, তখন দাদার বয়সী লোকেরা বলে ,” করোনা তো গুজব ।” এমন ভাবে বলে যেন স্বচক্ষে সাক্ষী সে। এমন আজগুবি কথা শুনে যদিও তারুণ্যের রক্ত ক্ষেপে উঠে ।
কিন্তু কিছু আর করার থাকে না। তাদেরকে বোঝানো যেন হেঁটে হেঁটে মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার মত দুঃসাধ্য কাজ। আমার তো আবার মঙ্গল গ্রহে হেঁটে হেঁটে যাওয়ার ইচ্ছা নাই। মাঝে মাঝে একা একা ভাবি, গ্রামে এমন অসচেতনতার কারণ কি? হয়তো ক্ষুদ্র জ্ঞানে বোধ করি এদেরকে সঠিকভাবে জানানোর অভাব । সেই সাথে ধর্মীয় উপসনালয়ে করোনা নিয়ে সচেতনমূলক কথাবার্তা বলার অভাব । পূর্বেই বলেছি, ছোটবেলা থেকেই গ্রামাঞ্চলে বেড়ে ওঠার প্রেক্ষিতে একটু বাড়তি অভিজ্ঞতা কাজ করে গ্রামীণ মানুষের জীবনযাপন নিয়ে। সে অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। অতি স্বল্প সময়ে দেশে করোনা টিকা প্রদানের পদক্ষেপ সত্যিই প্রশংসার যোগ্য সরকার। তেমনি তা নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জিংও বটে।সারাদেশে ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে করোনার টিকা প্রদান কর্মসূচি।
যেখানে দেশের অধিকাংশ মানুষেরই করোনা টিকা নিয়ে স্বচ্ছ ধারণার ঘাটতি রয়েছে, সেখানে সামান্যতম স্বচ্ছ ধারণা নেই বললেই চলে অধিকাংশ জনগোষ্ঠী গ্রামীণ মানুষগুলোর। কানকথা, মনগড়া বিভিন্ন আলাপচারিতায় ভ্যাকসিন মানুষের কাছে এখন এক ভীতিকর নাম বললেই চলে। বিশেষ করে টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে মানুষের কাছে রয়েছে মনগড়া ধারণা। এ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সরকারের জন্য করোনা টিকা নিশ্চিত করা কষ্টকর হয়ে পড়বে । এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রয়োজন সরকার ও স্থানীয় সামাজিক সংগঠনগুলোর সক্রিয়তা ও কার্যকরী পদক্ষেপ। গ্রামাঞ্চল মানুষের মাঝে স্বচ্ছ ধারণা প্রেক্ষিতেই সম্ভব করোনা টিকা অনেকাংশে নিশ্চিত করা। তাহলেই একদিন করোনা এই দেশ তথা বিশ্ব থেকে নির্মূল করা সম্ভব হবে। আর এটাই প্রত্যাশা।
সবকিছু সমাধান হোক, ফিরে আসুক সেই সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। যেখানে থাকবে না করোনায় মৃত পিতার কাছে সন্তানের না যাওয়ার ঘটনা। থাকবেনা কোন আতঙ্ক। প্রত্যাশা করি সেই আগামী শুভদিনের ।
এবার নিজের কথা বলি ।ওদেরকে সচেতন ও তার কথা বলেই, আমি আজ নিজেই এখন কটাক্ষের শিকার ।তাই তো নিজেই নিজের আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। এটা কি আর লাভ হবে, যদি না থাকে সম্মিলিত সচেতনতা?
শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ,
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়