জেনে নিন কৈশোরের শুরু আর শেষ কখন

কৈশোর বা কৈশর (ইংরেজি: Adolecence) হল শৈশব থেকে যৌবনে পদার্পণ করার মধ্যবর্তী দশা| এ সময় জুড়ে বিভিন্ন রকম শারীরিক পরিবর্তন ঘটে এবং আকস্মিক হরমোনের পরিবর্তনের কারণে মানসিক আবেগের তীব্রতার উত্থান পতন ঘটে থাকে, যা বয়ঃসন্ধি নামে পরিচিত।

বয়ঃসন্ধিকালের পূর্বে নিষ্ক্রিয় থাকা হাইপোথ্যালামাস এ সময় হঠাৎ করে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সাধারণত ডোপামিন, গ্লুটামেট ও সেরেটোনিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার হরমোন এ আবেগীয় পরিবর্তনে প্রধান ভূমিকা রাখে এবং পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত টেস্টোস্টেরন ও ইস্ট্রোজেন হরমোন এবং গ্রোথ হরমোন কৈশোরকালীন শারীরিক বিকাশ ও যৌন আচরণকে সক্রিয়করণে কাজ করে। ভৌগলিক অবস্থান ভেদে কৈশোরের ব্যাপ্তির তারতম্য দেখা যায়।

কৈশোরকালের বয়সসীমা নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনার সময় বুঝি চলে এসেছে। এত দিনের প্রতিষ্ঠিত ধারণা অনুযায়ী কৈশোর শুরু হয় ১৩ বছর বয়স থেকে। আর প্রাপ্তবয়সে পদার্পণ ঘটে ১৯ বছর বয়সে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, এই ধারণা পরিবর্তনের সময় চলে এসেছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী ল্যানসেট চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডলসেন্ট হেলথ-এ এ-বিষয়ক একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কৈশোর এখন শুরু হয় ১০ বছর বয়সে। আর তা ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত স্থায়ী হয়। দেরিতে বিয়ে এবং বিলম্বে সন্তান নেওয়ার কারণে এমনটা হচ্ছে। তবে এই তত্ত্ব অনুসরণ করলে প্রাপ্তবয়স্ক তরুণেরা অবমূল্যায়িত হতে পারেন বলে সতর্ক করে দিয়েছেন আরেক দল বিশেষজ্ঞ।

গবেষণায় বলা হয়েছে, যে বয়স থেকে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অংশ পিটুইটারি ও গনাডাল গ্রন্থিকে সক্রিয় করতে বিশেষ হরমোন নিঃসরণ শুরু করে, তখন থেকেই বয়ঃসন্ধির শুরু। সাধারণত ১৪ বছর বয়স থেকে এই হরমোন নিঃসরণ শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা আর পুষ্টির কারণে বেশির ভাগ উন্নত দেশে তা শুরু হচ্ছে ১০ বছর বয়স থেকে। বিশ্বের অর্ধেক নারীর ক্ষেত্রেই এখন ঋতুস্রাব শুরু হয় ১২ অথবা ১৩ বছর বয়সে।

বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন, মস্তিষ্কের পরিণত হওয়ার কার্যক্রম ২০ বছর বয়সের পরও চলতে থাকে। বহু মানুষের আক্কেলদাঁত ২৫ বছর বয়সের পর গজায়।

গবেষণা নিবন্ধটির মূল লেখক অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে অবস্থিত রয়্যাল চিলড্রেনস হসপিটালের কিশোর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক সুসান সয়ার। তাঁর মতে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে কৈশোরের বয়সসীমা ১০ বছর থেকে ২৪ বছর হওয়াই যুক্তিযুক্ত।

তবে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টের সমাজবিজ্ঞানী জ্যান ম্যাকভারিশ এই তত্ত্বের সঙ্গে একমত নন। তিনি বলেন, কিশোর আর তরুণের কাছে সমাজের প্রত্যাশা আলাদা। এ ক্ষেত্রে তাদের সহজাত দৈহিক বৃদ্ধি অগ্রগণ্য নয়।

বয়ঃসন্ধিতে কিশোর-কিশোরীদের দৈহিক পরিবর্তন কেন ঘটে?

শৈশব পেরিয়ে তারুণ্যে পা রাখার আগে প্রতিটি ছেলে-মেয়ের দেহে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় যা তাকে পরবর্তীতে প্রজননক্ষম পূর্ণাঙ্গ পুরুষ বা নারীতে পরিণত হতে সাহায্য করে। কিন্তু অজ্ঞতার কারণে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখে না কিংবা ভুল ধারণার জন্ম দেয়। কোনোভাবেই তারা বুঝতে চান না যে এটা একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা। যা পৃথিবীর প্রতিটি নারী-পুরুষের জীবনে ঘটে থাকে। এখনো কি বলবেন বয়ঃসন্ধিতে শারীরিক পরিবর্তনের জন্য কিশোর-কিশোরীরা দায়ী?

বয়ঃসন্ধি কী?

ছেলেদের ক্ষেত্রে সাধারণত ১২ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে পরিলক্ষিত হলেও মেয়েদের বেলায় পরবির্তনের সময়কালটা কিছুটা আগে। সাধারণত ১১-১২ বছর বয়সে একজন মেয়ে তার দেহে পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে তা ৮-৯ বছরেও দেখা দিতে পারে। অনেকের আবার কিছুটা দেরিতে যেমন ১৩ বছর বয়স থেকে শারীরিক পরিবর্তন আসে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় দেহে বিশেষ হরমোন নিঃসরণ শুরু হওয়ার ফলেই এই শারীরিক পরিবর্তন আসতে শুরু করে।

কেন ও কীভাবে হয়?

ছেলে মেয়ে উভয়ই একটা বয়সে উপনীত হলে মস্তিষ্ক গোনাডোট্রপিন (জিএনআরএইচ) নামক হরমোন নিঃসরণ শুরু হয়। এই হরমোন দেহের পিটুইটারি গ্রন্থিতে এসে আরো দুটি হরমোন নিঃসরিত করে যা রক্তস্রোতে মিশে দেহে নতুন উদ্দীপিনা সৃষ্টি করে। হরমোনজনিত এই প্রক্রিয়া একই হলেও এই হরমোনগুলো ছেলে ও মেয়ের দেহের ভিন্ন ভিন্ন অংশে কাজ করে। এর ফলে দেহে যৌন উদ্দীপনা সৃষ্টির পাশাপাশি বিপরীত লিঙ্গ (কখনো কখনো সমলিঙ্গ) এর প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়। ছেলেদের ক্ষেত্রে পুরুষাঙ্গের বৃদ্ধির পাশাপাশি কন্ঠস্বরে পরিবর্তন কিংবা ঠোঁটের উপর গোঁফের রেখা লক্ষ্য করা যায়। মেয়েদের ক্ষেত্রে নিয়মিত রজঃস্রাব আরম্ভ হওয়ার পাশাপাশি স্তনসহ শরীরের আকৃতিগত পরিপূর্ণতা আসে।

কীভাবে কিশোর-কিশোরীদের দেহে ও মনে প্রভাব ফেলে?

ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের দেহে ও মনে বয়ঃসন্ধিজনিত পরিবর্তনের প্রভাব বেশি। শৈশবের নির্ভেজাল সময় পেরিয়ে এসে হঠাৎ এই শারীরিক পরিবর্তন মোকাবেলার মানসিক শক্তি অর্জন করা অনেক মেয়ের জন্যই দুরহ হয়ে পড়ে। এর সঙ্গে যদি যোগ হয় রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থা তবে তা যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘাঁ। শারীরিক এই পরিবর্তন সম্পর্কে আগে থেকে পরিষ্কার কোনো ধারণা না থাকায় বয়ঃসন্ধির প্রথম দিকটায় এদেশের অধিকাংশ মেয়েদেরই বেশ বিব্রতকর সময় পার করতে হয়। শহরাঞ্চলে এই বিষয়টি নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলেও গ্রামীন জনপদে অবস্থাটা এখনো শোচনীয়।

অভিভাবকদের অনাগ্রহ, সঠিক শিক্ষা এবং তথ্যের অভাবে এসব অঞ্চলের মেয়েরা বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে প্রচন্ড মানসিক চাপের মধ্যে থাকে। এর সঙ্গে ঋতুস্রাবের মতো শারীরিক উপসর্গের কারণে অধিকাংশ কিশোরীর মনে অজানা ভয় কাজ করে। মনের মধ্যে নানা ভয় এবং প্রশ্নের উদ্রেকের ফলে কিশোরীর আত্মবিশ্বাসের পারদটা যে তলানিতে গিয়ে ঠেকে তা বলাই বাহুল্য।

এছাড়া এই সময়টায় ছেলে এবং মেয়ের উভয়েরই আচরণ এবং আবেগীয় পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যায়। বয়ঃসন্ধি নিয়ে মনে নানা সংকোচ এবং চিন্তাধারায় পরিবর্তনের কারণে নিয়মিত পরিবর্তিত আচরণ দেখা যায়। অনেক সময় অল্পতে রেগে যাওয়া কিংবা খিটখিটে মেজাজও লক্ষ্য করা যায়। এই সময়টায় ব্যক্তি নতুনরুপে আত্মপ্রকাশ করে বলে আত্মমর্যাদাবোধও বেড়ে যায়। এর ফলে অল্পতেই প্রতিক্রিয়া দেখানোটাও স্বাভাবিক আচরণে পরিণত হয়। এছাড়া অন্য কারো সাথে নিজের শারীরিক গঠনের তুলনা করে বা অন্যের আচরণ নকল করতে গিয়ে হতাশায় ডুবে যায় তারা।

কী করা উচিৎ?

বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে। অথচ এ সময়টায় অভিভাবকদের সঙ্গ সবচেয়ে বেশি দরকার। এই সময়টায় বন্ধু বা সঙ্গ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অসৎ সঙ্গের পাল্লায় পড়ে পর্নোগ্রাফি এবং ইভ টিজিংয়ের মতো বিকৃত কাজে লিপ্ত হয় অনেক কিশোর। উভয় লিঙ্গের ক্ষেত্রে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণের অক্ষমতার কারণে আত্মবিধ্বংসী কাজে লিপ্ত হওয়ার প্রবণতাও দেখা যায়। তাই সন্তানকে বন্ধুর মত বোঝাতে হবে যে এটা শুধুই একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। এই সময়ে কিশোর-কিশোরীরা আবেগ অনেক বৃদ্ধি পায়। তাই শুধু বকাঝকা না করে সঠিকভাবে তাকে সামনের দিনগুলোর জন্য উৎসাহ দিতে হবে। আর কখনোই মনে করা যাবে না এই শারীরিক পরিবর্তনের পেছনে অন্য কোনো বিষয় রয়েছে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!