পুরুষ মস্তিষ্কের অনুরণে ধর্ষণ সমাচার

নিকট অতীত কালে নির্লজ্জ কিছু তান্ডব আর হিংস্রতায় মানবতার উৎকন্ঠা, আত্মচিৎকার ও ভীত সন্ত্রস্ততা দেখে ধর্ষণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিজ্ঞানের বর্ণনা অনুধাবনের আগ্রহ জাগে। পেশাগত কারনে অপরাধ বিজ্ঞানের সাথে পরিচিতি ঘটে। তাই অপরাধবিজ্ঞানীদের মতে অপরাধ প্রবনতা এবং সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে ধর্ষণের প্রবনতা বৃদ্ধির কারন পড়তে সাহস করেছি।

প্রকৃতিঘেরা জনপদে শৈশব কৈশোর কাটানোর কারনে মানুষের মৌলিক জীবনাচরণ দেখেছি একেবারে কাছথেকে। অস্বাভাবিক মানসিকতার নৃতত্ত্ব তুলে ধরার চেষ্টা কিছুটা।

জগদ্বিখ্যাত সমাজ-মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলেছিলেন, আদিম-অবাধ যৌনাচার প্রথার ওপর সমাজ বিধি-নিষেধ আরোপ করতে পেরেছিল বলেই মানুষের সমাজ আদিম খোলস ছেড়ে, বন্য-বর্বর জীবন ছেড়ে সভ্যতার জন্ম দিতে পেরেছিল। যে সভ্যতা এখনও বহমান। এ রকম একটি তত্ত্বকে মাথায় রেখেই বলা যায়, অবাধ যৌনাচার রোধে সমাজ আরোপিত ‘শাস্তি-বিধান’ এবং সমাজ-সৃষ্ট ‘লোক-লজ্জার ভয়’—এ দু’টি কারণেই পুরুষ সভ্য হওয়ার অবিরাম চেষ্টা চালিয়েছে।

প্রাচীন-সমাজ গবেষকদের ধারণা—আদিম যুগে ধর্ষণ ছিল না, কারণ অবাধ যৌনাচার পর্বে পুরুষের ধর্ষণের দরকার হয়নি। সভ্যতার সূচনালগ্নেই ধর্ষণের উপস্থিতি। এ সূচনা পর্বে তাই প্রায় সব নারী হয়ে উঠল ‘সভ্য’ আর পুরুষের ছোট একটি অংশ রয়ে গেল ‘অসভ্য’, ‘অর্ধ-সভ্য’, ‘কৃত্রিম-সভ্য’ এবং অধিকাংশ হয়ে উঠল ‘সভ্য’।

যৌনতাড়না বা যৌনাচরণ যারা স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম তারাই ‘অসভ্য’, আর যারা মাঝে-মধ্যে এসব অনিয়ন্ত্রিত আচরণে অভ্যস্ত তারা ‘অর্ধ-সভ্য’, যারা এসব আচরণ নিয়ন্ত্রণের নামে নানা কৌশল অবলম্বন করে সম্ভাব্য ধর্ষকের তালিকা এড়িয়ে থাকে তারা ‘কৃত্রিম-সভ্য’ এবং বাকিরা সভ্য স্বাভাবিক ভদ্রলোক বলে পরিচিত।
পুরুষের ‘কৃত্রিম-সভ্য’ রূপই আধুনিক সমাজের মূলধারার পুরুষের প্রধান চারিত্রিক রূপ।

আদিম এবং কৃত্রিম দুটি রূপই পুরুষের মধ্যে যুগপৎভাবে বিরাজমান। সেই থেকে আদিম-বনাম-কৃত্রিম এই দুই সম্পূরক চারিত্রিক রূপের অদল-বদলই একটি পুরুষের তাবৎ-জীবনের যৌনাচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। পুরুষ তার আদিম এবং কৃত্রিম খোলসকে সভ্যতার মুখোশ দিয়ে ঢেকে রেখে সমাজের চোখে ‘ভালো-মানুষ’ সাজে। আসলে প্রায় অধিকাংশ পুরুষের মধ্যে এই মুখোশ-রূপটি ঘাপটি মেরে থাকে। যে যত এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সে তত ভালো মানুষ সমাজের চোখে, যাকে বলা যায় ‘কলঙ্কের ভয়ে’ ভালো মানুষ সেজে থাকা।

সমাজ এই ‘ভালো-মানুষ’ নামক উপাধি আবিষ্কার করতে না পারলে পৃথিবী নামক সভ্যতাটি হয়ত সামনের দিকে এগুতে পারতনা।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য—শতভাগ নারীই যে সভ্য এমন দাবি করলে সত্যকে অস্বীকার করা হবে, কারণ নারীরাও লক্ষণীয় মাত্রায় নানা অপরাধে জড়িয়ে আছে। নারী কর্তৃক চুরি, ডাকাতি, খুন ইত্যাদি নিয়মিত ঘটনা।

ফ্রয়েডিয়ান তত্ত্ব মতে, পুরুষ তার আশে-পাশে কোনও নারীর উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রই তার সমস্ত নগ্ন শরীর সে কল্পনা করে ফেলে মুহূর্তেই, নারীও পুরুষকে দেখলে এ রকম চিন্তা করে। তবে বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রমাণ করে যৌনচিন্তার ধরন, চিন্তা-প্রসূত তাড়না এবং তাড়না-উদ্ভূত কর্ম-প্রক্রিয়া নারী-পুরুষের মধ্যে ভিন্নভাবে বিরাজমান এবং ক্রিয়াশীল। আর এই ভিন্নতা জনিত কারণেই প্রায় সব পুরুষ একজন সম্ভাব্য শক্তিমান কামুক।

নারী-পুরুষের মধ্যে যৌন-তাড়না থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই তাড়না মাত্রা ছাড়ালেই সেখানে ধরা পড়ে কদর্য। তাই পুরুষ যখন নারীর কাছে পরিচিত বা স্বল্প পরিচিত তখন অনেক ক্ষেত্রেই সে ছলে-বলে, কলে-কৌশলে, লোভ-দেখিয়ে নারীকে যৌন-কর্মে-সম্মতি প্রদানে প্রলুব্ধ করে বা বিভিন্ন কৌশলে অঙ্গভঙ্গি সাজসজ্জা করে আগ্রহের কথা জানান দেয় । কৌশলে লক্ষ্যে পৌছতে না পারলে জোর ক্ষমতা ও বলপ্রয়োগ করার স্বীদ্ধান্তের দিকে ধাবিত হয়।সমাজে পুরুষের একটি অংশ এই শ্রেণিভুক্ত।

একটি শ্রেণি দৈহিক, পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয়, পারিপার্শ্বিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ নানা ধরনের অক্ষমতা বা প্রতিকূলতার কারণে এ কর্ম থেকে বিরত থাকে। অন্য একটি গোষ্ঠী সদা ওঁৎ পেতে থাকে সুযোগের অপেক্ষায়। বাকি একটি অংশ যারা নিজেদের রিপুকে দমন করতে পারে, তারা এসব থেকে বিরত থাকে। মনে রাখতে হবে ষড়রিপু তথা কাম-রিপুকে দমনে রাখার নামই সভ্যতা, ভদ্রতা, তদুপরি ভালো মানুষের সমস্ত গুণের আধার। পৃথিবীর প্রায় সব সমাজের বেলায় এ সত্য প্রযোজ্য। সমাজের বৃহৎ পরিসরে যৌনচিন্তা তথা ধর্ষণচিন্তা পুরুষের মাথায় ঘুরপাক খায়ওয়ার কারন গুলোর মধ্যে নারীর অনিন্দ্য কমনীয় ‘সামাজিক সৌন্দর্য্য’
একটি অন্যতম কারণ।

নারীর মনোজগতের প্রভাব

পুরুষের ‘কৃত্রিম-সভ্য’ রূপ একটি নারীই ভালো জানে, বিশেষ করে একটু সুন্দরী নারী। কারণ সে আন্দাজ করতে পারে তার পরিধির যত চেনা, অল্প চেনা, অচেনা পুরুষ আছে তারা কে কেমন? তারা আসলে কে কী চায়? একটু সুযোগ পেলেই কে আগে, কে একটু পরে তাকে, তার শরীরকে পেতে চাইবে, সে ভালো করেই জানে। একটি মেয়ে সমাজে বেড়ে ওঠে এই জানা-অজানা ভয় নিয়েই।

তাকে নিজের সঙ্গে সীমাহীন ‘আপস-যুদ্ধ’ করে পথ চলতে হয়। যেকোনও সময় যেকোনও বিপদের ভয়ে তার প্রতি নানা ধরনের যৌন-সহিংসতাকে সে চোখের জলে লুকিয়ে রেখেই পথ চলে। এক নারী থেকে অন্য নারীর দিকে পুরুষের যৌন-রথ ধাবিত হয় নিঃসংকোচে নিরন্তর। এমনকি কাছের কারও দ্বারা ধর্ষণের ঘটনা সে বেমালুম চেপে যায় সমাজের ভয়ে, লোক-লজ্জার ভয়ে।

নারী যদি পুরুষের এসব যৌন-সহিংস আচরণের বিরূদ্ধে জোর প্রতিবাদ করতে পারতো পুরুষ ভয়ে হলেও নারীকে সম্মান করতে শিখত এবং পুরুষের ধর্ষক হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশেই হ্রাস পেত। কিন্তু নারী এটা করতে পারছে না কেন? কেন গোপন-রাখা ধর্ষণের হার পৃথিবীব্যাপী এত বেশী? নারীর না বোধক আচরণ কি সমাজের শান্তি বজায় রাখতে? নাকি নিজের সমূহ বিপদের আশঙ্কা কমাতে? নাকি পরিচিতদের সম্মান রক্ষার্থে? নিজে ভিকটিম হয়েও কেন সে পুরুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে না? এসব প্রশ্নের গবেষণালব্ধ কোনও উত্তর আমার আপাতত জানা নেই। তবে জানার বলা খোজার চেষ্টা অবির।

Leave a Comment

error: Content is protected !!