নকল পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের ভয়াবহ সিন্ডিকেট

নকল পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের ভয়াবহ সিন্ডিকেট, ৩৬ পাসপোর্টধারীর ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে ক্লিয়ারেন্স তৈরির তথ্য। নকল পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের একটি ভয়াবহ সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এ সিন্ডিকেটে দুজন পুলিশ সদস্যের নামও বেরিয়ে এসেছে। পুলিশ সদস্যরা সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যদের যোগসাজশে নিজস্ব আইডি ব্যবহার করে ২০২০ সালের ১ জুন থেকে গত বছর ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত অসংখ্য পুলিশ ক্লিয়ারেন্স তৈরি করেছেন। রাজধানীর উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর রোডের আলাউদ্দিন টাওয়ারের ১২ তলায় অবস্থিত আই টাচ ট্যুরিজমে এসব পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট তৈরি হতো।

অনলাইন আবেদনের মাধ্যমে পাওয়া পাসপোর্টের ঠিকানা পরিবর্তন করে অন্য ঠিকানা দিয়ে ক্লিয়ারেন্স বের করা হতো। অন্তত ৩৬ জন পাসপোর্টধারীর ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে নকল পুলিশ ক্লিয়ারেন্স তৈরির পর গত বছর ৩০ জানুয়ারি উত্তরায় অভিযান চালায় সিআইডি। এ সময় সাহেল শরীফ মুন্না, জানে আলম ও আল আমীন হাওলাদার নামে তিনজনকে গ্রেফতার করে সংস্থাটি। এ ঘটনায় পরদিন উত্তরা পশ্চিম থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা হয়।

মামলায় আরও চারজনকে পলাতক দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে আল মামুন ও কোরবান আলী নামে দুজন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। বাকিরা হলেন- ফয়সাল ও সবুজ। মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, মুন্না ও আল আমীন হাওলাদারকে প্রথমে সিআইডি কর্মকর্তারা ভুয়া পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তারা তা অস্বীকার করেন।

এরপর প্রাপ্ত প্রযুক্তিগত তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করলে তারা তা স্বীকার করেন। তাদের দেওয়া তথ্যে মাদারীপুরের কালকিনি থেকে জানে আলমকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান, মৌলভীবাজার সদর থানার দুজন পুলিশ সদস্য আল মামুন ও কোরবান আলীর সহায়তায় অনলাইনে আবেদন করা পাসপোর্টধারী ব্যক্তিদের ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সংগ্রহ করেন। এমনকি মুন্নার ই-মেইল আইডিতেও ৩৬ জন পাসপোর্টধারীর ভুয়া ঠিকানা ব্যবহারের তথ্য পাওয়া গেছে। আলাউদ্দিন টাওয়ারের ১২ তলায় অবস্থিত আই টাচ ট্যুরিজম অফিস তল্লাশি করে ১৪টি বাংলাদেশি পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়।

মামলার এজাহারে পাওয়া আল মামুনের মোবাইল নম্বরে ফোন দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। পরে কোরবান আলীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, তিনি মোলভীবাজারে কর্মরত নন। তিনি কর্মরত আছেন ঝিনাইদহে। তবে তিনি ভুয়া পুলিশ ক্লিয়ারেন্স তৈরির বিষয়ে কিছুই জানেন না। 

এ মামলার তদন্ত তদারকিতে থাকা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার জিয়াউর রহমান জানান, মামলাটির তদন্ত এখনো চলছে। যে দুজন পুলিশ সদস্যের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে তাদের একজনের একটি প্রতিবেদন তারা পেয়েছেন, আরেকজনের প্রতিবেদন এখনো পাননি। 

তবে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এ ভুয়া পুলিশ ক্লিয়ারেন্সে লাখ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। এর সঙ্গে ঢাকার বাইরের দুজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর এক নারীর সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গিয়েছিল।

সূত্র জানায়, বিভিন্ন সরকারি দফতরের ভুয়া সিল ও স্বাক্ষর ব্যবহার করে জাল পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট প্রস্তুতকারী প্রতারক চক্রের একজনকে গত বছর ১২ এপ্রিল রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকা থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। 

গ্রেফতার ওই ব্যক্তির নাম মো. রবিউল ইসলাম (৪৫)। এ সময় তার কাছ থেকে বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপারের (ডিএসবি) ১৯০টি সিল, ১৯০টি বিভিন্ন থানার গোল সিল, ১৭৬টি বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সিল, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চারটি সিল, ১০টি বৈদেশিক আরবি সিল, ৫৪০টি জাল পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট, বিএমইটি কোর্সের সার্টিফিকেট তৈরির কাজে প্রস্তুতকৃত পেপার ৩২০টি, আটটি জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ট্রেনিং সিলসহ যাবতীয় কাগজপত্র জব্দ করা হয়। 

এর আগে ২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর রাজধানীর ফকিরাপুলে অভিযান চালিয়ে ৫৮ জেলার এসপি, ৫৯ থানার ওসির নকল সিল, ৫৭৭টি সিলসহ ১ হাজার ৪৫০ পিস ভুয়া পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট জব্দ করে ডিবি পুলিশ। এ সময় আবদুল বারেক, আকাশ, সাব্বির হোসেন, শহীদুল হক মিজান ও মোরশেদ ভূঁইয়া নামে পাঁচজনকে আটক করা হয়।

Leave a Comment

error: Content is protected !!