প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় সরকারের গুরুত্ব বাড়ানো অপরিহার্য

প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় সরকারের গুরুত্ব বাড়ানো অপরিহার্য। আমরা সকলেই শুনে ও জেনে এসেছি শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। শুধু পড়া ও শুনা নয় এটাই বাস্তবতা যে শিক্ষা ছাড়া মানুষ ও জাতি সবই অচল। শিক্ষার প্রাথমিক এবং মৌলিক ধাপ হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা যেখান থেকে মানুষের শিক্ষা জীবন শুরু।

আর এই শুরুর ক্ষেত্রে যদি ভিত শক্ত না হয় তাহলে ব্যক্তি তথা রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় অন্ধকার নেমে আসবে এটাই স্বাভাবিক এবং চিরন্তন। কিন্তু আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা কি দেখছি? সম্প্রতি প্রাথমিক স্তরে সরকারি প্রথিষ্ঠান গুলোতে সরকারের বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরও সে হারে শিক্ষার্থী বাড়ছে না বরং দিনদিন কমে আসছে।

আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলার প্রারম্ভে এর ঘাটতি বিষয়গুলো আগে তুলে আনা প্রয়োজন।

নানা সমস্যায় জর্জরিত আমাদের এ প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা। তবে সে সমস্যা অনেকাংশেই সমাধানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এ কথা সত্য। বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অভিভাবকদের মাঝে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রয়েছে শিক্ষক সংকট আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে রয়েছে শিক্ষক তবে কাম্য শিক্ষার্থী সংকট। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে প্রাথমিক স্তরে ঝড়ে পড়া অনেকটাই রোধ হয়েছে এটা সত্য। কিন্তু এ শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে না সমস্যা।

প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থায় বর্তমানে রয়েছে বিভিন্ন ধারা। এর মধ্যে অন্যতম হলো কিন্ডারগার্টেন ও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। আবার মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে বিভিন্ন ধাঁচের। সম্প্রতি করোনাকালে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থী সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে গ্রাম পর্যায়ে প্রাথমিক স্কুল থেকে প্রচুর পরিমাণে শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় স্থানান্তর হয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের অনীহার কারণে প্রতিদিনই শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে। এটি আমাদের সরকারি প্রাথমিক শিক্ষার জন্য চরম ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু কেন এভাবে শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে এদিকে সরকারের নজর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

বিশেষ করে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলাদাভাবে ভাবতে হবে সরকার কে। প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষক নিয়োগ, যত্রতত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও শিক্ষায় সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা এদের মধ্যে অন্যতম। প্রচুর পরিমাণে অবকাঠামো নির্মাণ ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগের পর শিক্ষা ব্যবস্থায় মূল লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি কিন্তু কেন ? প্রথমেই আসা যাক শিক্ষক নিয়োগে প্রসঙ্গে। সরকার প্রতিনিয়তই শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে একথা সত্য।

মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থায় বাস্তবায়নে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষক। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ দিতে হলে প্রয়োজন শিক্ষকদের একটি ভালো মানের বেতন ব্যবস্থা। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেটি আমরা দিতে পারছি কিনা ? বর্তমান সময়ে ২০১৯ সালের নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী নিয়োগের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

বিধিমালা অনুযায়ী সহকারী শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা নিরুপন করা হয়েছে স্নাতক বা সমমান এবং বেতন গ্রেড ১৩তম ( ১১০০০-২৬৫৯০) এবং প্রধান শিক্ষকরা একই শিক্ষাগত যোগ্যতা সাপেক্ষে ( ৬৫% পদোন্নতি ও ৩৫% সরাসরি ) নিয়োগের মাধ্যমে ১০ (১৬০০০-৩৮৬৪০) গ্রেড প্রাপ্য হবেন। সহকারী শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ( মহিলা ৬০%, পোষ্য ২০% ও অবশিষ্ট ২০% পুরুষ) কোটার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান দেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই বেতন স্কেলে আদৌ ভালো মানের শিক্ষার্থীকে আমরা এ পেশায় আকৃষ্ট করতে পারবো কি ? প্রশ্নের উত্তর কি হবে তা জানি না তবে এটুকু বলা যাবে যে কাজটা হচ্ছে না। শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করতে হলে শিক্ষকদের মানোন্নয়ন ব্যাতিত শিক্ষার পরিবর্তন সম্ভব নয়।

শিক্ষকদের মানোন্নয়ন বলতে আমরা সাধারণত বুঝি আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্মান বৃদ্ধি। কিন্তু কোনটাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে অর্জিত হচ্ছে না। এখনও বেশিরভাগ চাকুরি প্রত্যাশী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার চেয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের করণীক হওয়ায় গৌরববোধ করেন। বর্তমান বেতন কাঠামো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তৃতীয় শ্রেণিতে পরিণত করেছে এ কথা অসত্য নয়।

তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ণ করা শিক্ষার্থীরা এ জায়গায় আসতে রাজি নয়। ভালো মেধার আগমন না ঘটলে ভালো মেধা তৈরি হবে না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। শিক্ষা একটি সম্মানজনক পেশা হওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় সম্মান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষকরা। এই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে অন্যান্য পদে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের আরো উপরের বেতন কাঠামোতে অর্ন্তভূক্ত করা হলেও শিক্ষকরা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। বর্তমানে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজের পাহাড় জমে থাকে।

সরকারের মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা ছাড়াও বিভিন্ন কাজকর্মের সাথে যুক্ত রাখা হয় এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের। যার ফলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন শিক্ষকরা। যার ফলে পাঠদানে বিঘ্ন ঘটে। প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি করে করণীকের পদ সৃষ্টি এখন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে।

এছাড়াও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই চতুর্থ শ্রেণির যে পদটি সৃজন করা হয়েছিল তা থেকেও সুফল পায়নি অনেক প্রতিষ্ঠান কারন প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ হলেও সকল নিয়োগ হওয়ার পূর্বেই থেমে যায় এ প্রক্রিয়া। এছাড়াও স্কুল পর্যায়ে এত পরিমাণে কাজ থাকে যেসব কাজে প্রায় সময়ই অর্ন্তভূক্ত হতে হয় সহকারী শিক্ষকদের আর প্রধান শিক্ষকরা সপ্তাহের বেশি সময় জুড়েই অবস্থান করে থাকে উপজেলা সদরে। অনেক সমালোচনার পরও একথা পুরুষ শিক্ষকদের মুখ থেকে শুনা যায় যে, অতিরিক্ত মহিলা শিক্ষক নিয়োগ হওয়ার ফলে পাঠদান ও স্কুলের আনুষাঙ্গিক কার্যক্রম বাধা প্রাপ্ত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সহকারী শিক্ষকদের প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজ থেকে মুক্ত করে ক্লাসে মনোযোগী করা একান্ত প্রয়োজন।

এছাড়াও সহকারী শিক্ষা অফিসারের শুন্য পদ পূরণ এবং পদ সংখ্যা বৃদ্ধি করে স্কুল পরিদর্শনের ব্যবস্থা বাড়ানো প্রয়োজন। প্রন্তিক পর্যায়ের স্কুলগুলোতে পরিদর্শনের পরিমাণ খুবই কম। শিখন পদ্ধতি আরো আধুনিকায় এবং শিক্ষকদের অধিকতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। দ্বিতীয় ধাপে যে বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে তা হলো যত্রতত্র নিয়ম নীতি না মেনে কিন্ডারগার্টেন ও মাদ্রাসা স্থাপন করা।

এ বিষয়ে সরকারের কোন মনিটরিং ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। সরকারি স্কুল গুলোতে সকল শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, বিনা বেতনে অধ্যায়ণ ছাড়াও বিশেষ সুযোগ দেওয়ার পর কাম্য শিক্ষার্থী অর্জিত হচ্ছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এমনকি অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তার সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রেখে ক্লাস করাচ্ছেন কিন্ডারগার্টেএ। ভাববার বিষয় যে অনেক অভিভাবক এমন কি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তার সন্তানদের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খাতায় নাম এন্ট্রি করে উপবৃত্তির টাকা নিচ্ছে কিন্তু ক্লাস করাচ্ছেন কিন্ডারগার্টেনে। এতে করে সাধারণ মানুষের মাঝে অনেক প্রশ্ন জন্ম নিচ্ছে।

সাধারণ মানুষের মাঝে প্রশ্ন উঠছে শিক্ষার মান নিয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক কম মেধাবিরাই কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতা করছে। তারপরপর মোটা অংকের ফি ও বেতন দিয়ে কিন্ডারগার্টেনে পাঠাচ্ছি আমাদের সন্তানদের আমিও এর বাইরে নই। আমাদের আশা সরকারির চেয়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা ভালে। এমনকি মাদ্রাসা শিক্ষাতেও বেতনের বিনিময়ে পড়াচ্ছি আমাদের সন্তানকে। ভাববার বিষয় এত সুবিধা দেওয়ার পর কেন আমাদের সন্তানদের সরকারি ব্যবস্থাপনার প্রতি আগ্রহী হচ্ছি না। মোট কথা ভালো ও সুন্দর ব্যবস্থাপনা এবং ধর্মীয় শিক্ষা লাভের আশায় আমরা নজর দিচ্ছি ভিন্ন দিকে।

এ অবস্থায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গতি ধরে রাখার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষকের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তৃতীয় হচ্ছে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি । এই কমিটি থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা সত্যিকার অর্থে কি পাচ্ছে তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়।

এসব কমিটি ব্যবস্থাপনা বাতিল নতুবা সময়োপোযোগি করা একান্ত অপরিহার্য। শুধু সমালোচনা নয় এগিয়ে যেতে হবে সুন্দর ও সুষ্ঠ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে আমরা কেবল উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছি। এখানে সরকারের আর্থিক সক্ষমতাও একটি বড় বিষয়। অন্যদিকে সরকারকে এসব অর্থ খরচ হিসেবে না ভেবে বিনিয়োগ হিসেবে ভাবতে হবে।

বর্তমানে আর অবকাঠামোর দিকে নজর না দিয়ে মানোন্নয়নের দিকে নজর দেওয়া একান্ত অপরিহার্য। বারবার কারিকুলাম পরিবর্তন না করে অন্যান্য দেশের সাথে তালমিলিয়ে আধুনিক একটি পাঠ্যসূচী প্রণয়ন করা একান্ত অপরিহার্য। আমরা সেদিনের স্বপ্ন দেখে যেদিন দেশের মেধাবীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আগ্রহী হবে এমন একটি পরিবেশের সৃষ্টি হবে যার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা নির্মিত হবে।

নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার
লেখক পরিচিতি
শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী

Leave a Comment

error: Content is protected !!