হাসিমুখে ফিরে যাক অতিথি পাখি -হাসনা বেগম।

হাসিমুখে ফিরে যাক অতিথি পাখি -হাসনা বেগম। হেমন্তের ফসলশূন্য রিক্ত মাঠে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে আগমন ঘটে শীতকালের। সঙ্গে নিয়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি। আকাশের দিকে তাকালে দেখা মেলে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখি। এদের আগমন ঘটে উত্তর মেরু থেকে।

পৃথিবীর উত্তর মেরু অঞ্চলের দেশ সাইবেরিয়া, আসাম, ফিলিপস, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ফিনল্যান্ড, অ্যান্টার্কটিকা, চীনের লাদাখ অঞ্চলে তাপমাত্রা যখন মাইনাস শূন্য ডিগ্রিতে নেমে আসে, তখন এ অঞ্চলগুলোতে দেখা দেয় প্রচণ্ড খাদ্যাভাব। তীব্র শীতে পাখির দেহ থেকে পালক খসে পড়ে, তুষারপাত হয়।

প্রকৃতি যখন পাখিদের জীবনধারণের জন্য অনুকূলে থাকে না তখন এরা অপেক্ষাকৃত কম শীত ও অনুকূল প্রকৃতির দেশে অতিথি হয়ে আসে। নাতিশীতোষ্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রতি বছর সাদরে গ্রহণ করে নেয় এ সকল অতিথি পাখিকে। এ দেশ হয়ে ওঠে অতিথি পাখির খাদ্য ও জীবনধারণের নিরাপদ আবাসস্থল।

সৃষ্টিগতভাবে পাখিদের শারীরিক গঠন খুবই মজবুত। তাই অতিথি পাখিরা ৬০০ থেকে ১৩০০ মিটার উঁচু আকাশসীমা পাড়ি দিয়ে উড়ে আসতে পারে অবলীলায়। কিছু পাখি বছরে প্রায় ২২ হাজার মাইল পথ অনায়াসে পাড়ি দিয়ে চলে আসে এই বাংলায়।

প্রাণিবিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশে ৭৪৪ প্রজাতির পাখি দেখা যায়। এর মধ্যে ৩০১টি বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করে বলে এদের ‘আবাসিক’ পাখি বলা হয়। খণ্ডকালীন সময় নিয়মিতভাবে আসে ১৭৬ প্রজাতির পাখি, যা বাংলাদেশের অতিথি পাখি হিসেবে অবিহিত। এ দেশে অতিথি পাখির আগমন ঘটে সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর সময় পর্যন্ত। তবে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি এই দুই মাসে সব থেকে বেশি পাখি আসে এ দেশে। অতিথি পাখিদের কিচিরমিচিরে মুখরিত থাকে বাংলার প্রকৃতি। এক মোহনীয় রূপ ধারণ করে বাংলাদেশের হাওড় অঞ্চলগুলো।

১৯৮০ সাল থেকে মিরপুর চিড়িয়াখানার হ্রদে অতিথি পাখির দেখা মিলছে। অতিথি পাখির দেখা মিলছে বাংলাদেশের নীলফামারীর নীলসাগর, নিঝুম দ্বীপ, হাকালুকি হাওর, বরিশালের দুর্গাসাগর, সিরাজগঞ্জের হুরা, টাঙ্গুয়ার হাওর, হাটল হাওর ও সোনাদিয়াতেও।

এছাড়া অতিথি পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য স্থান। শীতের প্রকোপ কমে গেলে অতিথি পাখিরা আবার ছুটে চলে নিজ জন্মভূমিতে। বাংলাদেশে অবকাশ যাপনের ইতি ঘটিয়ে আপন ভূমিতে যাওয়ার জন্য আবারও হাজার মাইল পাড়ি দেয় তারা।

বিদেশি পাখির এভাবে আমাদের দেশে এসে বিভিন্ন অঞ্চলের শোভাবর্ধন করা, প্রাকৃতিক পরিবেশকে বৈচিত্র্যময় করে তোলার ঘটনা অতি আনন্দের বিষয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, দেশের কিছু অসাধু ব্যক্তি বিভিন্ন সময় অতিথি পাখি শিকার ও হত্যা করে থাকে।

শিকারিরা ফাঁদ, জাল তৈরি করে প্রস্তুত থাকে শীতের আগে থেকেই। বিভিন্ন উপায়ে তারা শিকার করে অতিথি পাখিদের। এমনকি বিভিন্ন চরাঞ্চলে বিষ প্রয়োগ ও নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দিয়েও তাদের শিকার করা হয়। কেউ কেউ আবার মাছের ঘেরে ফাঁকা জায়গায় দেশি হাঁস পানির ওপর জড়ো করে রাখে, পাখি হাঁসের ডাক শুনে পানিতে নামতেই তারা আটকে যায় শিকারিদের পেতে রাখা ফাঁদে।

শিকারিদের ফাঁদে পড়ে প্রতি বছরই অতিথি পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এভাবে প্রতি বছর অতিথি পাখি নিধন হতে থাকলে প্রকৃতি হারাবে তার নিজস্ব রূপ, বিলুপ্তি ঘটবে বহু পাখি প্রজাতির। তাই আমাদের সবার উচিত, অতিথি পাখিদের নিরাপত্তা দানে মানবিক হওয়া।

সর্বোপরি, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে স্থানীয় প্রশাসনকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সর্বোপরি, নিরাপত্তার জন্য এ দেশে এসে অতিথি পাখির নির্বিচার শিকারে পরিণত হওয়ার ঘটনা নিতান্ত পীড়াদায়ক।

লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Comment

error: Content is protected !!