বিজয় আবেশে তারুণ্য দীপ্তির উত্থান

বিজয় আবেশে তারুণ্য দীপ্তির উত্থান- শেখ সায়মন পারভেজ হিমেল। তারুণ্যশক্তি শুধুমাত্র তরুণ বয়সকে ঘিরেই বর্তমান বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। তারুণ্যশক্তি যেকোনো বয়সে যেকোনো সময়ে উত্থান ঘটতে পারে । তারুণ্য দীপ্তি তথা তারুণ্যশক্তি বয়সভেদে নয় বরং মনের বয়সেই বিবেচ্য।

উদাহরণস্বরূপ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নির্মলেন্দু গুণ এত বয়সের দ্বারপ্রান্তে এসে লেখনীর মাধ্যমে যে তারুণ্য দীপ্তি প্রদর্শন করছে তা কেবল “চিরতরুণ” বলেই সংজ্ঞায়িত করাই যথেষ্ট নয়। তাদের তারুণ্যশক্তি বর্তমান তরুণদের মাঝেও সর্বত্র পরখ করা যায় না। অতএব বয়সের নয় বরং মনের তারুণ্য দীপ্তিকে কেন্দ্র করে আজকের আলোচনার আরম্ভ।

” বিজয়” শব্দটি তিনটি অক্ষরে হলেও , শব্দটির পেছনে কত সংগ্রাম, কত ত্যাগ- তিতিক্ষা, কত বেদনা, কত প্রিয়জনের জীবন উৎসর্গ লুকায়িত, তা কেবল উপলব্ধি করার বিষয়। মাঝে মাঝে আমার কল্পনার রাজ্যে আমি ভাবি আমি যদি মুক্তিযোদ্ধা হতাম আর গাজি বেশে নিয়াজীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় স্বচক্ষে দেখতাম। কিংবা শহীদ হয়ে বাংলার মাটি পানি বাতাসের সাথে মিশে যদি জন্মভূমির শ্রেষ্ঠ সন্তান হতাম। তাহলে হয়তো তখন এই দুনিয়ার স্বর্গতুল্য প্রশান্তি অনুভব করতাম এবং আমার স্বজনেরা আমার অনুপস্থিতিতে ভক্তি কান্নার সুযোগ পেত বটে। তারাও হয়তো নিজেদের ধন্য মনে করতো, বংশে একজন শহীদ পেয়ে আমার বংশের লোকেরা হয়তো ধন্য হতো।

যাই হোক, সে সুযোগ বিধাতা না দিলেও ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আবেশে সৃষ্ট তারুণ্যশক্তি সুপ্ত লুকিয়ে থাকা দেশপ্রেমকে আন্দোলিত করে । মুক্তিযোদ্ধারা নানান বয়সের হলেও তারুণ্যের শক্তিতে সকলের এক বিন্দুতে সমাগম আর স্বদেশ প্রেম শক্তির মাধ্যমে বিজয়ের পতাকা বহনকারী হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা আমরা শিক্ষা নিতে পারি। এটাই জীবনের সার্থকতা । আর এই সার্থকতার প্রেক্ষিতে দেশ জাতি আজও তাদের মনে রাখছে, মনে রাখবে চির অনন্ত কাল। বিজয়ের আবেশ তাদের মাধ্যমে আমাদের মাঝে বহমান হয় ,আন্দোলিত হয়। বিজয় দিবসে সকল শহীদদের, গাজীদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি রইল।

মুক্তিযুদ্ধ দেখার সৌভাগ্য হয়নি নবীন প্রজন্মের। কিন্তু বিজয়ের আবেশ পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমাদের। সেই আবেশ পাওয়া নবীন প্রজন্মের কাতারে বসে লিখে যাচ্ছি আজকের কবিতা। যে কবিতার শিরোনাম তারুণ্য দীপ্তি আর প্রতিটি অক্ষর হল একেকটি নেওয়া হয়েছে শহীদের স্বদেশপ্রেমের জাগ্রত তারুণ্যের শক্তি থেকে । আর কবি হলাম আমরা সকল নবীন প্রজন্ম। আর ১৬ ডিসেম্বর মাসেই এই কবিতার জন্ম হয়।

কেননা যখনই বিজয়ের মাস আসে তখন দেহ-মন-প্রাণে এক নব স্বদেশ প্রেম ও তারুণ্য জোয়ার আসে আর সেই জোয়ার খোরাক যোগায় তারুণ্যশক্তির । উৎসাহ দেয় নতুন কিছু দৃষ্টান্ত করার প্রত্যয় । আর এই তারুণ্য শক্তির জোয়ার পৃথিবীর সকল অন্যায় অবিচারকে এমন ভাবে আছাড় মারতে পারে যার প্রভাবে এই অন্যায় অবিচার দুর্নীতি নিঃশেষ করা সম্ভব। আর প্রাপ্ত সুফল ভোগ করবে প্রতিটি জনগণ। অনাগত উত্তরসূরিদের জন্য রেখে যেতে পারি এক নতুন পৃথিবী। যেমনি করে আমাদের পূর্বপুরুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা প্রকৃতিতে প্রাণভরে প্রশ্বাস নিতে পারছি, যার প্রতিটি সেকেন্ড এক একটি স্বস্তির উপন্যাস।

এখন আমাদের তারুণ্যশক্তির জাগরণ ঘটনো হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পেছনেই গল্পের দিকে তাকাতে হবে। কেননা বাহ্যিক দৃষ্টিতে আমরা অনেকেই সাফল্যকে দেখি, কিন্তু সাফল্যের পেছনের গল্প দেখিনা। পেছনে গল্পকে যে যত বেশি নিজের মাঝে ধারণ করতে পারবে সে তত বেশি সফলকাম হবে ও দিনশেষে বিজয়ের মুখ দেখবে। মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের একটি দিক উল্লেখ করি।

১৯৭০ সালের ১৫ ই মার্চ ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনার উদ্দেশ্য ঢাকায় আসেন। তার কদিন পর ২২ শে মার্চ জুলফিকার আলী ভুট্টোও ঢাকায় আসেন। অর্থাৎ ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করেন ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো এটাই, ২৩ শে মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস। আর এই প্রজাতন্ত্র দিবসে পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যেক ঘরে ঘরে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার বদলে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।

কত সাহস !কত স্বদেশ প্রেম! কত স্বাধীনতাকামী ! কত তারুণ্যশক্তি! এটাই প্রমাণ করে বাঙালির জাতির বীরত্বের কথা। জালিম শাসকের সামনে দাঁড়িয়ে “জয় বাংলা “স্লোগান দেওয়ার উদাহরণে যথেষ্ট প্রমাণ আমাদের সাহসের, বীরত্বের কথা। আমরা তো সেই জাতিরই উত্তরসূরী। আমরা সেই চেতনার অংশ। আমাদের রক্তে মিশে আছে সেই শহীদদের ,সেই গাজীদের বীরত্ব সাফল্য গাঁথার গল্প।

স্মরণ করতে হবে সেই সকল বীর শহীদদের গাজীদের কথা। আমাদের মাঝে বিজয় একাত্তরের তারুণ্য দীপ্তির গণজোয়ার সৃষ্টি করতে পারি। এই তারুণ্য দীপ্তিকে আমাদের মাঝে স্থায়িভাবে রূপান্তরিত করতে পারি। এই তারুণ্য দীপ্তির আন্দোলন হবে সকল প্রকার অন্যায় দুর্নীতি দুঃখ-কষ্ট বিরুদ্ধে। সমাজে কত অন্যায় অবিচার। কত কুসংস্কারে নিমগ্ন আছে জাতি। তাদের কষ্ট দুর্দশার কথা এখনো আমাদের কানে কি পৌঁছায় না? জাতি হিসেবে এই ধিক্কার আমাদের নতুন প্রজন্মের। দেশের এক প্রান্তে নিস্তব্ধ প্রকৃতির মাঝে লুকায়িত বাঘবিধবাদের জীবন লোনা পানির বেহুলা উপমার মতো জীবন জলাঞ্জলি হচ্ছে। আর নোনাজলের বেহুলাদের মহাভারত সমতুল্য দুঃখ-দুর্দশা, কুসংস্কারের কথা এখনো আমাদের অজানা।

ভাবতে অবাক লাগে আমরা কি সেই মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরী? আমরা কেন সমাজের খবর রাখি না, অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায় না? তাহলে আমাদের মাঝে কিসের অভাব? কেন এই স্বাধীন দেশে দুঃখ-দুর্দশা অন্যায় অবিচার? অভাব হল আমাদের চেতনার। আমাদের চেতনা জাগ্রত হয়না। আমাদের চেতনাকে আমরা সীমাবদ্ধ রেখেছি। শুধুমাত্র বিজয় দিবসে একটি দিনকে কেন্দ্র করে মাল্যদান কার্যে আমরা সীমাবদ্ধ ।আমরা যদি আমাদের দেশের সেইসব মহান ব্যক্তিত্বদের মর্যাদা না দেই, তাহলে দেশে কোনো মহান ব্যক্তির জন্ম হবে না। আমাদের যথেষ্ট কদর দিতে হবে, যাদের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা।

বিজয়ের সাফল্যচেতনা সারাবছর আমাদের আঁকড়ে ধরে রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। তারুণ্য দীপ্তিকে ছড়িয়ে দিতে হবে নবীন প্রজন্মের শিরা উপশিরায়। প্রতিটি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস যেন বিজয় আবেশে তারুণ্য দীপ্তিতে উচ্চারিত হয় সেই মূলমন্ত্র “জয় বাংলা”।

লেখক:
শেখ সায়মন পারভেজ হিমেল
শিক্ষার্থী
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Comment

error: Content is protected !!