বিনা চিকিৎসায় বিছানায় দিন কাটে রিমুর!

বিনা চিকিৎসায় বিছানায় দিন কাটে রিমুর! একসময় খেলাধুলা ও হইহুল্লোড় করে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখত চঞ্চলপ্রকৃতির মেয়ে রিমু। কিন্তু এখন তার নেই সেই চাঞ্চল্য ভাব। খেলতে পারে না কোনো খেলা। চিৎকার-চেঁচামেচির বদলে থাকে নীরব হয়ে। তার মুখে নেই কোনো হাসি। নেই ছোটাছুটি করার ক্ষমতাও। কারণ, রোগাক্রান্ত হয়ে সে এখন শয্যাশায়ী। দীর্ঘদিন ধরে শুয়ে শুয়ে নিদারুণ যন্ত্রণায় দিন পার করতে হয় তাকে।

নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটী ইউনিয়নের ফচিকা গ্রামের সিএনজি অটোরিকশাচালক তারেক মিয়ার মেয়ে রিমু আক্তার। সে স্থানীয় বালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। বর্তমানে তার বাবা আরেকটি বিয়ে করে সেই সংসার নিয়ে বসবাস করেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, জরাজীর্ণ একটি ঘরের এক কোণে চৌকিতে শুয়ে আছে ১১ বছর বয়সী রিমু। তার কপালজুড়ে অতিরিক্ত মাংস বেড়ে পচন ধরে গেছে। সেই পচন থেকে পুঁজ বের হচ্ছে এবং দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কিন্তু অর্থের অভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাটুকুও করাতে পারছে না তার হতদরিদ্র পরিবার। তার মুখ থেকে কেবল বের হয়ে আসছে মরণযন্ত্রণার চিৎকার ও বেঁচে থাকার আকুতি।

পরিবার ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তিন বছর আগে রিমু তার নানার বাড়ি একই জেলার বারহাট্টা উপজেলার পাটলী গ্রামে বেড়াতে যায়। সেখানে পাটলী গ্রামের পাশে রেললাইনে স্থানীয় শিশুদের নিয়ে খেলাধুলা করছিল সে। তখন একটি শিশু রেললাইনে থাকা পাথরের টুকরা ছুড়ে মারলে তা রিমুর কপালে লাগে। এতে সে আহত হয়। স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই আঘাত লাগা স্থান থেকে বিন্দু বিন্দু কিছু মাংসের গুটি বের হয়।

এ অবস্থায় রিমুর হতদরিদ্র পরিবার এলাকাবাসীর সহায়তায় তাকে প্রথমে নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতাল ও পরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়। কোনো উন্নতি না হলে একপর্যায়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরে সেখানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে রিমুর কপালের অতিরিক্ত মাংস অপসারণ করা হয়।

এরপর সুস্থই ছিল শিশু রিমুর দিন। এভাবে বছরখানেক অতিবাহিত হওয়ার পর আবারও তার কপালজুড়ে অতিরিক্ত গুটি গুটি মাংস বাড়তে থাকে এবং অর্থের অভাবে হতদরিদ্র পরিবারটি দীর্ঘদিন ধরে শিশুটির চিকিৎসা করাতে না পারায় অতিরিক্ত মাংসপিণ্ড রিমুর দুচোখ ও নাক ঢেকে ফেলেছে। এখন দুচোখেও দেখতে পায় না।

এদিকে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা রিমু আক্তারকে সুস্থ করে তুলতে এলাকার লোকজন দফায় দফায় সহায়তা প্রদান করলেও স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা অসহায় এ শিশুটির কোনো রকম খোঁজখবর নিচ্ছেন না বলে প্রতিবেশীরা ক্ষোভ জানিয়েছেন।

আরও দেখা গেছে, অসহ্য যন্ত্রণায় সারাক্ষণ বিছানায় পড়ে ছটফট করছে রিমু। হাত দিয়ে খাবার খেতে পারলেও যন্ত্রণার কারণে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে বিরক্তি ভাব প্রকাশ করছে। পরতে পারে না কোনো জামাকাপড়।

ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রতিবেশী মতিউর রহমান বলেন, রিমুর চিকিৎসার জন্য আমরা কয়েকবার সহযোগিতা করেছি। তার চিকিৎসার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে টাকা সংগ্রহ করেছি। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের এখন পর্যন্ত রিমুর পাশে দাঁড়াতে দেখিনি। এটা খুবই দুঃখজনক। গরিব পরিবারের এই অসহায় শিশুটিকে বাঁচাতে চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে অচিরেই তাদের এগিয়ে আসারও অনুরোধ জানান তিনি।

ফচিকা গ্রামের বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম মাসুম বলেন, আগে আমরা গ্রামবাসীসহ এলাকার মানুষের কাছ থেকে অর্থসহায়তা নিয়ে রিমুর চিকিৎসা করিয়েছিলাম। কিন্তু বর্তমানে তার অবস্থা খুবই খারাপ। উন্নত চিকিৎসা করাতে হবে। আর তা করানো রিমুর পরিবার ও আমাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, অসহায় রিমু আক্তারের জীবন রক্ষার্থে চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য নেত্রকোনা সদর আসনের এমপি সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আশরাফ আলী খান খসরু ও নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক কাজি মো. আবদুর রহমানের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।

রিমুর দাদি বৃদ্ধ সাবেদা আক্তার বলেন, আমার একটামাত্র ছেরা (ছেলে) তারেক মিয়া। সিএনজি চালায়। ঘরো ছেরার বউ হাফিজা আক্তার, নাতি তৌহিদ হাসান, নাতনি রিমু আক্তার এবং আমিসহ পাঁচজন মানুষ। কিন্তু ছেরাডা আরেকটা বিয়া কইরা আমরারে ফালাইয়া তইয়া গেছেগা। অসুস্থ মেয়েডারও কোনো খবর নেয় না।

তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমরা গরিব মানুষ। মাইনষের বাড়িত কামকাজ কইরা খাই। নাতিডা মরতাছে। কপালডা পচতাছে। চোখ দুইডাও নষ্ট অইয়া গেছে। টেহার লাইগ্গে চিকিৎসা করাইতাম পারতাছি না। দয়া কইরা আপনেরা আমার নাতিডারে বাঁচায়া দেওহাইন।

একই আকুতি জানিয়ে রিমুর মা হাফিজা আক্তার বলেন, রেললাইনও খেলতে গিয়া কপালে পাথরের ঢিল খাইয়া আইজ আমার মায়াডা (মেয়ে) মরণের পথও। টেহা নাই। এক বছর ধইরে চিকিৎসা করাইতে পারতাছি না। আমি মা অইয়া মায়াডার এই যন্ত্রণা আর সহ্য করতা পারতাছি না।

কয়েক মাস আগে অবশ্য রিমুকে চিকিৎসার জন্য শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু করোনার কারণে তারা ভর্তি করতে পারবে না বলে ফিরিয়ে দিয়েছে।

এমনটা জানিয়ে হাফিজা আক্তার বলেন, সেই থাইক্কাই বিনা চিকিৎসায় বাড়িতে আমার মায়াডা ভুগতাছে। সে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। কিছুদিন আগে স্কুল থাইকা নতুন বই দিছে। কিন্তু আমার মায়াডাতো বিছানাতো উঠতই পারে না। স্কুলে যাইব কেমনে বলেই তিনি অঝোরে কাঁদতে শুরু করেন হাফিজা।

এ বিষয়ে কাইলাটী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, অসুস্থ রিমু আক্তারের উন্নত চিকিৎসার বিষয়ে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু মহোদয়ের সঙ্গেও কথা বলেছি। আশা করি, অচিরেই ঢাকায় নিয়ে তার চিকিৎসা করানো সম্ভব হবে।

এদিকে অসুস্থ শিশু রিমু আক্তারের উন্নত চিকিৎসা সহায়তার আহ্বান জানিয়ে ২১ মে ফেসবুকে একটি লাইভ করেন পথশিশু সেবা ফাউন্ডেশনের সভাপতি মো. খায়রুল ইসলাম নামে এক সমাজকর্মী। কিন্তু দুদিন অতিবাহিত হতে চললেও এখনো অসহায় রিমুর পাশে দাঁড়ায়নি কেউ।

পথশিশু সেবা ফাউন্ডেশনের কার্যকরী কমিটির সভাপতি মো. খায়রুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমি শিশুটির এই অসহায় অবস্থা দেখার পর তাকে নিয়ে ফেসবুকে একটি লাইভ দিয়েছিলাম। কিন্তু এতে আশানুরূপ কোনো ফল পাইনি। কেউ যদি এগিয়ে না আসেন, তাহলে আমরা সংগঠনের উদ্যোগে রিমুর চিকিৎসার ব্যবস্থা করব।

এ বিষয়ে নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক কাজী মো. আবদুর রহমান বলেন, আমরা অসুস্থ শিশু রিমু আক্তারের খোঁজখবর নিয়ে তার চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

Leave a Comment

error: Content is protected !!