মহারথী হাসন রাজা প্রয়াণের শত বছর

মহারথী হাসন রাজা প্রয়াণের শত বছর। ‘লোকে বলে বলে রে, ঘর বাড়ী ভালা নায় আমার/ কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার/ ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর/ আয়না দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার।’

আমাদের দেশে বাউলগানের দুটি ঘরানা আছে। একটি নদীয়াকেন্দ্রিক, অন্যটি ভাটি অর্থাৎ হাওর অঞ্চলকেন্দ্রিক। দুই অঞ্চলে ছিলেন দুই মহারথী। নদীয়ায় লালন আর হাওর অঞ্চলে হাসন। বাউল ঘরানার গানের যে বিশাল ভান্ডার, তার একদিকে আছেন লালন, অন্যদিকে হাসনসহ ভাটি অঞ্চলের অন্য মহাজনেরা। লালন-হাসন এবং তাঁদের শিষ্য ও ভাবশিষ্যদের গানের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলা গানের এক বিরাট অংশ।

প্রতাপশালী জমিদার দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী ও হুরমত জাহান দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান দেওয়ান হাসন রাজা কেন বিবাগী হয়েছিলেন, তার অনেক ব্যাখ্যা আছে, অনেক গল্পও আছে। সেসব গল্পের গরু চরে বেড়াক সুরমা নদীর তীরে কিংবা দেশজুড়ে। আমরা বরং আজ এই পুণ্যতিথিতে হাসন স্মরণ করি।

স্মরণ করি, ভাটির দেশে এক মহাজন ছিলেন, প্রভূত সম্পদ আর ভোগবিলাসের জীবন ছেড়ে যিনি একদিন বিবাগি হয়েছিলেন। গান বেঁধেছিলেন, গেয়েছিলেন এবং গাইয়েছিলেন বাংলার মানুষকে। সুরমা নদী, হাওরের বিপুল জলরাশি আর এই সবুজ বাংলাদেশ তাঁর সুরের সেই ইন্দ্রজাল ছিন্ন করতে পারেনি আজও। কী পবিত্রতম জন্ম, কী উজ্জ্বল প্রয়াণ!

আজ হাসন রাজার শততম প্রয়াণবার্ষিকী। এই ডিসেম্বর মাসেই জন্ম হয়েছিল তাঁর। আবার শূন্যের মাঝে ঘরও বানিয়েছিলেন এই ডিসেম্বরে। তাঁর জন্ম ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর। আর মৃত্যু, আজ থেকে ১০০ বছর আগে, ১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বর।

সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়া এলাকায় সুরমা নদীর কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে হাসন রাজার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি। এটি এখন সুনামগঞ্জের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। বাড়িটিকে জাদুঘর বানিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে সাধক হাসনের ব্যবহৃত কুর্তা, খড়ম, তরবারি, পাগড়ি, ঢাল, থালা, বই এবং নিজ হাতে লেখা কবিতা ও গানের পাণ্ডুলিপি। এসব দেখে হাসনকে খানিক বোঝার চেষ্টা করা যায়। খানিক খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা যায়, মরমি হাসন কতটা রক্ত-মাংসের মানুষ ছিলেন; কিংবা বোঝার চেষ্টা করা যায়, কোন গভীর দর্শন বোঝার চেষ্টা করেছিলেন তিনি জীবনের একটা অংশে এসে।

সেখান থেকেই হাসন রাজার ভক্তদের দাবি জাদুঘরটির সংস্কার করা। নইলে চলছে না। কারণ, গত বন্যায় এর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মূল্যবান জিনিসপত্র রক্ষা করতে হলে এর সংস্কারের বিকল্প নেই।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান জানিয়েছেন, হাসন রাজার ব্যবহৃত অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র আছে, যা অনেকেই জানেন না। সংরক্ষণের জায়গা ঠিকঠাক না থাকায় সেগুলো মানুষকে দেখানো যাচ্ছে না।

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অনিশিমাস চৌধুরী বলেছেন, হাসন রাজার নামে আলাদা একটি কমপ্লেক্স করা এখন সময়ের দাবি।

হাসন রাজা ট্রাস্টের সভাপতি ও হাসন রাজার প্রপৌত্র দেওয়ান এমদাদ রাজা চৌধুরী বলেন, বন্যার কারণে হাসন রাজা মিউজিয়ামটির অবস্থা বেশ করুণ হয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে হাসন রাজাকে নিয়ে চর্চা করার সুযোগ পায়, সে জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন দরকার।

Leave a Comment

error: Content is protected !!