মুক্তির মরীচিকা ধারাবাহিক উপন্যাস: আরিফ আহমেদ (পর্ব ১)

আজ থেকে শুরু হলো মুক্তির মরীচিকা ধারাবাহিক উপন্যাস লেখক আরিফ আহমেদ। দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক যতীন সরকার প্রায়শই একটা কথা বলেন থাকেন, আমি এক কষ্টলেখক। শব্দটা আমার সঙ্গে আরো অধিক মানানসই। অনেক কাটাকুটি করে আমার লিখতে হয়।

তা ছাড়া লেখক হওয়ার জন্য যতটুকু প্রজ্ঞা প্রয়োজন তা আমার নেই বললেই চলে। তবু কখনো-কখনো একান্ত অনুভূতি ও উপলব্ধিগুলো ব্যক্ত করতে বসে যাই কলম নিয়ে। যা লিখি তা সুখপাঠ্য তো দূরের কথা পাঠযোগ্য করতেই হিমশিম খেয়ে যাই। এরপর প্রকাশের বিড়ম্বনা তো আছেই। এই উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটি লেখা ২০০৮ সালে। তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠে তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

এই উপন্যাসে একজন যুদ্ধাপরাধীর কৃতকর্মের বর্ণনা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে সমাজের চোখে ধূলো দিয়ে, ধর্মকে পুঁজি করে দেশের আদর্শহীন রাজনীতির সুযোগ নিয়ে সে কীভাবে সমাজের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে এর চরম নিদর্শন। পাশাপাশি স্বাধীনতার পর থেকে তার প্রভাববলয়ে আবর্তিত ব্যক্তিদের সামাজিক অবস্থান এবং মানসিক অবস্থাও তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

আমরা অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তির বিচার চাই, এটা যেমন সত্য তেমনি একজনের কৃতকর্মের শাস্তি অন্য কাউকে পেতে হোক, তা আমাদের কাম্য নয়। যে-কারণে একজন যুদ্ধাপরাধীর সন্তান হয়েও অরোরার চিন্তা-চেতনায় যে প্রগতির ছাপ আমরা দেখতে পাই, এই সমাজের জন্য তা আশির্বাদস্বরূপ। তা ছাড়া পারিবারিক স্নেহ-ভালোবাসাবঞ্চিত মিতুল চরম বিপদগামী হয়েও বিবেকের তাড়নায় যখন সুস্থ-সুন্দর জীবনে ফিরে আসার প্রাণপণ চেষ্ঠায় মত্ত, আমাদের মনে তখন আশার আলো জ্বলে ওঠে।

একটা সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন আমাদের সবার চোখে। এই তরুণ প্রজন্মই একদিন সেই স্বপ্ন সফল করবে, সে প্রতীক্ষায় আমরা প্রহর গুনছি।

পরিশেষে বইটি প্রকাশের ক্ষেত্রে নিরলস প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতার জন্য ঋণ স্বীকার করছি লেখক হান্নান কল্লোলের নিকট। পাশাপাশি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চু এবং সেইসব শুভাকাঙ্খির প্রতি, যারা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। ভুল-ত্র“টিগুলো মার্জনার দৃষ্টিতে দেখে গঠনমূলক মতামত জানালে কৃতার্থ হবো।

======================================================

পর্ব ১

রমনা পার্কের একটি বেঞ্চে বসে বাদাম খাচ্ছে এক যুবক। ঢাকার একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র থেকে পালিয়ে এসেছে সে। আজ তার কোনো টেনশন নেই, উৎকণ্ঠা নেই, সময়ের তাড়া নেই, আছে অখন্ড অবসর। সে আজ স্বাধীন। নিজেকে এতো হালকা আর ভারমুক্ত লাগছে যে ইচ্ছে করছে পাখি হয়ে ডানা মেলে নীল আকাশে উড়ে যেতে।

কেবল একটিই ভাবনা, যে ভাবেই হোক জয়ী হতে হবে। খুব দ্রুত একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখন তার। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে চায় সে। যে কারণে অন্য কোথাও না গিয়ে পার্কে এসে বসেছে। সে জানে তাকে খোঁজার জন্য এতোক্ষণে হুলস্থুল কাণ্ড ঘটে গেছে। হয়তো বা মরিয়া হয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে পুলিশ। কিন্তু সে আজ বদলে গেছে, অনেক বদলে গেছে, তাতো আর ওরা জানে না। অবশেষে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে পার্কের বেঞ্চ ত্যাগ করে যুবক।

আজ হরতাল।
মিতুল রিকশায় চড়ে কলেজ থেকে ফিরছে। প্রতিদিন বাসে যাতায়াত করলেও গতকাল কে বা কারা বিরোধীদলের মিটিংয়ে বোমা মেরেছে। বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী হতাহত হয়েছে। তাদের কল্যাণে দেশবাসী পেলো একদিনের হরতাল।

হরতালের কর্মসূচি রাত ১২টার পর ঘোষিত হওয়ায় অনেকের তা অজানা।
হয়তো এটাই নিয়ম। মৃতদের মঙ্গলাকাক্সক্ষায় জীবিতদের হয়রানি করার নামই মনে হয় সাম্প্রতিক রাজনীতি।
বিরোধী দল বলছে, এটা সরকারি দলের কাজ। সরকারি দল বলছে, দেশে উন্নয়নের জোয়ারের ঠেলা সইতে না পেরে বিরোধী দল নিজেদের গায়ে নিজেরাই বোমা মেরেছে অর্থাৎ নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার চেষ্টা করছে। আবার কেউ কেউ বলছে, এটা মৌলবাদীদের কাজ। দুঃখ এটাই, এদেশের সবাই কথা বলে অনুমানে। সরকার, প্রশাসন, রাজনীতিবিদ সবাই সন্দেহের ওপর ভর করেই বক্তব্য পেশ করে। যত বড় দুর্ঘটনা বা নৈরাজ্যই ঘটুক না কেন এর সঠিক কারণ এদেশে কোনোদিন উদঘাটিত হয় না। মাঝখানে হারিয়ে যায় অমূল্য কিছু প্রাণ।

পুলিশ, গোয়েন্দা অন্ধকারে কিছইু খুঁজে পায় না। না পাওয়ার কারণও মনে হয় সেই গল্পটার মতো। আমেরিকা, জাপান ও বাংলাদেশের পুলিশ অফিসাররা বসে গালগপ্প মারছে কার দেশ তদন্তে কতটা এগিয়ে। আমেরিকার অফিসার বলল, আমাদের দেশে কোনো অপরাধ ঘটলে ১২ ঘন্টার মধ্যে অপরাধীকে আমরা গ্রেফতার করি। জাপানের অফিসার বলল, আমরা ৬ ঘন্টার মধ্যে অপরাধীকে গ্রেফতার করে তার শাস্তি নিশ্চিত করি।

বাংলাদেশের অফিসার অনেক ভেবেচিন্তে বলল, এ আর এমনকি, আমাদের দেশে কোনো অপরাধ ঘটার ৩ ঘন্টা আগেই আমরা তা জানতে পারি, তাই কাউকে গ্রেফতার করতে হয় না, শাস্তিও দিতে হয় না। এজন্য এ হতভাগা দেশে অপরাধ ঘটার পর কমিটি হয়, চা-নাশতা খাওয়া হয়, টিভির পর্দায় বড় বড় বক্তৃতা হয়, পরিনামে কিছু সরকারি অর্থের পকেটপূজা হয়ে এক সময় সব নীরব। মাঝে মাঝে বিদেশ থেকে গোয়েন্দা আসে, এদেশের অন্ধ গোয়েন্দারা যা খুঁজে পায় না তারা তা বের করার চেষ্টা করে। তাদের চূড়ান্ত রিপোর্ট কী, জনগণ তা কোনোদিন জানতে পারে না। যেই লাউ সেই কদু। সে কথা থাক।

আজ মিতুলের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্লাস থাকায় হরতাল উপেক্ষা করে কলেজে গিয়ে দেখে ডিপার্টমেন্টে তালা ঝুলছে। ভারাক্রান্ত মনে নানা কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরছে সে। বাড়িটা নিজের নয়। আশ্রিত সে। মিতুল শুন্য দৃষ্টিতে থাকায় আকাশের দিকে, প্রকৃতি মনে হয় কোনো কারণে আজ ক্ষেপে গেছে। বোশেখের কাঠফাঁটা রোদের তপ্ত তেজে খাঁ খাঁ করছে চারদিক। প্রকৃতির অশ্রুশূন্য রোদনে মানবদেহে যেন বয়ে যাচ্ছে লোনা জলের বন্যা ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!