ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র টিটু

এম এ আজিজ, ময়মনসিংহ: দেশের সর্বকনিষ্ঠ সিটি কর্পোরেশন ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র মোঃ ইকরামুল হক টিটুর নেতৃত্বাধীন পরিষদের দুই বছর পূর্তি হয়েছে ২০ জুন। ২০১৯ সালের এইদিনে সিটি কর্পোরেশনের নবনির্বাচিত পরিষদের প্রথম সভার মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয়ে দুই বছর মেয়াদ পূর্ণ হলো।

দুই বছর খুব বেশি সময় না হলেও এই পরিষদের কার্যকালের প্রায় অর্ধেক সময়। নতুন এ সিটি কর্পোরেশনের প্রায় ৭০ ভাগ এলাকা ইউনিয়ন পরিষদ ও চরাঞ্চল থেকে অর্ন্তভুক্ত হয়েছে। বিলুপ্ত ময়মনসিংহ পৌরসভার অল্প সংখ্যক জনবল নিয়ে করোনার তাণ্ডবের মধ্যেও সিটি কর্পোরেশনকে কাজ করতে হচ্ছে।

এরপরও দুই বছরের পথ চলায় মূল শহরের অভ্যন্তরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, গুরুত্বপূর্ণ সড়কসমূহ প্রশস্তকরণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, দক্ষতার সাথে করোনা মোকাবেলাসহ নাগরিকসেবার মানোন্নয়নে সিটি কর্পোরেশনের প্রচেষ্টা ও কর্মকাণ্ড চোখে পড়ার মত।

সিটি কর্পোরেশন সুত্র মতে, এ সময়ে পুরোনো ড্রেন সংস্কারের পাশাপাশি প্রায় ২০ কিলোমিটার নতুন আরসিসি ড্রেন, আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপ ড্রেন নির্মাণ হয়েছে। এর মধ্যে মিন্টু কলেজ-বিপিন পার্ক, স্টেশন রোড-থানাঘাট পর্যন্ত ৮’শ মিটার আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপ ড্রেন নির্মাণ, কাশবন আবাসিক এলাকার ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক নির্মাণ, নাটককঘর লেন থেকে ডিবি রোড হয়ে সেহড়াখাল পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপড্রেন অন্যতম।

ফলে মূল শহরে জলাবদ্ধতা বন্ধ হয়েছে। এছাড়া, জলাবদ্ধতা নিরসনে সক্ষমতা বাড়াতে নগরীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত খালসমূহ খনন চালু রাখার পাশাপাশি খালসমূহের যথাযথ ব্যবস্থাপনায় পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। স্টেশনরোড, বড়বাজার, কাশররোড, বাউন্ডারীরোড, বাঘমারা রেলক্রসিং রোড, মেহগনি রোড, আবুল মনসুর সড়কসহ নগরের ১০টি গুরুত্বপূর্ণ সড়কপ্রশস্তকরণ সম্পন্ন হয়েছে। নির্মাণ হচ্ছে ৪৪ কিলোমিটার নতুন সড়ক।

একইসাথে নাগরিকদের সুপেয় পানির জন্য ১৫ টি গভীর নলকূপ স্থাপন, ২৪ কিঃ মিঃ পাইপলাইন নতুন সংযুক্ত করা হয়েছে। গত ডিসেম্বর মাসে একনেকে ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের অবকাঠামো উন্নয়ন ও নাগরিক সেবার উন্নয়নে ১৫৭৫ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ২শত কোটি টাকার টেন্ডার প্রদান করা হয়েছে।

নগরকে পরিচ্ছন্ন রাখার চ্যালেঞ্জেও দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে সিটি কর্পোরেশন। বর্জ্যকে চোখের আড়ালে রাখতে ৭, ৮ ও ৯নং ওর্য়াড এবং শহরের প্রধান সড়কসমূহে চালু করা হয়েছে রাত্রিকালীন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। সকাল থেকে সারাদিন শহরের অভ্যন্তরে কোন আর্বজনা থাকছে না। সিটির প্রধান ডাপিং স্টেশনের পরিধি বৃদ্ধি, ডাম্পিং স্টেশনের অভ্যন্তরে বর্জ্য পরিবহনের সড়ক নির্মাণ এবং ডাম্পিং স্টেশনের সীমানা তৈরির মাধ্যমে চিরচেনা আর্বজনা ও দুর্গন্ধময় অবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে দেয়া হয়েছে পরিচ্ছন্ন রূপ।

অপরদিকে, ক্ষতিকর ক্লিনিক্যাল বর্জ্য ধ্বংসে নেয়া হয়েছে আধুনিক ব্যবস্থা। প্রতিদিন হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টার থেকে বর্জ্য কাভার্ড ভ্যানের মাধ্যম সংগ্রহ করে, আকুয়ায় অবস্থিত প্লান্টে নিয়ে ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে। মানব বর্জ্যকে রূপান্তর করা হচ্ছে জৈব সারে। বছরে উৎপাদন হচ্ছে ১৪ শত টন জৈব সার। এখন বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজ করছে সিটি কর্পোরেশন।

সিটি এলাকায় কোন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়নি। এই সময়ে সার্বিক মশক পরিস্থিতি ছিল নিয়ন্ত্রিত। মশক নিধনে নিয়মিত ক্রাশ প্রোগ্রাম, টেকনিক্যাল কমিটি গঠন, হটস্পট চিহ্নিত করে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। এছাড়া, ড্রেন, খাল ও জলাশয়ে ব্যাঙ ও মাছ অবমুক্তকরণের মাধ্যমে জৈবিক পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা অব্যহত রয়েছে। ইপিআই, ডিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইনে সিটি কর্পোরেশন প্রায় শতভাগ সফলতা অর্জন করেছে।

সিটি কর্পোরশনের সবধরনের সেবা সহজীকরণে চালু করা হয়েছে ওয়ানস্টপ সার্ভিস। জনগণের দোরগোড়ায় সেবা প্রদানে সিটি কর্পোরেশনের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ সেবার ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে। সার্টিফিকেট প্রদান, পানির বিল, প্রপার্টি ম্যানেজমেন্ট, ট্যাক্স প্রদান ঘরে বসে অনলাইনেই করতে পারছেন।

নাগরিক জীবনকে সুশৃঙ্খল রাখতে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। রাস্তায় নির্মাণসামগ্রী রাখা, নিয়ম বহির্ভূতভাবে বাড়ী নির্মাণ, অবৈধ যান চলাচল রোধ, মাস্ক ও সামাজিক দূরুত্ব নিশ্চিতকরণের ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করছে।

অপরদিকে সিটি এলাকাকে আলোকিতকরণে স্থাপন করা হয়েছে ২০২৫ আধুনিক এলইডি লাইট। ৪৯ কোটি টাকার প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে সিটির ১৮২ কিলোমিটার সড়ক আলোকিত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। যার মধ্যে ৩৯ কিলোমিটারের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।

নগরীর আবুল মনসুর সড়কে ফুটপাত ও ডিভাইডার র্নিমাণের পাশাপাশি বৃক্ষ রোপণ করা হয়ছে। থানাঘাটের সামনে ফুটপাত নির্মাণসহ আনন্দ মোহন কলেজ, নওমহল ও ল্যাবরেটরি স্কুলের সামনে অভিবাবকদের জন্য করা হয়েছে অভিবাবক ছাউনি। জেলা প্রশাসকের বাংলোর সামনে থেকে ঈদগাহ মাঠ পর্যন্ত সৌন্দর্যবর্ধণ করা হয়েছে, জয়নুল উদ্যানকে নান্দনিক আলোয় সজ্জিত করা হয়েছে। সংস্কার করা হয়েছে শহরের ঐতিহ্যবাহী বিপিন পার্ককেও।

নগরীর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নেও কাজ করেছে সিটি কর্পোরেশন। তৈরি করা হয়েছে ল্যাট্রিন, ফুটপাত, নলকূপ, ড্রেনসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন স্থাপনা।

সিটি কর্পোরেশন আরো জানায়, করোনা সংকট মোকাবেলায় ১৩২৭ টন চাল বরাদ্ধ ও ৬৫ লক্ষ টাকার খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। মেয়র ইকরামুল হক টিটু করোনার শুরু থেকে নিজে মাঠে থেকে করোনা মোকাবেলায় গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম তদারকি করেছেন। এছাড়া মেয়র টিটু তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রায় ৭০ হাজার প্যাকেট খাবার বিতরণ করেছেন। সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে জনবহুল ৫২৫টি স্থানে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা, বুথ স্থাপন, শতাধিক মাইকে দৈনিক সচেতনতা বার্তা প্রচার, ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার ও ৬ লাখ মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে।

এ সময়ে ৪টি গাড়ি এবং ২৫ টি ¯েপ্র মেশিনের মাধ্যমে নিয়মিত জীবাণুনাশক ছিটানো এবং জীবাণুনাশক টানেল স্থাপন করা হয়েছে। করোনাকালে ডাক্তারদের যাতায়াত এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের নমুনা সংগ্রহে পরিবহনের ব্যবস্থা ছিল অন্যতম। ঘরে বসে চিকিৎসা সেবা দিতে চালু করা ছিল টেলিমেডিসিন সেন্টার। করোনা ভ্যাকসিন প্রদান ব্যবস্থাপনায় সিটি কর্পোরেশন দেখিয়েছে সফলতা। শুরু থেকেই বিভাগের মধ্যে ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনে ভ্যাকসিন রেজিস্ট্রেশন এবং টিকা গ্রহণের পরিমান ছিল সর্বোচ্চ। ব্যাপক প্রচারণা, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রেজিস্ট্রেশন সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন, সন্ত্বোষজনক টিকাদান কেন্দ্র ও টিকাদান বুথ স্থাপনের জন্য এটি সম্ভব হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ, ইতিহাস সংরক্ষণ এবং সুস্থ্য সাংস্কৃতিক বিকাশে কাজ করছে সিটি কর্পোরেশন। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে মেয়রের উদ্যোগে ২০২০ সালের বিজয় দিবসে উদ্বোধন করা হয়েছে জয়বাংলা চত্বর। এছাড়া, করোনাকালেও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। মাসব্যাপী বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য জীবনকেন্দ্রিক আলোকচিত্র প্রদর্শনী এবং বঙ্গবন্ধুকে জানো মুক্তিযুদ্ধকে জানো কুইজ প্রতিযোগিতা নগরবাসীর মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। অপরদিকে বিভিন্ন শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পাশে দাড়ানোসহ কম্পিউটার, পার্লার, ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনগোষ্ঠী সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে সিটি কর্পোরেশন।

সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা শেখ মহাবুল হোসেন রাজীব জানান, যানজট নিরসনে একটি যানজট নিরসন কমিটি গঠন করা হয়েছে। নগরীতে অটোবাইক, অটোরিকশা চলাচলে শৃঙ্খলা আনা ও অবৈধ যানসমূহের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যানজট নিরোসনে পাটগুদাম বাসস্ট্যান্ডকে স্থানান্তর করে নতুন বাসস্ট্যান্ড নির্মাণ এবং নতুন একটি ট্রাকস্ট্যান্ড নির্মাণ কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া নতুন ২০ তলা নগর ভবন, একটি শিশু পার্ক ও একটি থিম পার্ক নির্মাণেও কাজ করছে সিটি কর্পোরেশন। জনগণের প্রত্যাশার সাথে সামঞ্জস্য রেখে একটি আদর্শ নগরী নির্মাণে দ্ইু বছর খুব কম সময়।

মেয়র ইকরামূল অর্ধেকেরও বেশি সময় জুড়ে রয়েছে মহামারি করোনা ভাইরাসের তান্ডব, লকডাউন, দেশব্যাপী নানা অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে করোনা প্রসূত স্থবিরতা। তবে, করোনা মহামারীতেও নগর ও নাগরিক সেবার উন্নয়ন প্রচেষ্টায় মেয়র ইকরামুল হক টিটু ও তাঁর পরিষদের কার্যক্রমে যে গতি দেখা গেছে।

মেয়র ইকরামুুল হক টিটু জানান, নগরবাসিকে শতভাগ সেবা দিতে চেষ্ঠা করছি। এক সময় সামান্য বৃষ্টি হলেই ময়মনসিংহ নগর পানিতে তলিয়ে যেত, এখন তা দুরিকরণ সম্ভব হয়েছে। এছাড়া পাটগুদাম ব্রীজের ওপারে চর কালিবাড়িতে সিটি কর্পোরেশনের ময়লাখানা বা ডাম্পিং স্টেশন মানুষের দুর্ভোগের অন্ত ছিল না। ঐ ময়লাখানায় এখন আর দুর্গন্ধ নেই। সিটি কর্পোরেশন হওয়ার পর প্রথম পরিষদের বয়স মাত্র দুই বছর। এর মাঝে দেড় বছরেরও বেশি সময় করোনা চলতে থাকায় উন্নয়নে কিছুটা গতি কমেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অতিদ্রিুততম সময়ে জনগনের চাহিদা পুরণ করতে পারবো বলে আশা করছি। এ জন্য তিনি সকলের সহযোগীতা কামনা করেছেন।

Leave a Comment

error: Content is protected !!