নতুন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন

দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হতে যাচ্ছেন সাবেক জেলা ও দায়রা জজ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রোববার নির্বাচন কমিশনে নিজেদের প্রার্থী হিসেবে তাঁর নামে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে।

এর মাধ্যমে অনেক জল্পনার অবসান হলো। সম্ভাব্য নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে গত কয়েক মাসে অনেকের নাম শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ যাঁর নাম প্রস্তাব করল, তা আন্দাজ করতে পারেননি প্রায় কেউই।

১৯৪৯ সালে পাবনা শহরে জন্মগ্রহণকারী মো. সাহাবুদ্দিন ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। পরে জেলা যুবলীগের দায়িত্বও পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে ছিল তাঁর সাহসী ভূমিকা। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় কারাভোগ করতে হয়েছে তাঁকে। কর্মজীবনে দীর্ঘদিন বিচারিক আদালতের দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি।

আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে কঠোর গোপনীয়তায় প্রার্থী ঠিক করেছে আওয়ামী লীগ। গত মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে দলীয় রাষ্ট্রপতি প্রার্থী মনোনয়নে সভাপতি শেখ হাসিনাকে একক ক্ষমতা দেওয়া হয়। যে কারণে গতকাল সকালে শেখ হাসিনা নেতাদের কাছে রাষ্ট্রপতি প্রার্থীর নাম বলার আগপর্যন্ত দলটির নেতারাই ছিলেন অন্ধকারে।

আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রপতি পদে দলীয় প্রার্থী হিসেবে কার নামে মনোনয়ন ফরম জমা দেবেন, তা জানতে রোববার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলটির কয়েকজন নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে গণভবনে যান। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ, চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া ও তথ্য সম্পাদক সেলিম মাহমুদ। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি প্রার্থী মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। সেখানেই নেতারা জানতে পারেন রাষ্ট্রপতি পদে দলীয় প্রার্থীর নাম।

এরপর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনে যায়। প্রথমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কার্যালয়ে গিয়ে সংসদের চিফ হুইপ ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক গিয়ে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য দুটি মনোনয়ন ফরম কেনেন। এ সময় কাদেরসহ দলটির নেতারা ইসির প্রধান ফটকে সাহাবুদ্দিনের অপেক্ষা করেন।

সকাল ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে হুন্দাই গাড়ি করে ইসিতে আসেন তিনি। গাড়িতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন দুই নাতি এবং আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ। পেছনের আরেকটি গাড়িতে আসেন তাঁর একমাত্র ছেলে আশরাফ আদনান রনি। মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়ার পর বেলা ১১টা ২০ মিনিটের দিকে নির্বাচন কমিশন ত্যাগ করেন সাহাবুদ্দিন। এ সময় তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছা। এখন কোনো প্রতিক্রিয়া নাই। সর্বশক্তিমান আল্লাহর ইচ্ছা।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাহাবুদ্দিন বেস্ট চয়েজ। তিনি একজন ভালো রাষ্ট্রপতি হবেন। আইনজীবী ও সাবেক জজ হওয়ায় আইনগত বিষয়ে তিনি দক্ষতার স্বাক্ষর রাখবেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত দক্ষতা ও অতীতের কর্মময় জীবনের কারণেই তাঁকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।’

ব্যক্তিগত তথ্য

মো. সাহাবুদ্দিনের জন্ম ১৯৪৯ সালে, পাবনা শহরে। ১৯৬৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেন। পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং পাবনা শহীদ অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন আইন কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৭২ সালের ১৬ নভেম্বর পাবনা শহরের দিলালপুরের আলী আকতারের জ্যেষ্ঠ কন্যা রেবেকা সুলতানার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সাহাবুদ্দিন। রেবেকা সুলতানা বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়ে যুগ্ম সচিব হিসেবে ২০০৯ সালে অবসরে যান। তিনি বর্তমানে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান রিসোর্স প্রোগ্রাম বিভাগের অধ্যাপক এবং ফ্রেন্ডস ফর চিলড্রেন অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।

সাহাবুদ্দিন-রেবেকা দম্পতির একমাত্র সন্তান মো. আরশাদ আদনান (রনি) দেশে ও বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বর্তমানে একটি বেসরকারি ব্যাংকে উচ্চ পদে কর্মরত।

রাজনীতি ও পেশাজীবন

বৃহত্তর পাবনা জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সভাপতি ছিলেন মো. সাহাবুদ্দিন। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরে রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তিনি। এই সময় তিনি আটক হয়ে তিন বছর জেলে ছিলেন। কারাভোগের পর মুক্ত হলে তিনি পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

কর্মজীবনে বিচারিক আদালতের দায়রা জজের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেন।

২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার অনুসন্ধানে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তিনি ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে পরপর দুবার বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব নির্বাচিত হন। বিচারকের বিভিন্ন পদে চাকরি শেষে ২৫ বছর পর ২০০৬ সালে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে অবসর নেন।

২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার ছিলেন মো. সাহাবুদ্দিন। সেই সময় দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধের ঘোষণা দেয় বিশ্বব্যাংক, যা দেশের রাজনীতিতে তোলপাড় সৃষ্টি করে। ২০১২ সালের পদ্মা সেতু দুর্নীতি বা ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মামলা করে দুদক। এ মামলায় আসামি হন তৎকালীন সেতুসচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াসহ সাতজন। দুর্নীতির তদন্তের পর্যবেক্ষণে সেই বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশে আসে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সাবেক প্রধান প্রসিকিউটর লুই গাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদল। তাঁরা দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানসহ কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে দুদকের করা মামলায় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমানকে আসামি করার জন্য পরামর্শ দেয় বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদল। বৈঠকে উপস্থিত কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন এর প্রতিবাদ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলায় ব্যক্তিস্বার্থ, রাজনৈতিক স্বার্থকে বাদ দিয়ে দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখেছিলেন সাহাবুদ্দিন। রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।

২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে চট্টগ্রামের জেএমসি বিল্ডার্স লিমিটেডের পক্ষে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান মো. সাহাবুদ্দিন। এখন তিনি ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যান।

আজ চূড়ান্ত হবে রাষ্ট্রপতি

রাষ্ট্রপতি পদে আওয়ামী লীগ মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের নামে দুটি মনোনয়ন জমা দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. জাহাংগীর আলম জানান, আজ সোমবার ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ ইং মনোনয়নপত্র দুটি যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হবে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!