শিশুর সামাজিক ও মানসিক আচরণগত সমস্যা

শিশুর সামাজিক ও মানসিক আচরণগত সমস্যা। মানসিক ও আচরণগত সমস্যা নানাবিধ সামাজিক অসঙ্গতির সূত্রপাত থেকে মানসিক চাপের কারণে সৃষ্টি হতে পারে। এ ধরনের সমস্যা স্থায়ী না হলেও সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি হয়ে থাকে এবং শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

সমস্যাগুলোর উপসর্গ একটির অধিক হতে পারে এবং পরবর্তী সময়ে গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে। আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে এই ধরনের সমস্যার উপসর্গ বিভিন্নভাবে দেখা যায়, যেমন: একাকী থাকার স্বভাব, উদাসীনতা, আক্রমণাত্মক বা আত্মঘাতী প্রবণতা।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সামাজিক মানসিক আচরণগত সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আনুমানিক ৩ থেকে ৩০ শতাংশ শিশুর সামাজিক মানসিক আচরণগত সমস্যা রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশসহ অনেক দেশে এই সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। আবার এটিও শোনা যায় যে, অনেক শিশু যারা বাংলাদেশে সামাজিক মানসিক আচরণগত সমস্যায় আক্রান্ত, তারা বিভিন্ন কারণে স্কুলে যায় না এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা স্কুল ছেড়ে দেয়। অনেক সময় এ ধরনের শিশুদের দুষ্টু বাচ্চা বলে চিহ্নিত করা হয় বলে তারা কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন না।

২০০৪ সালে যুক্তরাজ্যের জাতীয় সমীক্ষা থেকে অনুমান করা হয় যে, ৫ থেকে ১০ বছর বয়সসীমার অন্তর্গত ১০ শতাংশ ছেলে এবং ৫ শতাংশ মেয়ের মধ্যে মানসিক আচরণগত সমস্যা রয়েছে। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশে একই বয়সসীমার অন্তর্গত ২০ শতাংশ ছেলে এবং ১০ শতাংশ মেয়ের এই সমস্যা দেখা গেছে।

ঢাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অভিভাবক এবং শিক্ষকদের রিপোর্ট থেকে এই পরিসংখ্যানটি জানা যায়। যুক্তিক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে, এই সমস্যা যুক্তরাজ্যের তুলনায় ঢাকায় প্রায় দ্বিগুণ।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি, এবং ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি। গবেষণার একটি প্রতিবেদনে, সামাজিক মানসিক আচরণগত সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের এবং গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে বেশ কিছু মিল খুঁজে পাওয়া গেছে।

আক্রান্ত শিশুদের শনাক্ত করার এবং পরীক্ষা করার যে অনুশীলন ধার্য করা হয়েছে সেই মোতাবেক এই ধরনের নিম্নলিখিত লক্ষণ দেখা দিতে পারে:

  • ১. আক্রান্ত শিশুদের আচরণ তাদের বয়স বা সমাজ-উপযোগী না-ও হতে পারে।
  • ২. স্কুলে এবং শ্রেণিকক্ষের সহপাঠীদের সঙ্গে অস্বাভাবিক আচরণ প্রদর্শন করা (যেমন, ক্লাসের কাজ করতে অনিচ্ছা, ক্লাসে অবিরাম ডাকাডাকি, চিত্কার-চ্যাঁচামেচি, সহপাঠীদের ক্রমাগত বিরক্ত করার প্রবণতা)
  • ৩. এ ধরনের বাচ্চাদের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা দেখা যেতে পারে (যেমন, কোনো কাজে ধৈর্যধারণ করতে না পারা, একাকী থাকতে চাওয়া বা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা, অস্বাভাবিক কান্নাকাটি করা)
  • ৪. প্রাপ্তবয়স্ক বা সমবয়সিদের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক তৈরিতে অসুবিধা (যেমন, শিক্ষকদের নির্দেশাবলি ঠিকমতো পালন না করা বা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা, সহপাঠী বা শিক্ষকদের কাছ থেকে দূরে থাকার প্রবণতা, সহপাঠী বা শিক্ষক বা প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে আক্রমণাত্মক মনোভাব প্রদর্শন করা, সহপাঠীদের সঙ্গে বয়সোপযোগী খেলাধুলা বা আদান-প্রদানে বিরূপ মনোভাব প্রদর্শন করা)।

শিক্ষাবিদদের মতে, বাড়িতে ও স্কুলে শিক্ষা প্রদানের পদ্ধতির ভিন্নতার কারণে শিশুদের আচরণগত সমস্যা তৈরি হতে পারে। স্কুলশিক্ষক এবং পরিবারের সদস্য যারা শিশুটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে, তাদের যথাযথ ভূমিকা শিশুটির সামগ্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই সম্পর্কগুলো কীভাবে একটি শিশুর সামাজিক মানসিক আচরণগত সমস্যা তৈরি করতে পারে তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে এবং সমাধানের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এই ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত হওয়া শিশুদের প্রতি শিক্ষক এবং পিতা-মাতাকে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করে একটি কার্যকর পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।

সামাজিক মানসিক আচরণগত সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের যে ধরনের সাহায্য প্রয়োজন হয়ে থাকে:

  • ১. অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষক, যিনি শিশুর শিক্ষা কার্যক্রমকে সাবলীলভাবে পরিচালনা করতে পারেন।
  • ২. ছোট আকারের ক্লাসরুম। যেমন, ১৫-২০ জন শিক্ষার্থীর ক্লাসরুম নিশ্চিত করা, যাতে এ ধরনের শিশুরা শিক্ষকদের কাছ থেকে সঠিক পরিচর্যা পেতে পারে।
  • ৩. সামাজিক ও মানসিক বিকাশের জন্য পাঠ্যসূচির পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষামূলক কৌশল প্রয়োগ করা। যেমন, সামাজিক বিকাশের গল্পসংক্রান্ত বই, বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা।
  • ৪. শিশুদের আত্মবিশ্বাস তৈরি করার জন্য তাদেরকে ক্লাসের প্রথাগত পড়ালেখার পাশাপাশি কিছু সামাজিক কার্যক্রমে নিযুক্ত করা প্রয়োজন।
  • ৫. প্রয়োজনে বিশেষ শিক্ষক বা মনোবিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে শিক্ষা, সামাজিক মেলামেশা এবং যথাযথ ব্যবহারের কার্যক্রম পরিচালনা করা।
  • ৬. শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ, অভিভাবক, প্রশাসন নির্বিশেষে বাচ্চার বেড়ে ওঠার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই মিলে শিশুর বিকাশে সক্রিয় অবদান রাখা।
  • ৭. সবার মধ্যে সামাজিক, মানসিক, আচরণগত সমস্যায় আক্রান্ত শিশুটি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

এজন্য একটি সুন্দর শিক্ষামূলক পরিবেশ একান্ত প্রয়োজন। একই সঙ্গে ক্লাসের অন্য শিশুদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য স্বাভাবিক শিশু যদি এ ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের সম্পর্কে সচেতন হয়, তাহলে তারা এ ধরনের শিশুদের স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করতে পারে এবং সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। সর্বোপরি এ ব্যাপারে স্কুলশিক্ষক, অন্যান্য কর্মী, অভিভাবক ও সমবয়সি সহপাঠী সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

লেখক:
ড. তানিয়া জারিন খুশবু
স্কুল কাউন্সিলর, মেডিটেশন ও
মাইন্ডফুলনেস থেরাপিস্ট, নিউট্রিশনিস্ট,
প্লে ও স্পিচ থেরাপিস্ট, যুক্তরাজ্য

Leave a Comment

error: Content is protected !!