যে কারণে শিশু-কিশোররা অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে -সোহেল সানি

শিশু হলো রাষ্ট্রীয় পোষ্য এবং রাষ্ট্র তার সর্বোত্তম স্বার্থরক্ষাকারী অভিভাবক| রাষ্ট্রের পিতৃসম অভিভাবকত্বকে ‘প্যারেনস পেট্রি’ বলা হয়| শিশু-বয়স্কের মধ্যে পৃথক বিচার ব্যবস্হাও এ কারণে| যে শিশুটি গৃহে যথাযথ যত্ন ও তত্ত্বাবধান এবং পরিবেশ পায়নি, সে শিশুটি অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে জড়িত হয়ে পড়লে অভিভাবক হিসেবে তাকে শাস্তি দিয়েই তার দায়িত্ব শেষ করতে পারে না রাষ্ট্র| আধুনিক রাষ্ট্র শিশু-কিশোরদের অভিভাবকের দায়িত্বপালন করে থাকে|

বাংলাদেশে কোনো পরিসংখ্যান না থাকায় শিশুর বিভিন্ন শারীরিক উত্পীড়নের চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে না| তবে দেশে উত্ত্যক্ত, উত্পীড়ন সম্প্রতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে| এমনকি পরিবারের কাছের আত্মীয় ও পরিচিতরাও বহু ক্ষেত্রে শিশুদের উত্ত্যক্ত করে থাকে| ফলে শিশুর মানসিক বিকাশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং শিশুটি এক অস্বাভাবিক মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে| শিশু-কিশোর অপরাধের সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন অপরাধ বিজ্ঞানীরা|

যেমন : শহর জীবনের নিঃসঙ্গতা, পিতা-মাতার উভয়ের কর্মজগতে তত্পরতায় পিতা-মাতার অপর্যাপ্ত তদারকি, পরকীয়া, মানসিক অসুস্হতা, অসংগত মূল্যবোধ ও লক্ষ্য, অবৈধ উপায়ে অভিভাবকের উপার্জন, কুরুচিপূর্ণ সিনেমা, টিভিসহ সামাজিক গণমাধ্যমে অশ্লীল, নীল ছবি, অসামাজিক সঙ্গ ইত্যাদির কারণে শিশু-কিশোর অপরাধ বাড়ছে|

আমরা যেন ভুলে না যাই, বরিশালের সেই চার শিশুর বিরুদ্ধে রুজুকৃত চাঞ্চল্যকর ধর্ষণ মামলা| আসল ঘটনা উন্মোচনে মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ ও নির্দেশনা ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা| শিশু-কিশোর যে রাষ্ট্রের পোষ্য এবং রাষ্ট্রই যে অভিভাবক, তা হাইকোর্টের আদেশ প্রমাণ করেছে| উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রে্রটের প্রতি যে ভর্ত্সনামূলক আদেশ দিয়েছিলেন, তা নিম্ন আদালতের বিচারকদের জন্য শিক্ষণীয়| জনমনে সৃষ্ট বিস্ময়ের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক গণমাধ্যমেও লক্ষ করা গেছে| এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হলে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সামাজিক গণমাধ্যমে আসবে, এটাই স্বাভাবিক|

তবে আমরা ভুলে যাই যে, ক্ষোভ-বিক্ষোভের ভাষাও সৃজনশীল হওয়া দরকার| রাষ্ট্রের যে সংবিধান নাগরিকত্বের মর্যাদা দিয়েছে তা আইন দ্বারাই আরোপিত| অতএব মনগড়া কথাবার্তা না লিখে সংক্ষুব্ধ সুনাগরিক হিসাবে আইনের কাছেই প্রতিকার প্রত্যাশা করতে হবে| একজন নাগরিক হিসেবে প্রতিকারের সুযোগ নেই| প্রতিকারের জন্য রাষ্ট্রের ওপর ভরসা রাখতে হবে| দেশকে ভালোবাসলে আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে, আদালত বা বিচারালয়ই হচ্ছে শেষ আশ্রয়স্হল এবং আস্হার পবিত্রতম ঠিকানা|

ফিরে আসছি শিশু-কিশোর অপরাধ প্রসঙ্গে| আইনে শিশুদের ক্ষেত্রে অপরাধী মনের অনুপস্হিতিতে কোনো কর্মকাণ্ড ঘটলে তা অনিচ্ছাকৃত বলে ধরে নেওয়া হয়| ইংল্যান্ডের আইনও মনে করে অনিচ্ছাকৃত কর্মের জন্য কোনো ব্যক্তিকে দণ্ডিত করা প্রাকৃতিক ন্যায়বিচার পরিপম্হি| ইংল্যান্ডের আইনে সাত বছরের নিচে কোনো শিশুর কোনো কার্যই অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয় না| সাত থেকে চৌদ্দ বছরের শিশুদের আচরণ মানসিক পরিপক্বতার বিবেচনার ওপর নির্ভর করে বিবেচনা করা হয়ে থাকে| পৃথক বিচারপদ্ধতিরও অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, শিশু-কিশোররা যেন ভবিষ্যতে সমাজ অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত না হয়|

‘অভিযুক্ত’, ‘দোষী’ ও ‘দণ্ডিত’ ইত্যাদি শব্দাবলি নিকৃষ্ট প্রকৃতির অপরাধীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে এ সব শব্দ আইনে নিষিদ্ধ রয়েছে| যে কারণে শিশু-কিশোরদের বিচার পদ্ধতি ফৌজদারি আদালত থেকে ভিন্ন| একই অপরাধে জড়িত থাকলেও বয়স্ক অপরাধীর সঙ্গে শিশু-কিশোরদের বিচার করা হয় না| এদের বিচার প্রকাশ্যে করা হয় না, তাদের নাম-ঠিকানা, অপরাধ ও বিচারের রায় জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় না|

বাংলাদেশে কার্যকর দণ্ডবিধির ধারা ৮২ ও ৮৩ তে ইংল্যান্ডের ন্যায় বিধান রয়েছে—শিশুকে কোনো অবস্হাতেই মৃতু্যদণ্ড দেওয়া যাবে না| শিশু স্বেচ্ছায় চৌর্যকর্মে জড়িত হতে পারে, এমনকি চুরি যে বেআইনি কাজ—তার পক্ষে জানা অসম্ভব নাও হতে পারে; কিন্তু চৌর্যকর্মের ফলে পরিণতি কী দাঁড়াবে এবং সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা তার নিজের কী পরিমাণ ক্ষতি হবে—তা বোঝার মতো মানসিক পরিপক্বতা শিশুর না থাকাই স্বাভাবিক| এ কারণেই একই আচরণের জন্য পৃথক বিচার পদ্ধতি|

আধুনিক যুগে শিশুদের উত্ত্যক্ত, হয়রানি প্রত্যেক দেশেই জাতীয় উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠার সৃষ্টি করেছে| যান্ত্রিক যুগে শিশু-কিশোরদের নিয়ে পরিবারের অস্তিত্ব মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন| গতিশীল ও কর্মমুখর জীবনযাত্রার কারণে পিতা-মাতা উভয় কর্মজগতে তত্পর| শিশুকে নির্জন বাড়িতে একাকী বাস করতে হয় অথবা তার সঙ্গী হয় কাজের মেয়ে বা অনাত্মীয় কেউ| ফলে আচার-আচরণ, শিক্ষা, শৃঙ্খলাবোধ, মূল্যবোধ সৃষ্টিতে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে| অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে, শিশুর অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রিত হয় প্রথম পরিবার থেকে|

পুরুষ অন্ন জোগাবে, আর নারী ঘরনি হিসেবে ঘর সামলাবে—এমনটি আর নেই| তাত্ত্বিক ও বাস্তবিক মতে এটাই স্বাভাবিক, যে শিশু পিতা-মাতার অনাদরে, তাদের এবং নানারকম পারিবারিক উদ্বেগের ভেতর দিন কাটায়, সে শিশু পরবর্তী কালে অপরাধপ্রবণ হবে| অপরাধপ্রবণ এলাকায় বসবাস করেও যে শিশু পিতা-মাতার স্নেহ-মমতা ও শৃঙ্খলার ভেতর বেড়ে ওঠে, ভবিষ্যতে সে শিশু অপরাধী হয়ে ওঠে না| শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যত্ জীবনধারা কী প্রকৃতির হবে তা অনেকাংশে নির্ধারণ করে তার পরিবার| মানসিক হীনম্মন্যতা, মনোবৈকল্য, স্কুল পালানো ও জৈবিক ত্রুটির যে কোনো একটি অবস্হা শিশু-কিশোরকে অপরাধের পথে ঠেলে দেয়| পিতা-মাতার দ্বন্দ্বকলহ শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে|

ভীতসন্ত্রস্ত জীবনযাপন শিশুর মনে নিরাপত্তাবোধের অভাব তীব্র হয়ে ওঠে| পিতা-মাতার নিষ্ঠুর আচরণ ও অবহেলা সহজেই শিশুকে বিপথগামী করে তোলে| শিশু-কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ভূমিকা রয়েছে| শিশু আইন ১৯৭৪ কিশোর অপরাধীদের প্রতি পুলিশের ভূমিকা নির্ধারণ করা হলেও তা যে যথাযথভাবে পালন করা হয় না, তার প্রমাণ হাইকোর্টের আদেশ|

এ সম্পর্কিত আইনের ৭২ ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, আটককৃত শিশুর প্রতি প্রহরারত পুলিশ পিতৃসুলভ ব্যবহার করবেন এবং তার প্রতি যত্নশীল হবেন| ৫০ ধারা অনুযায়ী শিশু বা কিশোর অপরাধীকে আটকের পর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অবশ্যই জেলা প্রবেশন কর্মকর্তাকে তা অবহিত করবেন| ৪৮ ও ৪৯ ধারা অনুযায়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কিশোর অপরাধীকে মুক্তি দিতে পারবেন| তবে যেক্ষেত্রে তা সম্ভব না হবে , সেক্ষেত্রে শিশুকে নিরাপদ স্হানে হেফাজতে রাখবেন|

৪৬ ধারা অনুযায়ী শিশু আইনের ধর্তব্য অপরাধগুলোর সংবাদ থানায় পৌঁছলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামলা রুজু করবেন এবং প্রয়োজনীয় তদন্েতর ব্যবস্হা নেবেন| ১৩ ধারা অনুযায়ী কোনো শিশুকে আদালতে সোপর্দ করা হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্বে শিশুর অভিভাবককে লিখিতভাবে তা অবহিত করা এবং নির্ধারিত তারিখে অভিভাবক যাতে আদালতে উপস্হিত থাকতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে| ৩ ও ৪ ধারা অনুযায়ী শিশু অপরাধীদের সর্বদা কিশোর আদালতে সোপর্দ করতে হবে| ২ ধারা অনুযায়ী অনূর্ধ্ব ১৬ বছরের শিশু-কিশোরকে আইনমোতাবেক শিশু বলা হয়েছে| এ ছাড়াও পি আর বি রোল ৫২১-এর নির্দেশ মোতাবেক কিশোর অপরাধীর মুক্তির পর পুলিশ কর্মকর্তা তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবেন, দুই জন গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্হিতিতে শিশুটিকে তার অভিভাবকের কাছে হস্তান্তর করবেন|

শিশু অপরাধীদের জন্য টঙ্গী ও যশোরে সংশোধনাগার রয়েছে| পরিকল্পিত কর্মসূচির অধীনে তাদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ও হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে সংশোধন করার ব্যবস্হা নেওয়া হয়ে থাকে; কিন্তু পুলিশ বয়স্ক অপরাধীদের সঙ্গে যে আচরণ করেন, সেই একই আচরণ শিশু অপরাধীদের সঙ্গেও করেন| ফলে উদ্রেক করে নানা প্রশ্নের| সংশ্লিষ্ট সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের জন্য মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা হওয়া উচিত কেবল শিক্ষণীয় নয়, পালনীয়| তাহলেই কেবল শিশু-কিশোর অপরাধ ক্রমে কমে আসবে|

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

Leave a Comment

error: Content is protected !!