ভার্চুয়াল জগতে নিপীড়ন ও সাইবার বুলিং প্রসঙ্গে

ভার্চুয়াল জগতে নিপীড়ন ও সাইবার বুলিং প্রসঙ্গে। বর্তমান সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় একটি বিষয় হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট ব্যবহার। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ভার্চুয়াল জীবনে মানুষের প্রবেশগম্যতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে—এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। আজকের দিনে যখন প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের জগত্ আমাদের জন্য উন্মুক্ত, সেই সময় সবচেয়ে জরুরি হয়ে উঠেছে উন্নত ও নিরাপদ যোগাযোগব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেওয়া।

এই ডিজিটাল জীবনাচরণের একটি অন্যতম বড় নেতিবাচক দিক হলো ডিজিটাল প্রযুক্তিমাধ্যম ব্যবহার করে কাউকে হয়রানি করা, ভয় দেখানো, রাগানো, লজ্জা দেওয়া, অসম্মান করা, মার্জিত ভার্চুয়াল ভাষায় যাকে বলে ‘সাইবার বুলিং’। এর সবচেয়ে বড় অসুবিধাটি হলো অপ্রকাশ্যে হেনস্তাকারী পরিচয় গোপন করে এই কাজগুলো করতে পারেন। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএ ফাউন্ডেশন) নামক একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণামতে, সাইবার বুলিংয়ের ভুক্তভোগীদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৫৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ, যার বেশির ভাগই স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী।

তথ্যপ্রযুক্তির এই সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘সাইবার বুলিং’ এক আতঙ্কের নাম। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি, নানামুখী যোগাযোগের বিকাশ, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং এর ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জবাবদিহি নিশ্চিতের অভাবকে এই সমস্যার জন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, দেশের তরুণ প্রজন্মকে টার্গেট করেই সাইবার অপরাধগুলো সংঘটিত হচ্ছে। সম্প্রতি সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএ ফাউন্ডেশন) গবেষণা বলছে, সাইবার অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের ৫০ দশমিক ২৭ শতাংশই ভুগছেন সাইবার বুলিংয়ের কারণে।

২০২০ সালের নভেম্বরে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে তাদের কার্যক্রম শুরু করে, যেখানে দেখা যায় প্রথম বছরে ১৭ হাজার ২৮০ জন নারী অভিযোগ করেছেন, যারা প্রত্যেকেই সাইবার বুলিংয়ের শিকার। অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের এক গবেষণামতে ৫০ শতাংশের বেশি নারী অনলাইনে সহিংসতার শিকার হন, এর মধ্যে ৬২ শতাংশের বয়স ২৫ বছরের নিচে, যার ৫৫ শতাংশই ছাত্রী।

বিব্রতকর মেসেজ, হুমকিযুক্ত ইমেইল, মিথ্যা তথ্য দিয়ে গুজব ছড়ানো, ইনবক্সে আপত্তিকর ছবি, ভিডিও, ফেইসবুকে মিম তৈরি ও প্রচার করে নারী ও শিশুদের প্রতি ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠছে ইন্টারনেট। অনেকে স্রেফ মজা করার জন্য সাইবার বুলিং করে থাকেন, যা ব্যক্তির অধিকারের চরম লঙ্ঘন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ (১) (ক) ধারায় এ ধরনের কাজ অপরাধ। এসব অপরাধের ক্ষেত্রে প্রথম বার অভিযুক্তকে তিন বছর জেল ও ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে।

এই বিকৃত আচরণগত সামাজিক অসুস্থতাকে নির্মূল করার জন্য দেশব্যাপী সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো শোভাযাত্রা, আলোচনাসভা ও গোলটেবিল বৈঠকের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কনটেন্ট তৈরি করছে।

জাতিসংঘের ইউএন উইমেন সংস্থাটি ১৯৯১ সাল থেকে আন্তর্জাতিকভাবে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৬ দিনব্যাপী ক্যাম্পেইন কর্মসূচি শুরু করেছে। ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতি বছর মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ১৬ দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ পালন করে থাকে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোও মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি নারী নির্যাতন বন্ধ ও সচেতনতা সৃষ্টিতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। কমলা রংকে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা বন্ধের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং বলা হয় কমলা রঙের বিশ্ব হলো নারীর প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনমুক্ত বিশ্ব।

এই সাইবার বুলিং থেকে নারীদের রক্ষা করতে কিছু দিবসকেন্দ্রিক ক্যাম্পেইনই যথেষ্ট নয়, বরং দরকার আরো সমন্বিত পদক্ষেপ। যে কোনো ধরনের নির্যাতনের স্বীকার হলে নারীদের ন্যায়ের পক্ষে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। নারীরা বুলিংয়ের স্বীকার হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের অংশগ্রহণ বন্ধ করে দেওয়াই সমাধান নয়। এই অপার সম্ভাবনার পৃথিবীতে নারীদের সমান অংশগ্রহণ যেমন জরুরি, সাইবার স্পেসে তাদের সুরক্ষার ব্যাপারে সরকারের আরো গুরুত্বারোপ করা উচিত। একই সঙ্গে নারীদের তথ্যপ্রযুক্তি নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিষয়ে তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এই মুহূর্তে যখন ২০২২ সালে ১৬ দিনের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষের দোরগোড়ায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি, সমাজের সবার মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি।

তৃণমূল পর্যায়ে যে গতিতে আমাদের এই ক্যাম্পেইনকে সামনের দিকে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা ছিল, ঠিক সেভাবে এই ক্যাম্পেইন আমরা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে দিতে পারিনি। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে হয়রানি ও অনলাইন নিরাপত্তার বিষয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জ্ঞান সীমিত এবং ১৬ দিনব্যাপী এই ক্যাম্পেইন তেমনভাবে তৃণমূল পর্যায়ে উদ্যাপিত হয় না।

এই ক্যাম্পেইন তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দিতে আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার জরুরি। অনলাইন কিংবা অফলাইনের বিভিন্ন ধরনের ক্যাম্পেইনে স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ, সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, উন্নয়নকর্মী এবং নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোকে যুক্ত করে এ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

এ ক্ষেত্রে কমিউনিকেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (সিফোরডি) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কমিউনিকেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (সিফোরডি)-এর একটি বড় শক্তি হলো এর নেটওয়ার্কগুলোর মাধ্যমে সমাজের সব স্তরে যোগাযোগ স্থাপন। এই শক্তিশালী মাধ্যমকে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের একটি অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই ক্যাম্পেইনে যোগাযোগমাধ্যমের কর্মীদের স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: নাহিন রহমান, কমিউনিকেশন্স স্পেশালিস্ট ও মো. ওয়াহিদুল ইসলাম, কমিউনিকেশন্স অফিসার, সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

 

Leave a Comment

error: Content is protected !!