সানাফ এগ্রোর উদ্যোক্তা ইব্রাহিম খলিল আজ সাবলম্বি

ময়মনসিংহে সানাফ এগ্রোর উদ্যোক্তা উচ্চ শিক্ষিত ইব্রাহিম খলিল আজ সাবলম্বি॥ সানাফ এগ্রো ফল, ফুল ও ওষুধী গাছের চারা বিক্রি করে আজ প্রতিষ্ঠিত। মাত্র ত্রিশ হাজার টাকা নিয়ে ১১ শতক জমির উপর এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এইচ আর এম বিষয়ে ২০১৬ মাস্টার্স শেষ করা ইব্রাহিম খলিল।

ময়মনসিংহ সদরের দাপুনিয়া বাজার সংলগ্ন প্রায় তিন একরের বেশি জায়গা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সানাফ এগ্রো বিভিন্ন ফল, ফুল ও ওষুধী গাছের চারা উৎপাদন ও বিক্রি করে আসছে।

ময়মনসিংহ সদরসহ আশপাশ এলাকায় সল্পমুল্যে এই সব চারা বিক্রি হচ্ছে। সানাফ এগ্রো-তে গিয়ে দেখা যায়, ফল, ফুল ও ওষুধী গাছের চারার বিশাল সমাহার। চারা উৎপাদন, পরিচর্যায় ব্যস্ত রয়েছে নারী শ্রমিকরা। ২০ জনের অধিক নারী শ্রমিক। তাদের সবার বাড়ি দাপুনিয়া বাজারের আশপাশ এলাকায়। নারী শ্রমিক জহুরা বলেন, বাড়ির কাছে প্রতিষ্ঠান। আমি দীর্ঘ দিন ধরে এই প্রতিষ্ঠানে ২৫০ টাকা পারিশ্রমিকে কাজ করছি। সকাল-বিকাল সংসারের কাজ শেষে এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে আজ আমি সাবলম্বি।

অপর শ্রমিক দাপুনিয়া কলাপাড়ার (উত্তর দাপুনিয়া) স্বামীহারা সাথি আক্তার বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানসহ তিনজনের সংসার নিয়ে আমি দিশেহারা হয়ে সানাফ এগ্রো প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করি। নিয়মিত কাজ করায় আমি সন্তানদের নিয়ে খেয়ে পড়ে ভাল অবস্থানে রয়েছি।

প্রকল্প ব্যবস্থাপক বর্ন চক্রবতী বলেন, সানাফ এগ্রো প্রতিষ্ঠানে (ফার্মে) প্রায় দুই শতাধিকেরও বেশি বিভিন্ন জাতের ফল, ফুল ও ওষুধী গাছে চারা রয়েছে। নিজস্ব বাগান থেকে সাইয়ন বা কলম সংগ্রহ করে কলমজাত চারা উৎপাদন করে আসছি। প্রতি বছর প্রায় ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার বিভিন্ন জাতের চারা বিক্রি হচ্ছে।

এ সব চারার মধ্যে রয়েছে, দেশীয় উন্নতজাতের কাঠাল, বারো মাসি কাঠাল, হাজারী কাঠাল, দেশীয় আম, বিদেশী মিয়াজানি আম, সূর্যডিম আম, ভিয়েতনামি আম, কিউজাই আম, ব্যানানা ম্যাংগোজাতের আমের চারা সল্পমুল্য বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে উন্নতজাতের মাল্টা, বারী-১ মাল্টা, টমাটো, বারো মাসি টমাটো, উন্নতজাতের বেগুনের চারা। ঘর বা গৃহসজ্জায় ক্যাকটাস জাতীয় গাছের চারা উৎপাদন ও বিক্রিতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপক সুনাম রয়েছে।

বর্ন চক্রবর্তী আরো বলেন, সানাফ এগ্রো শুধু ফল, ফুল ও ওষুধী গাছের চারা বিক্রি ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির বেশ কয়েকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মাঝে সানাফ এগ্রো হ্যাচারী। এই হ্যাচারীতে একদিন বয়সের হাঁস ও মুরগীর বাচ্চা উৎপাদন ও বিক্রি করা হচ্ছে। নিজস্ব প্রযুক্তিতে স্বয়ংক্রিয় সম্পুর্ণ অটোমেটিক বিভিন্ন সাইজের ফ্যামিলি সাইজ এবং বাণিজ্যিক সাইজ ইনকিউবেটর স্বচ্ছতার সাথে বিক্রি করে আজ অনেকটা সফল। এছাড়াও গরুর খামার রয়েছে। যেখান থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০/৭০ কেজি দুধ বিক্রি হচ্ছে।

সানাফ এগ্রো ফার্মের মালিক ইব্রাহিম খলিল বলেন, আমি ছাত্র জীবন থেকেই কৃষি এবং কৃষি উৎপাদনে আগ্রহী ছিলাম। ২০০০ সালের দিকে দাপুনিয়া বাজার সংলগ্ন আমাদের পৈত্রিক ১১ শতক জমিতে মাত্র ৩০ হাজার টাকা পুজি নিয়ে বিভিন্নজাতের ফল, ফুল ও ওষুধীজাতের গাছের শতাধিক চারা উৎপাদন ও বিক্রির মাধ্যমে যাত্রা শুরু করি। পরে যুক্ত করি গৃহসজ্জা ক্যাকটাস তরুলতা জাতীয় গাছের চারা উৎপাদন শুরু করি। আমার স্বপ্ন ছিল লেখাপড়ার পাশপাশি এই প্রতিষ্ঠানটিকে প্রতিষ্ঠিত করা।

২০১৬ সালে জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এইচ আর এম বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করি। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও চাকুরীর পিছনে না ঘুরে সানাফ এগ্রো ফার্মকে প্রতিষ্ঠা করতে আরো মনোযোগী হই। যাতে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্থানীয় বেকার ও নিম্ন আয়ের মানুষজন তাদের শ্রম খাটিয়ে নিজেদের পরিবারের হাল ধরতে পারে।

আজ আমার প্রতিষ্ঠানে ২০ লাখের উপরে বিভিন্নজাতের ফল, ফুল ও ওষুধী গাছের চারাসহ ক্যাকটাস তরুলতা জাতীয় চারা রয়েছে। গত বছর ৯ লাখ টাকার উপরে বিভিন্নজাতের চারা বিক্রি হয়েছে। আশা করছি চলতি বছর ১৫ লাখ টাকার চারা বিক্রি হবে। সমুদয় খরচ বাদ দিয়ে সানাফ এগ্রো থেকে ৬/৭ লাখ টাকার উপরে মুনাফা হবে বলে তিনি আশা করছেন।

ইব্রাহিম খলিল আরো বলেন, বর্তমানে সানাফ এগ্রো ফার্মে ২০ জনের বেশি শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। তাদের সবাই নারী শ্রমিক। সবাই নারী শ্রমিক কেন এ সম্পর্কে তিনি বলেন, পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে নারী শ্রমিকের মুজুরী কম। নারীরা তাদের সংসারের কাজ সেরে নিজ বাড়ি থেকে ফার্মে এসে কাজ করেন। এ সব শ্রমিকরা পায়ে হেটেই নিজ বাড়ি থেকে প্রতিষ্ঠানে আসেন। তাদের কোন বাড়তি খরচ হয়না।

তিনি আরো বলেন, প্রতিদিন এই সব নারী শ্রমিকরা তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করে অনেকেই পারিবারিকভাবে আজ সাবলম্বি। চারা উৎপাদন ও বিক্রি সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই তিনি একটি গরুর খামার করেছেন। ছোট্ট আকারে ঐ গরুর খামারে রয়েছে ৮টি গরুর। প্রতিদিন ৬০ কেজি দুধ বিক্রি করেন তিনি। মাটি ও জৈব সার নিজস্ব হওয়ায় গাছের চারা উৎপাদনে খরচ অনেকটা কম হচ্ছে। তাই সল্পমুল্যে চারা বিক্রি সম্ভব হচ্ছে।

সবশেষে তিনি বলেন, নগরীর খাগডহরে ৮ একর জমির উপর একটি এগ্রো ফার্ম করার পরিকল্পনা রয়েছে।

এ সব পরিকল্পনায় এবং এগ্রো ফার্ম পরিচালনায় ইব্রাহিম খলিলের স্ত্রী আনন্দ মোহন সরকারি কলেজে রসায়ন বিষয়ে (অর্নাস) পড়ুয়া স্ত্রী সাদিয়া শারমিন সেতু উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়ে আসছেন বলে দাবি করেন। গাছের চারা উৎপাদনে উচ্চ শিক্ষিত ইব্রাহিম খলিলের সফলতার খবর নিতে প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে বেকার, যুব সমাজ ও শিক্ষিত লোকজন তার কাছে আসেন। খবর নেন কিভাবে তিনি আজকের এই অবস্থানে এলেন। অনেকেই ইব্রাহিম খলিলের পরামর্শ নিয়ে নিজেদের বাড়ি ও বাড়ির আঙ্গিনায় ছোট ছোট নার্সারী গড়ে তুলে বিভিন্নজাতের গাছের চারা উৎপাদন ও বিক্রি শুরু করছেন।

Leave a Comment

error: Content is protected !!