স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহারে বাড়ছে দলীয় কোন্দল

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহারে বাড়ছে দলীয় কোন্দল- প্রভাষক নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার: চলছে সারা দেশ জুড়ে স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ পৌরসভার নির্বাচন। নির্বাচন এলেই মাঠ গরম হয়ে যায় রাজনৈতিক নেতাদের মাঠ পর্যায়ে আনাগোনায়। প্রত্যেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন নিজেদের প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে এ জায়গায় অনেকটাই ভাটা পড়েছে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করার কারণে। দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করার জন্য যোগ্যতার মাপকাঠিতে বা জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ভোট দিতে পারছেনা সাধারণ জনগণ।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহারে বাড়ছে দলীয় কোন্দল

প্রত্যেকটি ব্যবস্থার যেমন ভালোর দিক রয়েছে তেমনি খারাপ দিকও বিদ্যমান। তবে বিবেচ্য বিষয় হলো ভালোর দিকটা কতটুকু আর বিপরীত দিকটাই বা কি ? দলীয় প্রতীক বরাদ্ধের পর থেকেই স্থানীয় রাজনীতিতে গ্রুপিং বাড়ছে চরমভাবে। প্রায় বড় দল গুলোই কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে দলীয় প্রতীকের বিরুদ্ধে নির্বাচন করা প্রার্থীদের দল থেকে বহিষ্কার করার হুমকি দিচ্ছে এমনকি করছেও। এত কিছু করার পরও বিদ্রোহী প্রার্থীদের থামানো যাচ্ছে না। তবে হ্যাঁ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পক্ষ বিপক্ষ থাকবে কিন্তু এর রুপের প্রকাশ যদি হয় চরম আকারে তাহলে অবশ্যই রাজনীতির শুদ্ধাচারের ক্ষেত্রে ব্যাপক হুমকি। বিবাদ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বিভিন্ন নির্বাচনের সকল বিদ্রোহীদের বাদ দিলে স্থানীয় পর্যায়ে দল হয়ে যেতে পারে নেতাশূণ্য।

কোন কোন ক্ষেত্রে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের কথাও শোনা যাচ্ছে। আবার দেখা যাচ্ছে দলীয় কোন্দলের পর নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ারপর তাদের পক্ষেও সঠিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। সব মিলিয়ে স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের নির্বাচনটা সাধারণ জনগণকে ভাবিয়ে তোলছে বলেই মনে হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রেই নির্বাচনে ব্যবস্থাটা দলীয় প্রতীক ব্যবহার করে সরকারী সুযোগ সুবিধা নেওয়ারও অভিযোগ উঠছে বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে।

২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইন সংশোধন করে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার আইন পাস করা হয়। তখন থেকেই বদলে যেতে থাকে মাঠ পর্যায়ের নির্বাচন ব্যবস্থা। বিরোধী দলগুলোর নিষ্ক্রিতার কারণে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকার দলীয় নমিনেশন মানেই বিজয়ের সুবাতাস এমনটাই ধরে নেয়া হচ্ছে। যা প্রমাণ করতে চাইলে আসন্ন ইউপি নির্বাচনের প্রচারণার দিকে নজর দিলেই মিলে যাবে এর সত্যতা। প্রত্যেকটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থীর হিড়িক পড়েছে। তারা এ চিন্তা থেকেই নির্বাচন করতে চায় যে দলীয় মনোনয়ন পেলে জয়ের ক্ষেত্রে আর বাঁধা নেই। সরকার তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতায়ন এবং দেশে রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। একথা সত্যি রাজনৈতিক চর্চ্চা যদি সঠিকভাবে না হয় তাহলে যে নীতিই আমরা প্রবর্তন করি না কেন তা থেকে সঠিক ফল আশা করাটাও বোকামি। ব্যবস্থাটি ভালো না খারাপ হয়েছে এ সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার দেশের জনগণের আর বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু আদৌকি জনগণের সঠিক দাবীগুলো সরকার দ্বারা বাস্তবায়ন হচ্ছে ?

স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যবস্থায় এ নীতি বাস্তবায়নের পর থেকে যেটা দেখা যাচ্ছে সেটা স্পষ্টতই সুখকর নয়। সরকারের বক্তব্য অনেকটা এরকমই ছিল যে মাঠ পর্যায়ে যখন সরকারের কাজ বাস্তবায়ন হবে সেক্ষেত্রে যেন দলীয় লোক দ্বারাই বাস্তবায়ন হয়। তাহলে সরকারের কার্যক্রমের সুফল পাবে জনগণ। সবই ঠিক ছিল। সমস্যা হলো এসব নীতি বাস্তবায়ন করতে রাজনৈতিক নেতারা বা দলের উদ্দেশ্য কতটুকু আন্তরিক। বিগত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিরোধী দলগুলো এতই কোনঠাসা হয়েছে যে সরকারী দল একাই মাঠ চষে বেড়াচ্ছে। প্রত্যেকটা নির্বাচনে বিরোধীদলরা বিভিন্ন অভিযোগ পেশ করে আসছে সরকারের নিকট। অভিযোগ যাই থাকুক একথা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই যে নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ অনেকটাই কমে গেছে। এধারার জন্য অনেকটাই হাল ছেড়ে দিয়েছে বিরোধীদল গুলো। বিরোধী দলগুলো তাদের দাবী প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে মাঠে নামতে সাহস পাচ্ছে না। বাস্তবে যা ঘটছে তা কখনও গণতন্ত্রের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে না। যদিও সরকারী দল বলছে বিরোধীদলের ব্যর্থতার কারণেই এমন হচ্ছে তাদের নির্বাচনী ফলাফল।

ফলাফল যাই হউক একথা আমাদের মানতে হবে যে প্রায় বেশির ভাগ জায়গায়ই দেখা যাচ্ছে নিজেরদের মধ্যেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যার ফলে প্রতিদ্বন্দিরা নিজেদের ক্ষমতা প্রযোগ করার চেষ্টা করছে। সরকার এবং বিরোধী দলের নেতারা একজন আরেকজনের উপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে। দলীয় লোকজন এড়িয়ে গেলেও এ বিষয়ে জনগণ কি ভাবছে ? জনগণ কি আদৌ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীককে মন থেকে মেনে নিয়েছে ? গণতন্ত্রকে শক্তিশালীকরণ এবং তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক। বাংলাদেশ গ্রাম প্রধান দেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ আরো জরুরি। কারন গ্রামের উন্নয়ন ব্যতিত বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর এই উন্নয়ন কেন্দ্রীয়ভাবে শুধুমাত্র সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরকারের বেশির ভাগ কর্মসূচীই স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়ে থাকে। আর এসব কারণে বাংলাদেশের সমগ্র প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গঠন করা হয়েছে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা দ্বারাই তৃণমূল পর্যায়ের সকল কর্মকান্ড পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে তৃণমূল পর্যায়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য স্থানীয় সরকারকে প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান এবং একই সাথে জনগণের অংশগ্রহণের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানে স্থানীয় সরকার সম্পর্কে ৪টি অনুচ্ছেদ রয়েছে ( ৯,১১,৫৯ এবং ৬০)। এসব অনুচ্ছেদে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা ও কার্যকারিতা বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশে তিন স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার বিদ্যমান। এখানে প্রথম স্তরের প্রশাসনিক একক বিভাগ পর্যায়ে কোন স্থানীয় সরকার নেই। দ্বিতীয় স্তরের প্রশাসনিক একক জেলা পর্যায়ে স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ), উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা পরিষদ এবং গ্রাম এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদ, ছোট শহর এলাকায় পৌরসভা ও বড় শহরে সিটি কর্পোরেশন হল স্থানীয় সরকারের একটি অংশ। যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে দেশের মানুষ সেবা লাভ করে থাকে। এসব সেবা লাভের ক্ষেত্রে জনগণ চায় শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। কিন্তু দলীয় প্রতীক ব্যবহারের ফলে জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় দলীয়করণের মাত্রা বেড়েছে। বিরোধী দল নিষ্ক্রিয় থাকার ফলে সরকারী দলের একটা অংশ বিরোধী দলে রুপান্তর হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে সেবা পাওয়ার জন্য দলীয় পরিচয় প্রাধান্য পাচ্ছে। এতে করে সাধারণ মানুষ এব্যবস্থাটার প্রতি অনাগ্রাহী হয়ে উঠেছে বলেই মনে হয়।

স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে হলে প্রথমেই গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং মানুষের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে সচেতন করে তোলতে পারলে এব্যবস্থা সুসংহত হবে। এবং এব্যবস্থা যে উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে তার সুফল দেশের জনগণ ভোগ করতে পারবে। তখনই স্বার্থকতা আসবে রাজনীতির ও জয় হবে গণতন্ত্রের এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা হবে শক্তিশালী।

লেখক পরিচিতি
শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী
প্রভাষক, আলীনগর কারিগরি ও বাণিজ্যিক কলেজ
সভাপতি, ঈশ্বরগঞ্জ প্রেসক্লাব

Leave a Comment

error: Content is protected !!