হিমালয়সম বিশ্বাসের নির্মম সংহার: শরীফুল্লাহ মুক্তি

১৫ আগস্ট। আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে কালো দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে সেনাবাহিনীর বিপথগামী একদল ঘাতকের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শহীদ হন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ছিল জাতীয় ইতিহাসে এক বড় কলংক। দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে পরিবারের সদস্যসহ এমন ভয়াবহ হত্যার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে যারা নবীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল, তারা আজ নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। তবুও জাতির মননে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা যেন কিছুতেই সরছে না। বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হয়ে ওঠার পথটি যেন হারিয়ে ফেলেছে। প্রতিবছর ১৫ আগস্টে আমাদের মন ভরে ওঠে গভীর বিষাদে। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের উপর সে দিনের সেই বর্বরতার স্মৃতি সীমাহীন গ্লানিবোধে আমাদের যেন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। আমরা বারবার বিস্মিত হয়ে ভাবি পরাধীন পাকিস্তানে নয়, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে কী করে সম্ভব হয়েছিল এমন অমানবিক ঘটনা!

বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ছিল- কোনো বাঙালি কোনোদিন তাঁকে হত্যা করবে না। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে ভালোবেসে তিনি তাঁর জীবন-যৌবন, ধন-মান, সাধ-আহলাদ সব কারাগারের অন্ধকারে বিসর্জন দিয়েছেন। তাঁর প্রিয় জীবনের চেয়েও প্রিয়তম বাঙালি জাতির জন্য বারবার হাসিমুখে দৃপ্তপায়ে ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। বছরের পর বছর কারাগারের গহিন অন্ধকারে বিনিদ্র রজনী তাঁর কেটে গেছে, প্রিয় ছেলে-মেয়েদের মুখ একবার দেখার সৌভাগ্য হয়নি। এখনো অনেকে বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করেন। কিন্তু আজ সাধারণ মানুষ আবার অনুভব করছেন শেখ মুজিব কী ছিলেন- কেন তাঁকে আমরা ‘জাতির জনক’ বলি।

একজন সাধারণ বাঙালির মতোই জীবনযাপন করতেন তিনি। কোনো লোভ ছিল না ধন-সম্পদের প্রতি; আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম ও অসীম। একবার বিদেশী সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘What’s your qualification’? উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘I love my people’ ডেভিড ফ্রস্ট পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘What’s your disqualification’? বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সাথে উত্তর দিলেন, ‘I love them too much’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর এই বিচক্ষণ জবাবের মধ্যেই অনুমিত হয় তিনি তাঁর প্রিয় জনগণের প্রতি কতটা আস্থাভাজন ছিলেন। এক কথায় তিনি বাঙালিকে সবসময় বড় করতে চেয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর এত জনপ্রিয়তা অনেকের কাছেই ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই তাঁকে হত্যার জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এই দেশের এবং কয়েকটি বন্ধু রাষ্ট্রের গোয়েন্দারাও সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে বারবার সতর্ক করেছিল। কিন্তু সন্তানতুল্যরা কেউ যে পিতার প্রাণ বধ করবে এটা বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসই হতো না। বঙ্গবন্ধু যে দেশের মানুষকে অন্ধের মতো ভালোবাসতেন, বিশ্বাস করতেন বেশ কয়েকটি ঘটনা থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ সংক্রান্ত কয়েকটি ঘটনা আলোকপাত করা হলো।

১৯৭৫-এর মার্চে এসে বঙ্গবন্ধুর মুখ্য সচিব রুহুল কদ্দুস প্রথমবারের মতো আকস্মিক জানতে পারলেন সেনাবাহিনীর একটি চক্র দেশের রাষ্ট্রপতির টেলিফোনে গোপনে আড়ি পাতছে এবং তাঁর সব কথাবার্তা ও গোপন আদেশ-নিষেধ গোপনে জেনে যাচ্ছে। দেশের রাষ্ট্রপতির কার্যক্রমের উপর বিনা অনুমতিতে গোপন তৎপরতা চালানো দেশদ্রোহিতা এবং সংবিধানের মারাত্মক লঙ্ঘন। এটা জানার পর তিনি বিস্মিত হয়ে গেলেন। তিনি প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক নূরুল ইসলামের সংগে গোপনে সাক্ষাৎ করে জানতে চাইলেন আর্মির এ তৎপরতার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন কি-না, অথবা তাঁর কোনো অনুমোদন এতে আছে কি-না। তিনিও বিস্মিত হয়ে গেলেন। তখন রুহুল কদ্দুস তাঁকে এ বিষয়ে কোথাও মুখ না খোলার জন্য বললেন এবং এ বিষয়ে তিনি যে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন সে বিষয়েও দ্বিতীয় কারো সঙ্গে আলোচনা না করার জন্য বললেন। এ বিষয়ে রুহুল কদ্দুস বলেন, ‘অতঃপর আমি বঙ্গভবনে বঙ্গবন্ধুর অফিসে গিয়ে তাঁর কক্ষে উপস্থিত তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ও অন্যদের সরিয়ে দিয়ে সব ঘটনা বললাম। তিনি আমার দিকে কতক্ষণ নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।’ আমি তাঁকে জিজ্ঞাস করলাম, ‘আপনি কি সেনাবাহিনীকে আপনার টেলিফোন ব্যগিং (আড়িপাতা) করার জন্য বলেছেন?- নাকি তারা আপনার অনুমতি নিয়ে এ কাজ করেছে?’ সরল-প্রাণ বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন, ‘এমন কোনো অনুমতি আমি কাউকে দেইনি। তবে তোমাদের সব কিছুতেই সন্দেহ। তারা আমার সন্তান। তারা এসব নিশ্চয়ই আমার ভালোর জন্য করছে।’

শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণনাশের আশঙ্কা এবং তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য ষড়যন্ত্র সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়ই বাংলাদেশকে আগাম সতর্ক করেছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেন যে, মুজিবকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছিল। ঐ সময় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বাংলাদেশ ডেস্কে কর্মরত স্টিফেন আইজেন ব্রাউন যিনি পরে বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসে পলিটিক্যাল কাউন্সেলর হয়ে এসেছিলেন, তিনি ২০০৫ সালে মার্কিন ইতিহাসবিদ চার্লস স্টুয়ার্ট কেনেডিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, মুজিবকে সতর্ক করে দেওয়ার ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন যে ব্রিফিং তৈরি করেছিল, সেটা তিনি নিজ হাতেই করেছিলেন। তবে ঢাকায় মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে কে কখন বঙ্গবন্ধুকে সতর্কবাণী শুনিয়েছিলেন তার নথিপত্র এখনো পাওয়া যায়নি। লরেন্স লিফশুলজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ঐ সময় ঢাকায় কর্মরত সিআইএ স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরি বলেছিলেন, ‘মুজিববিরোধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তাদের কিছুই জানা ছিল না।’ তবে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর দেশের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর তৎকালীন কাউকে মুজিবের কাছে পাঠিয়েছিলেন। আর উভয় ক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধু ‘ওরা আমার সন্তানের মতো’ উল্লেখ করে তাঁর জীবনের প্রতি হুমকির আশংকা অগ্রাহ্য করেছিলেন।

১৪ আগস্ট রাত ১২টায় যখন ডিজিএফআই-এর তদানীন্তন পরিচালক গোপালগঞ্জের অধিবাসী স্কোয়াড্রন লিডার আজিজ বঙ্গবন্ধুকে ঘুম থেকে তুলে তাঁর অনুমতি প্রার্থনা করে বললেন, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে খুব সন্দেহপূর্ণ কিছু ঘটনা ঘটছে বলে আমরা ক্যান্টনমেন্ট সীলগালা করে দিতে চাই। সেই অটল বিশ্বাসে বঙ্গবন্ধু তার মাথায় স্নেহমাখা হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তুই খেয়েছিস? না খেয়ে থাকলে কামালের মাকে ডেকে তুলি, কিছু খেয়ে নে।… ওরে আমাকে কেউ মারবে না। তোর মতো একই রকম কথা রোজ রাতে শুনে আমি ঘুমাতে যাই। আবার সকালে ঘুম ভেঙে উঠে দেখি আমি বেঁচে আছি। তোর কাছে একই কথা শুনলাম। এখন ঘুমাতে যা। কাল সকালে আসিস। তোর সাথে বসে সজনে ফুলের ভাজি দিয়ে একসাথে নাস্তা খাব।’ স্কোয়াড্রন লিডার আজিজের অসীম দুঃখ যে, তিনি খুনিদের প্রতিরোধে ব্যর্থ হন বলে তাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ১৫ আগস্ট সকালে সজনে ফুলের নাস্তা খাওয়ার শেষ ইচ্ছে পূরণ হয়নি।

সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত রুখতে বঙ্গবন্ধুর এমএসপি কর্নেল জামিলকে ডিজিএফআই পদে নিয়োগদান করা হলেও তদানীন্তন ডিজিএফআই কর্নেল আব্দুর রউফ তাকে দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিতে গড়িমসি করেন এবং সময়ক্ষেপণ করে খুনিদের ষড়যন্ত্র দ্রুত এগিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। এমনকি কর্নেল জামিলকে তাঁর নতুন পদে যোগদান উপলক্ষে ঢাকায় বিদেশী দূতাবাসগুলোয় কর্মরত ডিফেন্স এটাশেদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েও পরে সে আমন্ত্রণপত্র প্রত্যাহার করে নেন। কারণ তখনও তিনি দায়িত্ব পাননি। তদানীন্তন ডিজিএফআই কর্নেল আব্দুর রউফ নানা অজুহাত দেখিয়ে ছুটি নেন এবং বিদেশ গমন করেন। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত গোপালগঞ্জের কর্নেল জামিলের কাছে যথাসময়ে, এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যার দু’একদিন আগেও কর্নেল রউফ ডিজিএফআই-এর দায়িত্ব কর্র্নেল জামিলের হাতে তুলে দিলে খুনিদের সব ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যেত এবং খুনিরা ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলিবিদ্ধ হয়ে তাদের পাওনা পেয়ে যেত। ডিজিএফআই কর্নেল রউফ নানা টালবাহানা ছল-ছুতো করে দু’তিন সপ্তাহের বেশি তার বদলি-আদেশের বাস্তবায়ন বিলম্বিত করেন এবং বিদেশে অবস্থান করতে থাকেন। এ অস্বাভাবিক বিলম্বের পেক্ষ্রাপটে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের চক্রান্ত দ্রুততর করার এবং তা এগিয়ে আনার প্রস্ততিতে কর্নেল রউফ প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। অতঃপর যেদিন অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট বিকালে তিনি যখন ডিজিএফআই-এর দায়িত্ব কর্নেল জামিলের কাছে হস্তান্তর করেন, তখন তিনি ১০০ ভাগ নিশ্চিত ছিলেন যে, কর্নেল জামিল ডিজিএফআই-এর network of intelligence and counter intelligence নিজের কর্তৃত্বে নেওয়ার সময় পাবেন না। পরিণতিতে ১৫ আগস্টের সূর্যের মুখ দেখার আগেই অর্থাৎ তার দায়িত্ব হস্তান্তরের ১০ ঘণ্টার মাথায় রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হবেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খুনি ফারুক-রশীদ-ডালিমরা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে যে ট্যাংক নিয়ে ধানমণ্ডিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিরাপত্তা প্রহরীকে এবং সাভারে রক্ষীবাহিনীকে আতংকিত ও ভীতসন্ত্রন্ত করে তুলেছিল, সেগুলো যে ভুয়া ট্যাংক ছিল, তাতে কোনো গোলা ছিল না সে তথ্য রক্ষীবাহিনী বা সেনাবাহিনীর কেউ জানত না। জানতেন মাত্র চারজনÑ সেনাবাহিনী প্রধান, উপ-প্রধান, সিজিএস ও ডিজিএফআই। যাদের একজন ছাড়া সবাই শেখ মুজিবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। এমনকি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ফোর্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিজিএসকে ৩২ নম্বরে অবস্থিত বিদ্রোহী বাহিনীকে আক্রমণ করার জন্য আর্মি চিফ জেনারেল শফিউল্লাহ যখন অর্ডার দেন তখন কর্নেল শাফায়াত জামিলকে নিয়ে তার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ফোর্সসহ সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ শেরেবাংলানগর ঘুরে এসে বলেন, ওদের হাতে সুপিরিয়র আর্মস অ্যামিউনিশন্স আছে বিধায় তাদের আক্রমণ করে পরাজিত করা সম্ভব নয়। আর্মি কোড ‘ডু অর ডাই’-এর কথা কিভাবে তারা ভুলে গেলেন?- নাকি তারা সংবিধানকে ভুলে গেছেন? সেই আত্মঘাতী ও উচ্চাভিলাষী পথ যেদিন তারা বেছে নেন, সেই পথেই পরবর্তী সময়ে তাদের সবার অপমৃত্যু ঘটে। সেনাবাহিনীর গৌরবময় অফিসার পদে যোগদানকালে দেশের সংবিধান ও রাষ্ট্রপতিকে রক্ষায় তারা জীবন উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তত মর্মে পবিত্র কোরআন শরীফ ছুঁয়ে যে শপথবাক্য উচ্চারণ করেছেন তা ১৫ আগস্টে তারা কার ইঙ্গিতে বিস্মৃত হয়ে গেলেন?

যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধুকে বহিস্কার করেছিল, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর আসার কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাজ-সাজ রব। ১৪ আগস্ট মাঝরাতে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী অফিসার ও সদস্য ঘিরে ফেলল ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাসবভন। নির্মমভাবে শহীদ হলেন তিনি সপরিবারে। সেদিন তাঁর সহধর্মিনী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, জ্যেষ্ঠপুত্র মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, দ্বিতীয় পুত্র লেফটেনেন্ট শেখ জামাল, কনিষ্ঠপূত্র সাত বছরের শিশু শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল এবং ছোটভাই শেখ আবু নাসেরকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল একই সঙ্গে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির অদূরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল তাকে বাঁচাতে ছুটে আসার পথে কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদকেও। প্রায় একই সঙ্গে মিন্টো রোডের বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর ১৩ বছরের মেয়ে বেবী, ১০ বছরের ছেলে আরিফ, ৪ বছরের দৌহিত্র সুকান্ত আব্দুল্লাহ, ভ্রাতুষ্পুত্র সাংবাদিক শহীদ সেরনিয়াবাত, ১৩ বছরের কিশোর আবদুল নঈম খানসহ বাড়িতে অবস্থানরত সবাইকে। আক্রমণ চালিয়ে ঘাতকদের অপর একটি দল একই সময়ে ধানমণ্ডির অপর একটি বাড়িতে হত্যা করে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর স্ত্রী আরজু মণিকে। ঘাতকের কামানের গোলার আঘাতে মোহাম্মদপুরের একটি পরিবারেরও বেশ কয়েকজন হতাহত হন।

১৫ আগস্ট, দিনের আলো ছড়িয়ে পড়ল ঢাকার রাজপথে। স্তব্ধ জনপদ। স্তব্ধ মানুষ। পাকিস্তানী খুনিরা যা পারেনি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে নিজের গড়া সেনাবহিনীর অফিসারেরা সে কাজটি করল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে রইল ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক সেই বাড়িতে। রক্তের মূল্যে তিনি চুকিয়ে দিলেন জন্মভূমি বাংলাকে ভালোবাসার দামÑ বাংলার মানুষকে ভালোবাসার মূল্য। তাঁর কাছে আর কী চাইবার আছে আমাদের? আরো বেশি কোনো মূল্য? গ্রামের সেই দুরন্ত কিশোরটি আবার ফিরে এলো টুঙ্গিপাড়ায়। বাড়ির আঙ্গিনায় বাবা-মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন তিনি। ভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধুর অতি আদরের দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেদিন ঘাতকদের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। কারণ তখন তারা দেশের বাইরে জার্মানীতে অবস্থান করছিলেন।

‘বঙ্গবন্ধুর গায়ে আঠারটি গুলি লেগেছিল। তাঁর মুখে কোনো গুলি লাগেনি। দু’পায়ের গোড়ালির দুটি রগই কাটা, মৃত্যুর পরেও গায়ের পাঞ্জাবির বুক-পকেটে চশমা, সাইড পকেটে তাঁর প্রিয় পাইপ এবং গায়ে একটি সাধারণ তোয়ালে জড়ানো ছিল। মিলিটারিরা রক্তাক্ত কাপড়-চোপড়সহ বিনা গোসলে লাশ কবর দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল।’- এই কথাগুলো বলেছিলেন মৌলভী শেখ আবদুল হালিম। তিনিই বঙ্গবন্ধুর লাশ নিজের চোখে দেখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন এবং তাঁর সাহসিকতা ও প্রচেষ্টায় লাশের গোসল ও জানাজা সুসম্পন্ন হয়েছিল। মৌলভী শেখ আবদুল হালিমের বর্ণনামতে পেটের নিচে পিছন দিক হতে একটি গুলি ঢুকে সামনের দিকে তলপেট দিয়ে বেরিয়ে গেছে। নয়টি গুলি যা বুকের নিচ দিয়ে চক্রাকারে ঢুকেছে, তবে বের হয়নি। বাঁ-হাতের তর্জনীতে একটি গুলি লেগেছে এবং আঙুলটি প্রায় ছিন্ন ও থেঁতলানো। দুই বাহুর উপরিভাগে আছে দুইটা- আরেকটা সম্ভবত ডান হাতের তালুতে। দুই পায়ে চারটি- দুইটি হাঁটুর নিচে ও দুইটি হাঁটুর উপরে অর্থাৎ আঠারটি গুলি বঙ্গবন্ধুর শরীরে বিদ্ধ হয়। বঙ্গবন্ধুর জানাযায় সর্বসাকুল্যে জনা পঁচিশেক লোক অংশ নেয়। বঙ্গবন্ধুর দাফনের পর তাঁর কবর পাহারা দেওয়ার জন্য সরকার ১০/১৫জন পুলিশ মোতায়েন করে। এরা দিন-রাত পালা করে পাহারা দিত। বাড়ির লোক ছাড়া কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হতো না। বঙ্গবন্ধুর দাফনের চার দিনের দিন বাড়ির মসজিদে মিলাদ পড়তে দেয়া হয়নি, পুলিশ বাধা দেয়। কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধুর গৃহে একজন মৌলভী ডেকে মিলাদ পড়ানো হয়েছিল। কোনো রাষ্ট্রপ্রধানকে এমন নৃশংস ও অমানবিকভাবে হত্যার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যক্তি মুজিবকে শুধু হত্যা করতে চায়নি, হত্যা করতে চেয়েছে তাঁর বিশ্বাস ও আদর্শকেও। সে আদর্শ কী?Ñ ‘তিনি এমন একটি দেশ গড়তে চেয়েছিলেন, যা হবে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক- যেখানে মানুষ মর্যাদা পাবে, বাঙালির বাঙালিত্ব বজায় থাকবে।’ যারা তাঁকে হত্যা করেছিল তারা তা চায়নি। তারা ধর্মকে বড় করে দেখিয়ে বাংলার মানুষের ওপর শোষণ চালিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজেছিল। তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সংবিধান থেকে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি বাতিল করে। তারা চেয়েছিল গণতন্ত্রের নামে সমাজে অসাম্য আর হানাহানি অব্যাহত রাখতে। কেবল কতিপয় মানুষ দেশ শাসন করবে। গরীবের কথা তারা ভাবেনি। তাদের আদর্শ ছিল পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধুর উপর তাদের ক্ষোভ ছিল এ কারণে যে, তিনি তাদের পেয়ারা পাকিস্তান ভেঙেছিলেন। কিন্তু তারা বোঝেনি যে, ব্যক্তিকে হত্যা করে তাঁর আদর্শ উপড়ে ফেলা যায় না।

বিপথগামী সন্তানেরা শুধু পিতাকেই হত্যা করেনি, হত্যা করেছে পিতার হিমালয়সম বিশ্বাসকেও। কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করবে, এটা তিনি কখনও কল্পনাও করতেন না। আমরা পিতার সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর প্রায় তিন যুগ পরে হলেও তাঁর হত্যার বিচার বাংলার মাটিতে হয়েছে, অনেকের ফাঁসিও কার্যকর হয়েছে। কিন্তু বিদেশে পলাতক খুনিদের রায় এখনও কার্যকর করা যায়নি। সরকারের উচিৎ কুটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রায় কার্যকর করা। তবেই জাতি কলঙ্কের গ্লানি থেকে মুক্তি পাবে।

বাংলাদেশে অনেক রাজনীতিবিদ ছিলেন, আছেন আরও আসবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো কেউ হবেন না। তাঁর স্থান কেউ দখলও করতে পারবেন না। কারণ তিনি অজর-অমর-অক্ষয়। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন ইতিহাসের বরপুত্র হয়ে চির অমরতায় বেঁচে থাকবেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। কারণ বাংলাদেশের ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধু একই সূত্রে গাঁথা, একে অন্যের পরিপূরক।

তথ্যসূত্র:
০১। দৈনিক যুগান্তর, ১৫ আগস্ট ২০১৩ খ্রি.। (১৫ আগস্ট ট্রাজেডি: বঙ্গভবন ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অজানা অধ্যায়- মুসা সাদিক।
০২। মানুষের বন্ধু বঙ্গবন্ধু, জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান শিশু-গ্রন্থমালা ১৫, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী।

লেখক:
শরীফুল্লাহ মুক্তি
কলাম লেখক,
শিক্ষা-গবেষক ও ইন্সট্রাক্টর,
উপজেলা রিসোর্স সেন্টার (ইউআরসি),
নান্দাইল, ময়মনসিংহ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!