বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। ভূ-রাজনৈতিক ভাবে বাংলাদেশের পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয়, পূর্ব সীমান্তে আসাম, ত্রিপুরা ও মিজোরাম, দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে মায়ানমারের চিন ও রাখাইন রাজ্য এবং দক্ষিণ উপকূলের দিকে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। ভৌগোলিকভাবে পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপের সিংহভাগ অঞ্চল জুড়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ড অবস্থিত।
নদীপ্রধান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের উপর দিয়ে বয়ে গেছে ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদী। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে ও দক্ষিণ-পূর্বে টারশিয়ারি যুগের পাহাড় ছেয়ে আছে। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন ও দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সৈকত কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশে অবস্থিত।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন ও ধ্রুপদী যুগে বাংলাদেশ অঞ্চলটিতে বঙ্গ, পুণ্ড্র, গৌড়, গঙ্গাঋদ্ধি, সমতট ও হরিকেল নামক জনপদ গড়ে উঠেছিল। মৌর্য যুগে মৌর্য সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ ছিল অঞ্চলটি। জনপদগুলো নৌ-শক্তি ও সামুদ্রিক বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। মধ্য প্রাচ্য ও রোমান সাম্রাজ্যে মসলিন ও সিল্ক রপ্তানি করতো জনপদগুলো। প্রথম সহস্রাব্দিতে বাংলাদেশ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে পাল সাম্রাজ্য, চন্দ্র রাজবংশ, সেন রাজবংশ গড়ে উঠেছিল। বখতিয়ার খলজীর গৌড় জয়ের পরে সুলতানি ও মুগল আমলে অত্র অঞ্চলে ইসলাম ছড়িয়ে পরে।
জনসংখ্যায় বিশ্বে অষ্টম বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশ, যদিও আয়তনে বিশ্বে ৯৪তম। ৬টি ক্ষুদ্র দ্বীপ ও নগররাষ্ট্রের পরেই বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলেরও কম এই ক্ষুদ্রায়তনের দেশটির প্রাক্কলিত (২০১৮) জনসংখ্যা ১৮ কোটির বেশি অর্থাৎ প্রতি বর্গমাইলে জনবসতি ২৮৮৯ জন (প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১১১৫ জন)। দেশের জনসংখ্যার ৯৯ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা; সাক্ষরতার হার ৭২ শতাংশ।
বাংলাদেশে সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা ও বিমসটেক-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এছাড়া দেশটি জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, বিশ্ব শুল্ক সংস্থা, কমনওয়েলথ অফ নেশনস, উন্নয়নশীল ৮টি দেশ, জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন, ওআইসি, ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংঘের সক্রিয় সদস্য।
মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে টাল-বাহানা করতে থাকে। মুজিবের সাথে গোলটেবিল বৈঠক সফল না-হওয়ার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ গভীর রাতে মুজিবকে গ্রেপ্তার করেন এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের অংশ হিসাবে বাঙালিদের উপর নির্বিচারে আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর এই নারকীয় হামলাযজ্ঞে রাতারাতি বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সেনাবাহিনী ও তার স্থানীয় দালালদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বুদ্ধিজীবী ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। গণহত্যা থেকে নিস্তার পেতে প্রায় ১ কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। (LaPorte, p. 103) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মোট জীবনহানির সংখ্যার হিসাব কয়েক লাখ হতে শুরু করে ৩০ লাখ পর্যন্ত অনুমান করা হয়েছে।
দুই থেকে চার লক্ষ নারী পাকিস্তানী সেনাদের দ্বারা ধর্ষিত হয়। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারা ১০ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে অস্থায়ী সরকার গঠন করেন। এর প্রধানমন্ত্রী হন তাজউদ্দিন আহমদ। এই সরকার শপথ গ্রহণ করে ১৭ এপ্রিল। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় ৯ মাস পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরূদ্ধে লড়াই করে।
মুক্তিবাহিনী ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ভারতের সহায়তায় ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে। মিত্রবাহিনী প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা’র কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাকিস্তান বাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজী ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পন করে। প্রায় ৯০,০০০ পাকিস্তানী সেনা যুদ্ধবন্দী হিসাবে আটক হয়; যাদেরকে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ
প্রথম সংসদীয় সময়কাল
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে প্রথমে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা চালু হয় ও শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
১৯৭৩ ও ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে শুরুতে মুজিব সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে দেশে বাকশাল নামীয় রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করেন।
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট তারিখে সেনাবাহিনীর কিয়দংশ ও স্বীয় দলের কিছু রাজনীতিবিদের ষড়যন্ত্রে সংঘটিত অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হন।
সংসদীয় সময়কাল ও সামরিক অভ্যুত্থান (১৯৭৫-১৯৯১)
পরবর্তী ৩ মাসে একাধিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা-অভ্যুত্থান চলতে থাকে, যার পরিসমাপ্তিতে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ৭ নভেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরায় প্রবর্তন করেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে রাষ্ট্রপতি জিয়া চট্টগ্রাম সফরের সময় আরেকটি অভ্যুত্থানে নিহত হন। অতঃপর উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে বাংলাদেশের পরবর্তী শাসক জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রক্তপাতবিহীন এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। রাষ্ট্রপতি এরশাদ ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দেশ শাসন করেন।
১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে তার পতন হয় এবং তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করলে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয়।
সমসাময়িক সংসদীয় সময়কাল (১৯৯১-বর্তমান)
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেত্রী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়ার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১ হতে ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ হতে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেত্রী হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। দারিদ্র ও দুর্নীতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একটি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসাবে তার অবস্থান সমুন্নত রেখেছে।
২০০১ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিশাল জয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকার গঠন করে এবং খালেদা জিয়া পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি ২০০১ থেকে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর নানা নাটকীয় পালা বদলের মধ্য দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন। এই সরকার প্রায় দুই বৎসর ক্ষমতায় থাকে এবং সেনা সমর্থিত সরকার হিসাবে সমালোচিত হয়।
তবে ফখরুদ্দিন সরকার ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে। এই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ-নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক মহাজোট সরকার গঠন করে এবং শেখ হাসিনা পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব লাভ করেন। এরপর ২০১৪ সালে ও ২০১৮ সালের সংসদীয় নির্বাচনে পুনরায় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ-নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক মহাজোট সরকার গঠন করে।