ইসি গঠন আইন ও আগামী জাতীয় নির্বাচনে সরকারের ভূমিকা

ইসি গঠন আইন ও আগামী জাতীয় নির্বাচনে সরকারের ভূমিকা। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত একটি বিষয় হলো ইসি গঠন আইন ও সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি নিয়োগ। যদিও আমাদের দেশের প্রেক্ষপটে ইসি সবসময়ই একটি আলোচিত নাম।

এক অপরের প্রতি অবিশ্বাস ও রাজনৈতিক পরিচয়ে ইসি নিয়োগের ফলে ইসির সৌন্দর্যটাই হারাতে বসেছে। এইসব বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দল গুলোর যেমন চিন্তা রয়েছে তেমনি জনগণের রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। কে কে আসছেন পরবর্তী এয়োদশ নির্বাচন কমিশনে। একটি দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু নির্বাচন। আর এই সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে ইসি।

তাই ইসি গঠন প্রক্রিয়াটা অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সুন্দর হওয়া জরুরি। তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কেবলমাত্র ইসির পক্ষে এককভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভভ কি না সে প্রশ্ন থেকে যায় প্রায় সবার মনে। আগামী ১৪ ফ্রেব্রুয়ারি শেষ হচ্ছে বর্তমান কমিশনের মেয়াদ। তারই স্থলাভিষিক্ত হবেন নিয়োগকৃত ব্যক্তিরা এবং তাদের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এপর্যন্ত যতগুলো কমিশন কাজ করেছে তাদের কেউই বিরোধীদল কর্তৃক সমালোচনার বাইরে ছিল না বলেই ধরে নেওয়া যায়। সত্যিকার অর্থে আমাদের দেশে অন্যের প্রতি যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে সেখানে গ্রহণযোগ্য কমিশন গঠন করা খুব জটিল বিষয় বলেই মনে হয়।

আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর ক্ষমতায় থাকার লক্ষ্যে বারবার নির্বাচন ব্যবস্থাতে আঘাত আনা হয়েছে। নিজেদের ক্ষমতাকে স্থায়ী করার জন্য পরিবর্তন করা হয়েছে সংবিধানের। এরই ধারাবাহিকতায় যে সরকারই ক্ষমতায় থেকেছে তার ইচ্ছে মতোই গঠন করেছে নির্বাচন কমিশন এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আজকে যারা বিরোধী দলে রয়েছে তারা আইন প্রণয়নের কথা বলছে কিন্তু তারাও দীর্ঘদিন রাষ্ট্রের ক্ষমতায় ছিলেন কিন্তু আইন তৈরি করেননি এটাই বাস্তবতা। সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনের আইনের কথা বলাও ছিল। বর্তমান সরকার ২৭ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন গঠন আইন দ্রুততার সহিত জাতীয় সংসদে পাস করেছে। তারই আলোকে একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো এর মাধ্যমেই কি সদিচ্ছা না থাকলে স্বচ্ছ ইসি গঠন সম্ভব ? আইনের কাঠামো অনুযায়ি নির্ধারিত ব্যক্তির বাহির থেকে রাষ্ট্রপতি সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন ও অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হককে কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত করেছেন। সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য না হলেও সুন্দর দুজন মানুষকে নির্বাচন করা হয়েছে একথা অস্বীকার করা যাবে না। নির্বাচন কমিশন নিয়োগের আইন না থাকায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সময় থেকেই সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন রাষ্ট্রপতি।

অবশ্য ইসি গঠন নিয়ে এই আইন পাসের আগে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সকল রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা বসেছিলেন যদিও বিএনপি এতে অংশগ্রহণ করেনি। ইতোমধ্যে আমাদের দেশে না মানার একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। এক দলের প্রতি অন্য দলের প্রতি একটি অনাস্থা তৈরি হয়েছে বিভিন্ন অন্যায় অবৈধ কাজের ফলে। এই অনাস্থার জায়গাটা ধীরে ধীরে আরো বেড়ে চলেছে।

যেকোন বিষয়েই দলগুলো ঐক্যমতে পৌঁছতে ব্যর্থ হচ্ছে এমনকি জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থি কাজ করে। এবারও সরকার আইন না করে ইসি গঠনের কাজের কথা বলে আসছিল। সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে প্রচুর পরিমাণে সময় না থাকার কথা বলা হচ্ছিল কিন্তু হঠ্যাৎ করেই স্বল্প সময়ের মধ্যেই আইন পাস করার চিন্তা করে সরকার।

অনেক আলোচনা সমালোচনার পর সংবিধানে আইন প্রণয়নের কথা বলা থাকার পরও স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পর গত ২৩ জানুয়ারি মহান জাতীয় সংসদে বিলটি উত্থাপনের পর ২৭ জানুয়ারি পাস হয়। এরপর ২৯ জানুয়ারি মহামান্য রাষ্ট্রপতি “প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন ২০২২” এ সম্মতি প্রদান করেন। পরে সেটি প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হয়। এ আইনে সার্চ কমিটির কাজ সম্পর্কে আইনে বলা হয়েছে, কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে।

আইনে বেঁধে দেওয়া যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। কমিটি সিইসি ও কমিশনারদের প্রতি পদের জন্য ২ জন করে ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে। কমিটি গঠনের ১৫ দিন কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দিতে হবে।

সার্চ কমিটি সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে যোগ্যদের অনুসন্ধানের জন্য রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহবান করতে পারবে। সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে কাউকে সুপারিশের ক্ষেত্রে তিনটি যোগ্যতা থাকতে হবে।

এগুলো হলো, তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। নূন্যতম ৫০ বছর বয়স হতে হবে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা সরকারি বা বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত পদে বা পেশায় তার অনূন্য ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এ সার্চ কমিটির কাজে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে সাচিবিক সহায়তা প্রদানের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।

আইন অনুয়ায়ি সিইসি ও কমিশনারদের অযোগ্যতাগুলো হলো- আদালত কর্তৃক অপ্রকৃতিস্থ ঘোষণা করলে; দেউলিয়া হওয়ার পর দায় থেকে অব্যাহতি না পেলে; কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিলে কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করলে; নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাদন্ডে দন্ডিত হলে; ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট-১৯৭৩ বা বাংলাদেশ কোলাবরেটরস ( স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস) অর্ডার-১৯৭২-এর অধীনে কোনো অপরাধের জন্য দন্ডিত হলে; আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করছে না এমন পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কর্মে লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে।

৫ ফ্রেব্রুয়ারি ৬ সদস্যের এ কমিটি গঠন করার পর ইসি গঠনের লক্ষ্যে সার্চ কমিটি সিভিল সোসাইটি ও সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে এবং সময় না থাকার কারনে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে না বসে সরাসরি নাম চেয়েছেন এমনকি যেকোন ব্যক্তি সার্চ কমিটির নিকট না প্রস্তাব করার ব্যবস্থাও রেখেছেন। ইতোমধ্যে নাম পাঠানোর বিষয়টি শেষ হয়েছে ১১ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৫টায়।

বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায় অনেকেই ব্যক্তিগতভাবেও নিজের নাম তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করতে সিভি জমা দিচ্ছেন এবং নিজের পরিচয় ও কার্যকলাপ তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। বিষয়গুলো রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে আশার সঞ্চার করেছে কয়েকটি দল বাদে। বিএনপি বলছে এ বিষয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যাথা নেই অবশ্য সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি তাদের পক্ষ থেক্ষে ইসি নিয়োগের জন্য নাম প্রস্তাব করেছে। এতসব আলোচনা সমালোচনার পর কেমন কমিশন পাচ্ছে দেশ কিংবা যাদের পাচ্ছি তাদের দিয়ে কি রকম নির্বাচন সম্ভব সেসব বিষয় এখন আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের মাঝে। অতীতের যেসব কমিশন কাজ করে গেছেন তাদের নির্বাচন ব্যবস্থা কেমন ছিল বা কেমন করতে পেরেছে।

সেইসব বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে কোন কমিশনই আইনে যতই বলা থাকুক না কেন সরকারের সহায়তা ছাড়া কোন সুন্দর গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারে নাই। আমরা যে আইনের দ্বারাই ইসি নির্বাচন করি না কেন ইসির পক্ষে সরকারের সহায়তা ছাড়া আমাদের দেশে সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন করা সম্ভব না। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেক্ষে ইসি একটি বড় ভূমিকা রাখবে এটা যুক্তিসংগত।

তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু ইতোমধ্যে তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে তাই বর্তমান সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এটাই স্বাভাবিক। সেইক্ষেত্রে আগামী নির্বাচন কমিশন এবং বর্তমান সরকার একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জাতিকে উপহার দিবে এই প্রত্যাশা সকলের।

লেখক পরিচিতি
প্রভাষক নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার
শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী

Leave a Comment

error: Content is protected !!