ময়মনসিংহ বাংলাদেশের সপ্তম বৃহত্তম শহর। বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এটি ময়মনসিংহ জেলার প্রায় কেন্দ্রভাগে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত। নদীর তীর জুড়ে থাকা শহর-রক্ষাকারী বাঁধের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে নিয়ে গড়ে উঠেছে ময়মনসিংহ পার্ক যা শহরবাসীর মূল বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত। বর্তমানে পার্কের অনেক দৃশ্যমান উন্নয়ন করা হয়েছে।
ময়মনসিংহ নগরীতে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ, আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, নাসিরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, নটরডেম কলেজ ময়মনসিংহ, ময়মনসিংহ জিলা স্কুল, মুসলিম হাই স্কুল ময়মনসিংহ, ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজ, বিদ্যাময়ী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরী হাই স্কুল, ময়মনসিংহ প্রভৃতি; তাই ময়মনসিংহ দ্বিতীয় শিক্ষা নগরী হিসেবে পরিচিত। এটি বাংলাদেশের অষ্টম বিভাগীয় শহর ও কনিষ্ঠতম সিটি কর্পোরেশন।
নামকরণ
ময়মনসিংহ জেলার নামকরণ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে ভিন্ন মত প্রচলিত আছে। আর ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার স্বাধীন সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তার পুত্র সৈয়দ নাসির উদ্দিন নসরত শাহ’র জন্য এ অঞ্চলে একটি নতুন রাজ্য গঠন করেছিলেন, সেই থেকেই নসরতশাহী বা নাসিরাবাদ নামের সৃষ্টি। মুসলিম যুগের উৎস হিসেবে নাসিরাবাদ নামটিও আজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোথাও উল্লেখ করা হচ্ছে না।
১৭৭৯-তে প্রকাশিত রেনেল এর ম্যাপে মোমেসিং নামটি বর্তমান ‘ময়মনসিংহ’ অঞ্চলকেই নির্দেশ করে। তার আগে আইন-ই-আকবরীতে ‘মিহমানশাহী’ এবং ‘মনমনিসিংহ’ সরকার বাজুহার পরগনা হিসাবে লিখিত আছে; যা বর্তমান ময়মনসিংহকেই ধরা যায়।
এসব বিবেচনায় বলা যায় সম্রাট আকবরের রাজত্ব কালের পূর্ব থেকেই ময়মনসিংহ নামটি প্রচলিত ছিলো। ব্রিটিশ আমলে জেলা পত্তন কালে ময়মনসিংহ অঞ্চলের সমৃদ্ধ জমিদারগণ সরকারের কাছে জেলার নাম ‘ময়মনসিংহ‘ রাখার আবেদন করলে সরকার তা গ্রহণ করে নেন। আবার অনেকে মনে করেন, ময়মনসিংহ নামকরণ করা হয় সম্রাট আকবরের প্রধান সেনাপতি মান সিংহের নাম অনুসারে। সেনাপতি মান সিংহকে সম্রাট আকবর এ অঞ্চলে পাঠান বার ভূইয়ার প্রধান ঈশা খাঁকে পরাজিত করার জন্য। সেনাপতি মান সিংহ ময়মনসিংহে ঘাঁটি স্থাপন করে।
পরবর্তীতে ঈশা খাঁর কাছে মান সিংহ পরাজিত হয়।তবে এই স্থানের ইংরেজি নাম (Mymensingh) দেখে এই অঞ্চলের মানুষ সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। My= আমার, Men=মানুষগুলো, Sing(h)=গান করে। এই অঞ্চলের মানুষ সাংস্কৃতিক অঙ্গনে খুব ভালো ছিল। তাই ইংরেজরা এই ভাবে নামকরণ করেন।
ময়মনসিংহের ইতিহাস
১ মে ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলা গঠিত হয় যার প্রথম কালেক্টর ছিলেন মিঃ এফ লি গ্রোস। এর আগে খাগডহর ইউনিয়নের বেগুনবাড়ীর কোম্পানির কুঠিসহ বিভিন্ন জায়গায় কাচারী বসত। কুঠি ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে বিলীন হলে শহরের উত্তর অংশে খাগডহরে কাচারী স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙ্গনের কারণে সেই উদ্যোগও ভেস্তে যায়।
পরবর্তীতে কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুরের দক্ষিণে কাওনা নদীর তীরে ‘দগদগা’ নামন প্রাচীন বাণিজ্যকেন্দ্রে জেলা শহর স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ঐ অঞ্চলের জমিদাররা এই সিন্ধানের বিরোধিতা করে। কর্তৃপক্ষ তাই ১৭৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেহড়া মৌজায় নাসিরাবাদ নাম দিয়ে জেলা শহরের পত্তন হয় ।
শহর স্থাপিত হওয়ার পর ৮ই এপ্রিল ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে পৌরসভা গঠিত হয় নাসিরবাদ মিউনিসিপ্যালিটি।বঙ্গদেশে এটি প্রথম এবং উপমহাদেশে এটি ছিল দ্বিতীয় পৌরসভা। মি. আরপর্চা ছিলেন পৌরসভার প্রথম অফিসিয়াল চেয়ারম্যান। প্রথম নন অফিশিয়াল চেয়ারউয়ান ছিলেন চন্দ্রকান্ত ঘোষ। কালেক্টরেট ভবন ছিল ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রবিন্দু।
১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে সরকারী ডাক ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে জেলা বোর্ড গঠন করা হয়। প্রথম সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র চালু করা হয় ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে। ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রথম মুদ্রিত পুস্তক প্রকাশিত হয় ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে। ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম ইংরেজী স্কুল।
ময়মনসিংহ জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে। জেলার প্রথম আদম শুমারী পরিচালিত হয় ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে। টেলিগ্রাফ অফিস স্থাপন ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে। । ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ চালু ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে, এবং ময়মনসিংহ-জগন্নাথগঞ্জ রেলপথ চালু হয় ১৮৬৫ সনে। ১৯০৫ সালে নাসিরবাদ নাম বদলে ময়মনসিংহ পৌরসভা নামকরণ হয়। ১৯১০ সালে পৌরসভার একতলা পাকা ভবন নির্মাণ হয় যেটি এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে।