এলএসডি মাদকের ভয়াবহতা জানতে হবে

এলএসডি মাদকের ভয়াবহতা জানতে হবে। বাংলাদেশে মাদক ব্যবসা এবং এর ব্যবহার এখন এক ‘ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে’ এবং ‘রক্ষণশীল অনুমান অনুযায়ী’ এখন দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৭০ লক্ষ। এটা ফিলিপিনের চাইতেও অনেক বেশি, কারণ ২০১৬ সালেও সেদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ছিল ১৮ লক্ষ যা আমাদের দেশে দাঁড়িয়েছে ৭০ লক্ষে।

সরকার যখন মাদক সম্পর্কে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করছে ঠিক তখনও এসে এলএসডির মতো ভয়ানক মাদকের সন্ধান মিলছে বাংলাদেশে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে LSD এর প্রভাবে এক বিশ্ববিদ্যালয় তরুণের মৃত্যুর ঘটনায় ভয়াবহ এই মাদক এর ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছে। তবে বাংলাদেশে এই মাদক নতুন হলেও বিশ্বে এই মাদক কিন্তু নতুন নয়।

রাই জাতীয় শর্স্যের গায়ে জন্মানো এক বিশেষ ধরনের ছত্রাক এর শরীরে এই Lysergic Acid উৎপন্ন হয়। সেই এসিডের রাসায়নিক সংশ্লেষ এর মাধ্যমে LSD তৈরি করা হয়। ১৯৩৮ সালে সুইজারল্যান্ডের রসায়নবিদ আলবার্ট হফম্যান সর্বপ্রথম LSD তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তারও পাঁচ বছর পর ১৯৪৩ সালে তিনি এলএসডি এর সাইকেডেলিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে পারেন। আলবার্ট হফম্যান নিম্ন রক্তচাপ ও শ্বাসপ্রশ্বাস উন্নত করার ঔষধ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই শক্তিশালী এই মাদক তৈরি করে ফেলেছিলেন।

১৯৫০ ও ষাটের দশকে মানসিক রোগ, বিষন্নতা, দুশ্চিন্তার চিকিৎসায় পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যবহার শুরু হয়।

১৯৭১ সালে জাতিসংঘ চিকিৎসার জন্য এটি ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। LSD বা Lysergic Acid Diethylamide এতটাই ক্ষতিকারক যে, এই মাদকের পরিমাণ মাইক্রোগ্রামে হিসাব করা হয়। অর্থাৎ, এই মাদক মাইক্রোগ্রাম‌ পরিমাণে সেবন করলে ও নেশা হয়। এক মাইক্রো গ্রাম হল এক গ্রামের ১০ লক্ষ ভাগের এক ভাগ।

LSD মাদক হিসেবে LSD বা Lysergic Acid Diethylamide ব্লটার কাগজে বিক্রি করা হয়। এই কাগজ জিব্বার উপরে বা নিচে রেখে এলএসডি সেবন করা হয়। তবে এই মাইক্রোগ্রাম পরিমাণ এলএসডি ও কোন একজন মানুষের নেশা করাতে সক্ষম।

LSD বা Lysergic Acid Diethylamide সেবনের পর মানুষের মস্তিষ্কের সেরোটোনিন নামক রাসায়নিক এর কার্যক্রম প্রভাবিত করে। যার ফলে মানুষের শ্রবণ এবং দর্শনেন্দ্রিয় অতি সক্রিয় হয়ে যায়। এজন্যই মানুষ LSD সেবনের পর অদ্ভুত রকমের আলো দেখতে পায় এবং শব্দ শুনতে পায়। LSD সেবনের পর কেউ আবার অস্বাভাবিক শব্দ শোনে, যেসব শব্দের বাস্তবে কোনো অস্তিত্বই নেই। এই অবস্থাকে বলে LSD Trip।

LSD Trip-এ থাকাকালীন সময়ে মানুষ অস্বাভাবিক আচরণ করে। যেখানে অনেকের মধ্যে আত্মঘাতী প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। এ ধরনের খারাপ অনুভূতি কে বলা হয় Bad Trip। আর Bad Trip এর কারণে মানুষ অমূলক ভয় পায়, মুহূর্তের মধ্যেই মারাত্মক দুশ্চিন্তায় ভোগে, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং নিজের ও অন্যের ক্ষতি করার প্রবণতা তৈরি হয়। এছাড়া LSD এর কারণে হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাত্রা, শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়।

LSD বা Lysergic Acid Diethylamide সেবনের আধাঘন্টার মধ্যে Trip শুরু হয়ে যায়। ব্যক্তি ভেদে সেটি ৬ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকে। তবে সেবনের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে কারো উপর এই সময় ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত ও হতে পারে। অনেকের মধ্যে LSD সেবনের পর চরম অনিদ্রা দেখা দেয়; কেউ কেউ আবার অতিরিক্ত ঘুমায়। বিষণ্নতায় ভোগা ব্যক্তিরা LSD সেবনের পর আরও বেশি বিষণ্নতায় ভুগতে পারে।

এছাড়া LSD সেবনের পর কেউ কেউ মনে করে তার শরীরে অতি মানবীয় শক্তি চলে এসেছে। এমন ঘটনা থেকেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এই মাদক সেবনের পর যেহেতু মানুষের মস্তিষ্ক আর স্বাভাবিকের তুলনায় কাজ করেনা এইজন্য মানুষ যা ইচ্ছা তাই করে। যেমন গাড়ি থেকে লাফ দেওয়া, নিজে নিজেকে আঘাত করা‌ ইত্যাদি।

LSD বা Lysergic Acid Diethylamide এর প্রভাবে মানুষ চরম ভাবে বিষন্নতায় ভোগে। এর কারণ হচ্ছে মানুষ সে সময় এমন কিছু দেখতে পায় যা বাস্তবে নেই এবং এমন সব শব্দ শুনতে পায় যা বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নেই। বলতে গেলে মানুষ এক রকম স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে তার সময় পার করে। স্বপ্নে যেমন মানুষের কোন নিয়ন্ত্রন থাকেনা; স্বপ্নের মধ্যে কোন ব্যক্তি যা ইচ্ছা তাই দেখে এবং স্বপ্ন দেখার মধ্যে কোন সিরিয়াল থাকে না।

যেখানে সবকিছু উল্টাপাল্টা। স্বপ্নের ভেতরে আপনি এমন সব জায়গা দেখতে পান যা বাস্তবে হয়তোবা আপনার চোখের সামনে নেই এবং এমন সব কাজ করে থাকেন যা বাস্তবে করা সম্ভব নয়। ঠিক এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে থাকে এলএসডি গ্রহণ করা ব্যক্তিরা। তারা সেই সময় বুঝতে পারে না তারা বাস্তব জীবনে রয়েছে নাকি কোনো স্বপ্নের জগতে রয়েছে। আর এখান থেকেই ঘটে দুর্ঘটনা।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ প্রথম মাদক হিসেবে এলএসডি গ্রহণ করে না। অর্থাৎ যারা অন্য মাদকে আসক্ত, তাদের ক্ষেত্রে LSD গ্রহণ করার প্রবণতা তৈরি হয়। কোন একজন সাধারণ ব্যক্তি হঠাৎ করেই এই মাদক গ্রহণ করার প্রতি আগ্রহী হয় না। পূর্বে অন্য কোন মাদকে আগ্রহী বা নেশাগ্রস্ত হয়ে থাকলে এই মাদকে সেই ব্যক্তি আসক্ত হয়ে যেতে পারে। তবে কারও ক্ষেত্রে এটি ভিন্ন ও হতে পারে।

হিরোইন বা ইয়াবা এর তুলনায় এলএসডি তুলনামূলকভাবে কম আসক্তিকর। তাই বলে এটি মোটেই নিরাপদ নয়। প্রচলিত মাদকের তুলনায় এটি হাজার গুণে শক্তিশালী। কেননা এই মাদক গ্রহণ করার পর মানুষ তার নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং সে বাস্তব-অবাস্তবের পার্থক্য ভুলে যায়।

LSD গ্রহণের পর কোন ব্যক্তির আরো বেশি বিষন্নতায় ভোগার কারণ হচ্ছে, সেই ব্যক্তি এই মাদক গ্রহণ করার পর এমন সব কিছু দেখতে পারে যা তার জন্য ভয়ানক হতে পারে। এছাড়া সে এমন সব শব্দের অনুভূতি পেতে পারে, যা তার জন্য শুনতে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। আর এসময় সে চাইলেও সেই জগত থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। এজন্য সে হঠাৎ করেই ভয় পেয়ে যেতে পারে এবং বিষণ্নতায় ভোগে।

এলএসডি সেবনের সবচাইতে ভয়াবহ দিক হচ্ছে Flashback; অর্থাৎ, LSD সেবনের কয়েকদিন, কয়েক মাস কিংবা কয়েক বছর পরে মাদক গ্রহণ ছাড়াই এলএসডি এর প্রভাব চলে আসতে পারে। একেই LSD-এর Flashback বলে। ‌ LSD গ্রহণের পর Flashback এর কারণে মান সমস্যা চলে আসতে পারে। অনেকেই এতে করে বাস্তব এবং অবাস্তব এর মধ্যে পার্থক্য ভুলে যায়। অর্থাৎ, জীবনে মাত্র একবার LSD গ্রহণ করলেও সারাজীবনে এর প্রভাব থেকে যায়। ‌

জীবনে যদি একবার LSD গ্রহণ করা যায় তবে ভবিষ্যতে জীবনে এর প্রভাব থাকার কারনে কোন এক সময় সেই ব্যক্তি বিপদে পড়তে পারে। হঠাৎ করেই কোন ব্যক্তি এর প্রভাবে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। যাতে করে অনেকেই জীবনের কোনো এক সময় গিয়েও বাস্তব এবং অবাস্তব এর মধ্যে পার্থক্য ভুলে যায়। যা কোন ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবনযাত্রা কে বাধাগ্রস্থ করে।

একটি মাদক খুব বেশি ভয়াবহ হলেই যে সেই মাদক বাদ দিয়ে অন্য মাদক গ্রহণ করা যাবে এমনটি নয়। বরং কোন মাদক ই আমাদেরকে সেবন করা যাবে না; অন্তত নিজের কথা চিন্তা করে। সবার ক্ষেত্রেই প্রায় প্রথমবার মাদক গ্রহণ করার জন্য দায়ী থাকে বন্ধুবান্ধব।

যেখানে আমাদের সমাজে দেখা যায় প্রথম মাদক হিসেবে ধূমপানকে বেছে নেয়। যা পরবর্তীতে অন্যান্য মাদক সেবনে উৎসাহী করে তোলে। ইয়াবা, ফেনসিডিল গ্রহণ করা ব্যক্তির এসব নেশা করার পেছনের গল্প প্রথমে ধূমপান থেকেই শুরু হয়। হয়তোবা প্রথমে অনেকে ভাবে আমি শুধুমাত্র বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করার জন্য খাব। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল তা হয়তোবা তার তখন খেয়ালে থাকেনা।

এমন হয়ে যায় যে, বর্তমানে আপনাকে নেশা না করলেই চলছে না। আর এই নেশা করার পেছনে আপনার হয়তো বা সঙ্গ দোষ ছিল। আপনি যাদের সাথে চলাফেরা করেছেন তারা আপনাকে নেশা করতে উৎসাহী করেছে। ‌কিন্তু বর্তমানে আপনাকে নেশা করার জন্য তারা অর্থ দিবেনা। নেশা করার ক্ষেত্রে বর্তমানে আপনার অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং শারীরিক ক্ষতির দুইটি হবে। মাঝখান থেকে আপনার কোন লাভই থাকলো না।

এই LSD মাদক বাংলাদেশে আসে মূলত বিদেশে যারা কাজের জন্য গেছেন কিংবা অনলাইন ব্যবসায়িক সাইডগুলোর মাধ্যমে। যাদের বিরুদ্ধে জরুরী পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণের আত্মঘাতী ঘটনাটি না ঘটলে হয় তো এই মাদক সম্পর্কে অনেকেই জানতে পারতো না যে কি ভয়ঙ্কর মাদক এলএসডি। মাইক্রোগ্রামে হিসাব করা হয় এমন একটি মাদক যা মানুষের জন্য এতটা ক্ষতিকর, তা ভাবাই অনেক আশ্চর্যজনক। ‌পরিমাণে কম হলেও এর প্রভাব কিন্তু মোটেও কম নয়। যা একজন মানুষকে বিকারগ্রস্ত করে দেওয়া এবং জীবননাশ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ‌মাদক যেটাই হোক তা অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই এটা সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে এবং মাদককে জিরো টলারেন্স নীতির আওতাভূক্ত করতে সরকারসহ সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।

লাইজু আক্তার
শিক্ষার্থী,
নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!