একজন কোটিপতি ভিক্ষুকের কাহিনি

একজন কোটিপতি ভিক্ষুকের কাহিনি। জগতে টাকার চেয়ে বড় বাহাদুর কেউ নেই, টাকার চেয়ে প্রয়োজনীয় কিছু নেই। টাকা হলে বাঘের দুধের চা খাওয়া যায়। রাধাকে নাচানো যায়। অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। তাই তো মানুষ টাকার পেছনে ছোটে। যেকোনো মূল্যে টাকা বানাতে চায়।

ছিলেন ডাকাতের সরদার। ডাকাতিতে ধরা পড়লে গণপিটুনির শিকার হন। ওই সময় দুই হাতের আঙুল ভেঙে দেওয়া হয়। সেখানে ক্ষত সৃষ্টি হলে দুই হাতের কবজি কেটে ফেলেন চিকিৎসক। পরে পেশা বদলে হয়ে যান ভিক্ষুক; বিশেষ করে প্রতিবছর হজের মৌসুমে সৌদি আরবে ভিক্ষাবৃত্তি করেন। ১৫ বছর ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্তান ও সৌদি আরব গিয়ে ভিক্ষা করে তিনি প্রায় কোটি টাকা আয় করেন। ভিক্ষার টাকায় নিজ গ্রামে কিনেছেন জমি। বর্তমানে ২০ বিঘা কৃষিজমির মালিক।

এই আলোচিত ব্যক্তিটি হচ্ছেন মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার মতিয়ার রহমান। যিনি এলাকায় ‘মন্টু ডাকাত’ নামে খ্যাত। ষাটোর্ধ্ব এই ব্যক্তি ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। এবার হজে গিয়ে ভিক্ষা করার সময় সৌদি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলে বিষয়টি জানাজানি হয়। কম খরচে ভারত হয়ে হজে যাওয়া সহজ হওয়ায় প্রতিবছর হজে যান মতিয়ার।

এ পর্যন্ত ১২-১৩ বার হজে গেছেন। প্রতিবছর ভিক্ষা করে দেশে ফিরে জমি কেনেন। মূলত হজ করতে নয়, ভিক্ষা করতেই যান। করোনার কারণে এবং সীমান্ত বন্ধ থাকায় গত দুই বছর হজে যাননি। এবার হজ করার নামে মদিনায় ভিক্ষা করতে গিয়ে সৌদি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। এরপরই তিনি আলোচিত হয়ে ওঠেন। ‘দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’ করার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ চলছে।

ডাকাতি থেকে পেশা বদল করে ভিক্ষুক বনে যাওয়া মতিয়ার ওরফে মন্টু ডাকাত দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করলেন কীভাবে? তিনি তো মামুলি কোনো ভিক্ষুক নন, ‘আন্তর্জাতিক মানের’ ভিক্ষুক। তাঁর ভিক্ষাবৃত্তির মানচিত্র থেকে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এমনকি সৌদি আরবও বাদ যায়নি। এসব দেশের মধ্যে সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গাটিও ঠিকঠাক চিনে গিয়েছিলেন তিনি। প্রতিবছর হজের মৌসুমে সৌদি আরবে ভিক্ষাবৃত্তি করেছেন। ১৫ বছর ধরে তিনি ভিক্ষাবৃত্তি চালিয়ে গেছেন এবং প্রায় কোটি টাকা আয় করেছেন। এই টাকা তিনি বিদেশে পাচার করেননি। দেশে আবাদি জমি কিনেছেন। এমন একজন ‘দেশপ্রেমিক’ ও কামেল ব্যক্তির বিরুদ্ধে ‘দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’ করার অভিযোগ আনা হচ্ছে কেন?

তা ছাড়া, ভিক্ষাবৃত্তি তো আর কোনো নিষিদ্ধ ব্যাপার নয়; বরং অতি প্রাচীন পেশা। পৃথিবীর সব দেশেই কম-বেশি ভিক্ষুক আছে। হয়তো তাদের ভিক্ষার পদ্ধতি ভিন্ন। তাহলে মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে কেন? তিনি তো অনেকের মতো ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করেননি, টাকা পাচার করেননি। এমনকি তিনি দেশে ভিক্ষাও করেননি। বিদেশে গিয়ে ভিক্ষা করেছেন। লাখ লাখ টাকা কামাই করেছেন। সেই টাকা তিনি সুইস ব্যাংকে না রেখে দেশে ফিরিয়ে এনেছেন। এ জন্য বরং তাঁকে ধন্যবাদ জানানো উচিত!

হ্যাঁ, ভিক্ষা করেও বড়লোক হওয়া যায়, অনেকে বড়লোক হয়। এ প্রসঙ্গে একটি পুরোনো গল্প মনে পড়ছে। স্টেশনের পাশে একটা লাইটপোস্টের নিচে বসে একজন বয়স্ক ব্যক্তি ভিক্ষা করছেন। লোকটির বড় বড় চুল-দাড়ি। তো একজন সহৃদয় ভদ্রলোক ভিক্ষুকটির দিকে একটা ১০ টাকার নোট বাড়িয়ে দিলেন। ভিক্ষুকটি মুখ তুলে নোটটি গ্রহণ করার কালে তাঁকে খুব পরিচিত মনে হলো। খানিকক্ষণ স্মৃতি হাতড়ে ভদ্রলোক বের করে ফেললেন ভিক্ষুকটির পরিচয়। বললেন, ‘আচ্ছা আপনি না “বড়লোক হওয়ার হাজার উপায়” নামে একটা বই লিখেছিলেন? আপনাকে নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় অনেক হইচই হয়েছিল?’

ভিক্ষুকটি কুণ্ঠিত হয়ে বললেন, ‘আপনি ঠিকই ধরেছেন।’

এবার ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, ‘কিন্তু আপনি ভিক্ষা করছেন কেন?’

ভিক্ষুকটি জবাব দিলেন, ‘ওই এক হাজার উপায়ের মধ্যে ভিক্ষে করাটাও একটি উপায়!’

ভিক্ষুক হওয়া, ভিক্ষুক সাজা, ভিক্ষুকের মতো আচরণ করার অনেক কারণ আছে। এর মধ্য দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি হয়। বড়লোকও হওয়া যায়। জগদ্বিখ্যাত বড়লোক বিল গেটস বলেছেন, ‘যখন তোমার পকেটভর্তি টাকা থাকবে, তখন শুধু তুমি ভুলে যাবে যে “তুমি কে”; কিন্তু যখন তোমার পকেট ফাঁকা থাকবে, তখন সমগ্র দুনিয়া ভুলে যাবে “তুমি কে”!’ জগতে টাকার চেয়ে বড় বাহাদুর কেউ নেই, টাকার চেয়ে প্রয়োজনীয় কিছু নেই। টাকা হলে বাঘের দুধের চা খাওয়া যায়। রাধাকে নাচানো যায়। অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। তাই তো মানুষ টাকার পেছনে ছোটে। যেকোনো মূল্যে টাকা বানাতে চায়।

আসলে মানুষ কেবল অভাবের কারণেই ভিক্ষা করে না। বড়লোক হওয়ার জন্যও অনেকে ভিক্ষা করেন। অনেকে আবার নিছক কাজের প্রতি আলসেমি থেকেও এ পথে নামেন। বাংলাদেশে যে পরিমাণ মানুষ তাঁদের অসহায়ত্বের জন্য ভিক্ষা করেন, তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ ভিক্ষা করেন নিজেকে কষ্টকর জীবিকা নির্বাহের ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য। ভিক্ষা অনেকের কাছে ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভিক্ষা করতে যেমন পুঁজি লাগে না, তেমনি অনিশ্চয়তাও নেই। ভিক্ষা একটি লাভজনক পেশা। যে পেশায় ন্যূনতম বিনিয়োগ নেই, পরিশ্রম নেই। শুধু নাটক বা ড্রামাটা ঠিকঠাক করতে পারলেই মিশন সাকসেসফুল (করোনাকালে সরকারি প্রণোদনা পেতে আমাদের দেশের ‘বড় বড় ভিক্ষুক’রা কী কাণ্ডটাই না করেছেন)!

আয়করবিহীন উপার্জনের এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চান কে? বাংলাদেশেই অনেক ভিক্ষুক আছেন, যাঁরা স্বাবলম্বী হয়েও ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়েননি। নিয়মিত ভিক্ষার টাকায় বাড়ি বানাচ্ছেন, জমি কিনছেন। সন্তানদের জন্য বানিয়ে যাচ্ছেন অর্থ-সম্পত্তি!

ভিক্ষা করাকে এখন কেউ বলেন পেশা, কেউ বলেন ব্যবসা। দুটোই সত্য। তবে ভিক্ষুক যে এক প্রকারের নয়, দুই প্রকারের। বলা যায় দুই শ্রেণির, এই সত্যটা মেনে নিলে ঘটনাটি বুঝতে সুবিধা হবে। ধনীরাও ভিক্ষুক হন বৈকি। তাঁরা তদবির করেন, তোষামোদ করেন, ঘুষ দেন, খাতির জমান, করুণা চান; তাঁদের হাতও কর্মীর হাত নয়, তাঁরাও উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত নন। তবে ধনী ভিক্ষুক ও গরিব ভিক্ষুকের মধ্যে মস্ত একটা ব্যবধান রয়েছে। না, ধনদৌলতের ব্যবধানের কথা বলছি না; সেই দূরত্বটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।

পার্থক্যটা অন্য জায়গায়। সেটা হলো ধনীদের ‘অনুৎপাদক হস্ত’ কেবল যে অন্যের কাছে উপকার, করুণা, উচ্ছিষ্ট ইত্যাদির জন্য প্রসারিত হয় তা কিন্তু নয়; তাঁদের ওই হাত দিয়ে তাঁরা লুণ্ঠন, প্রতারণা, টাকা পাচার, শোষণ, নির্যাতন—সবকিছুই করে থাকেন। গরিব ভিক্ষুকেরা এই সবকিছু পারেন না; তাঁরা কেবলই দু-চার টাকা দান-খয়রাত পাবেন বলে আশায় আশায় থাকেন। থাকতেই হবে, এ ছাড়া তো তাঁদের উপায় নেই।

ধনী ভিক্ষুকেরা ক্রমাগত স্ফীত হন, গরিব ভিক্ষুক মিইয়ে যান। ধনী ভিক্ষুকেরা বৈশ্বিক পর্যায়েও ভিক্ষা করে থাকেন, তাঁদের জন্য বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি রয়েছে। আর ব্যবসা? গরিব মানুষ ভিক্ষাবৃত্তিকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছেন—এ কথাটায় একটা মর্মস্পর্শী নিষ্ঠুরতা রয়েছে। ব্যবসায়ে পুঁজি দরকার হয়। ভিক্ষুকের হাতে তো কোনো পুঁজি নেই, ‘হৃদয়বান’ মানুষদের করুণা আকর্ষণের জন্য কাতর মিনতি জানানো ছাড়া। তবে হ্যাঁ, তাঁদের দারিদ্র্য এখন বিশ্ববাজারে বেশ ভালো বাজার পাচ্ছে, এটা ঠিক। পুঁজিবাদী বিশ্ব একদিকে দারিদ্র্য সৃষ্টি করে, অন্যদিকে নিজের বিবেককে কিছুটা প্রক্ষালন ও দেশের জনমতকে সান্ত্বনাদানের অভিপ্রায়ে দারিদ্র্য বিমোচনের কর্মসূচিও হাতে নেয়। ওইখানে গরিব দেশের উদ্যোগী ধনীরা ব্যবসার একটা সুযোগ পেয়ে যান।

বাস্তবতা হচ্ছে, প্লেনে চড়েও অনুন্নত দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিরা ধনী দেশে ‘ভিক্ষা’র জন্য ধরনা দেন। বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমান বলেছিলেন, ‘যখন বিদেশ সফরে যাওয়ার জন্য প্লেনে উঠি, তখন আমার দুচোখে পানি এসে যায়। আমি জানি, ভিক্ষা করতে বিদেশ যাচ্ছি।’ কিন্তু এখন এমন সময় বদলেছে। এখন আর বিদেশ থেকে ‘ভিক্ষা’ আনতে যেতে হয় না অর্থমন্ত্রীকে।

মতিয়ার রহমান একজন আদর্শবান ভিক্ষুক। উন্নত রুচির ভিক্ষুক। দেশপ্রেমিক ভিক্ষুক। কিন্তু এখন তো বিধির বিধান বদলে যাচ্ছে। বড়লোক ভিক্ষুকদের দৌরাত্ম্য ক্রমেই বাড়ছে। তাঁদের চাপে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন গরিব ভিক্ষুকেরা। এমনকি মতিয়ার রহমানের মতো ভিক্ষুকেরাও। এই ধারা কত দিন চলবে—কে জানে!

Leave a Comment

error: Content is protected !!