সিলেটের ঐতিহাসিক ক্বিনব্রিজ নিয়ে কবি মাহবুব রুমন এর দীর্ঘ কবিতা “ক্বিনব্রিজ”

ক্বিনব্রিজ –মাহবুব রুমন

আমার যেখানে জন্ম
সেখানে ব্যাঙের বিয়ে হত মহাসমারোহে
খিজিরের আনুকূল্য কামনায়
নানান উপাদেয় খাবার উৎসর্গ করা হতো
বাহারি মশালে সেজে পাড়ার ছেলে বুড়ো
পৌষ সংক্রান্তির হুল্লোরে মেতে থাকতো,
কুজাগরি রাতে পাড়াময় সাড়া পড়ে যেতো
আরো কত কি! যেন উৎসব লেগেই থাকতো।

আমার জন্ম অল্পে তুষ্ট এক সুখী জনপদে
বীর পিতৃপুরুষরা যেখানে আহারের খোঁজে- দেশ দেশান্তর ঘুরে এসে গল্পের আসর জমাতো।
প্রিয় ধুলোর স্থর পরনের গামছায় ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে নিয়ে;
সেই গামছা বিছিয়ে গোল করে বসে যেত সদলবলে;
তাস,তালুক,দাবা কিংবা ষোল-কটি নিয়ে।
কখনোবা তারচেয়েও রাজকীয় কোন খেলায়।
রাজ্যের তৃপ্তি ছিল খোলা উদ্যানে,হাওয়ায়।

সেখানে অনাদি-অনন্তকাল এর তত্ত্ব-কথা
বলে যেত আমাদের বীর পুরুষরা সেই আলোচনা-আসর অ্যাকাডেমিয়া,
লাইসিয়াম, জ্ঞান-বিশ্বকোষের চেয়ে
কোন অংশে কম ছিলনা।

আলোচ্য জলসার শ্রেষ্ঠাংশ জুড়ে ছিল,ক্বিনব্রিজ
কালের কিংবদন্তি জোড়া সেই ক্বিনব্রিজ
কত গল্প- কল্পনা তাকে ঘিরে।
ব্রিজের দু পাশে মানুষ কোমর বেধে,
মাথা বেঁধে অপেক্ষায় থাকে দ্বিচক্রযান,
ত্রিচক্রযান, রিক্সা ঠেলাগাড়ি প্রভৃতি- ঠেলে-ঠুলে পার করে দেবে অতি উচ্চ;
কল্পনার সেই ব্রিজ কোন আদি, অন্ত নেই তার;
এতটুকু ঠেলে পার করে দিলেই পুরো পাঁচ টাকা।

সাক্ষাৎ কল্পনার সাথে বাচা!
উপরি হিসেবে কচকচে রোজগার হাতে হাতে;
এমনও হয় কখনো?
তাই নগরে নগরে ছড়িয়ে পড়েছে তার কিংবদন্তি

ব্রিটিশদের তৈরি !
সারা বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের দামামা বাঁধলো যেবার;
এই কীর্তি তারও আগের।

কালের আবর্তে কেটে গেছে
যুগ যুগান্তর সময়ের পরিক্রমায়
একদিন কত রাজপথ পার হয়ে
৩৬০ আউলিয়ার নগরীতে থিতু হতে হলো
আমাদের প্রিয় পড়শী হয়ে উঠলো সেই ক্বিনব্রিজ
বিরাট ইতিহাস বুকে নিয়ে
সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ।

নিচ দিয়ে বয়ে যায় যৌবনবতী সুরমা
,পিচঢালা রাজপথ কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ,
লরী মোটর আরো কত কি!

সুরম্য এক আবাসন রাষ্ট্রীয় তরিকায় গড়ে উঠেছে,
রাজকীয় আভিজাত্য যার গতরজুড়ে লেপ্টে থেকে।
ঠিক তার সামনেই এই ব্রিজ।
তার আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে ছিন্নমূল হকারদের আস্তানা,
কুলহীন,গাঁজাধারি,সমাজচ্যুত কত দ্বিপদ,
চতুস্পদের পরম শান্তির শয্যা এই ব্রিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ

দিনভর চায়ের দোকানের তুমুল ভীড়,
কতজনের সিগারেট ফোকা ধোঁয়ায় ভেসে যায় কত অপ্রাপ্তি ;
রাতের প্রসন্ন সুরমার ঢেউয়ে কত নামহীন টোকাইয়ের পরম আপনজন
কত ভাসমান ক্লান্ত পায়ের ছাপ পরে থাকে এই আঙিনায়,
স্নিগ্ধ ভোরে এমনি ছুটে চলে নিরবতা ভেঙে
পড়ন্ত বিকেলে যেন মেলা জমে উঠে তরুণ গোধূলিতেও ক্লান্তি নেই।

রাতের গভীরে চুপচাপ দরজার বাইরে চেয়ে দেখেছি
ঘুমহীন কত চোখের আত্মীয় যেন এই ব্রিজ
সবাইকে কেমন নিজের করে নিয়েছে!
প্রহর থেকে প্রহরে, মানুষ আসে মানুষ যায়
যে যার প্রয়োজন সেড়ে ফিরে যায় নীড়ে
শুধু ক্বিনব্রিজ কখনো ঘুমায় না!
দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে, গৌরবের ইতিহাস হয়ে;
কালের কিংবদন্তি জোড়া ক্বিনব্রিজ।

কবি পরিচিতি
মাহবুবুর রহমান রুমন
সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট

Leave a Comment

error: Content is protected !!