তাপস পাল- একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি

আফজালুর ফেরদৌস রুমনঃ চলে গেলেন বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেতা তাপস পাল। ভোররাতে মুম্বইয়ের বেসরকারি হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হলেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৬১ বছর।

মুম্বইয়ে মেয়ের কাছে গিয়েছিলেন তাপস। কলকাতায় ফেরার সময় বুকে যন্ত্রণা অনুভব করেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে জুহুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ভোর চারটে নাগাদ তাঁর মৃত্যু হয়। পরিবার সূত্রে খবর, দীর্ঘদিন ধরে স্নায়ুর রোগে ভুগছিলেন এই অভিনেতা। কথা বলা ও চলা-ফেরায় সমস্যা ছিল কিছুদিন ধরেই।

১৯৫৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর হুগলির চন্দননগরে জন্ম তাপস পালের। ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ। কলেজে পড়াকালীন নজরে পড়েন পরিচালক তরুণ মজুমদারের। মাত্র ২২ বছর বয়সে মুক্তি পায় তাপস পাল অভিনীত প্রথম ছবি ‘দাদার কীর্তি’। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। একের পর এক হিট, সুপারহিট ছবি উপহার দিয়েছেন দর্শকদের। তাপস পাল অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে ‘সাহেব’, ‘গুরুদক্ষিণা’ ‘অনুরাগের ছোঁয়া’, ‘পারাবত প্রিয়া’, ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ অন্যতম।

তাপস পাল ‘সাহেব’ চলচ্চিত্রের জন্য ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পান ১৯৮১ সালে। বাংলার পাশাপাশি তাপস পাল অভিনয় করেছেন বেশ কিছু হিন্দি ছবিতেও। বলিউডের তৎকালীন জনপ্রিয় অভিনেত্রী মাধুরী দীক্ষিতের বিপরীতে অভিনয় করেছেন ‘অবোধ’ ছবিতে। চলচ্চিত্রে দাপুটে পদচারণার পর যোগ দেন রাজনীতিতে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর লোকসভা থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের লোকসভার সাংসদ ছিলেন তাপস পাল।

বাংলা ছবিতে চিরদিনই পাশের পাড়ের নিরীহ শান্ত ছেলে বলে পরিচিত ছিলেন তাপস। আসলে এ ধরনের চরিত্রের মাধ্যমেই বাংলা সিনেমা জগতে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। বাংলা সিনেমায় ‘দাদার কীর্তি’-র সেই সরল সাদাসিধে ছেলের চরিত্রে তাপসের অভিনয় আজও দর্শকদের স্মৃতিতে অম্লান। ‘সাহেব’ সিনেমায় যৌথ পরিবারের কর্মসংস্থানহীন অবহেলার শিকার ছোট ছেলের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বোনের বিয়ের জন্য অর্থ যোগাড় করে বৃদ্ধ বাবার পাশে দাঁড়ানোর কাহিনী আজও বাঙালি দর্শকদের চোখে জল এনে দেয়। পাশের বাড়ির ছেলের ইমেজ নিয়ে বাংলা সিনেমায় নিজের স্বতন্ত্র পরিচিত গড়ে তোলেন তাপস।

তবে সেই পরিচিতির মধ্যেই নিজেকে বেঁধে রাখেননি তাপস। সেই ইমেজ ভেঙে বেরিয়েও সাফল্য পেয়েছেন তিনি। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মতো পরিচালকের ‘উত্তরা’ ও ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ সিনেমায় তাঁর অভিনয় দেখেছেন দর্শকরা।

তপন সিনহার ‘বৈদুর্য রহস্য’-র মতো থ্রিলারেও তাপসের অভিনয় দর্শকদের প্রশংসা আদায় করে নিয়েছিল। ১৯৮৪-তে দীপরঞ্জন বসুর ‘পারাবত প্রিয়া’। এই সিনেমায় তাপসের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন মহুয়া রায়চৌধুরী ও দেবশ্রী রায়।

১৯৮৬-তে তরুণ মজুমদারের ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’। এই সিনেমায় তাপসের বিপরীতে ছিলেন দেবশ্রী।১৯৮৬-তে জওহর বিশ্বাসের ‘অনুরাগের ছোঁয়া’। এই সিনেমায় দ্বৈত ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল তাপসকে। তাঁর বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন মহুয়া রায়চৌধুরী।১৯৮৮-তে তরুণ মজুমদারের ‘আগমন’। এই সিনেমায় তাপসের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন সন্ধ্যা রায়, দেবশ্রী রায়।

১৯৮৭-তে অঞ্জন চৌধুরীর ‘গুরুদক্ষিণা’। এই সিনেমায় তাপসের সঙ্গে অভিনয় করেন শতাব্দী রায়, রঞ্জিত মল্লিক।১৯৯০-এ তরুণ মজুমদারের ‘আপন আমার আপন’। এই সিনেমায় তাপস পালের সঙ্গে অভিনয় করেন শতাব্দী রায়।২০০০-এ বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘উত্তরা’। ২০০২-এ বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘মন্দমেয়ের উপাখ্যান’।বাংলার পাশাপাশি তাপস পাল অভিনয় করেছেন হিন্দি ছবিতেও।

মুনমুন সেন, শতাব্দী রায়, ইন্দ্রাণী হালদার, দেবিকা মুখোপাধ্যায়, রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ বাংলার প্রায় সমস্ত নায়িকার সঙ্গেই এরপর জুটি বেঁধে জনপ্রিয় ছবি উপহার দেন দর্শকদের। তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের পাশাপাশি অঞ্জন চৌধুরী, হরনাথ চক্রবর্তীর মতো জনপ্রিয় কমার্শিয়াল ছবির পরিচালকরদেরও অতি প্রিয় অভিনেতা ছিলেন তিনি।

অভিনয় করেছেন রাখী গুলজার, সুধা চন্দ্রন, মন্দাকিনীর মতো একাধিক মুম্বই অভিনেত্রীদের সঙ্গে। তবে জুটি হিসেবে দেবশ্রী রায়ের সাথেই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় এবং ব্যবসাসফল সিনেমা উপহার দিয়েছেন তাপস পাল। উত্তমকুমার-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আজীবনের দ্বৈরথ একসময় আট, নয়ের দশকে দেখা গেছিল তাপস পাল-প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে।

রাজনৈতিক জীবনে নানা কারণে বিতর্কিত হন তাপস। পশ্চিমবঙ্গের আলোচিত চিটফান্ডকাণ্ডে নাম আসে তার। ২০১৬ সালে রোজভ্যালিকাণ্ডে গ্রেপ্তার হন তিনি, পরে ২০১৮-য় জামিন পান।মৃত্যুকালে স্ত্রী নন্দিনী পাল ও কন্যা সোহিনী পালকে রেখে গেছেন তিনি। তার মৃত্যুতে কলকাতার সিনেমা পাড়া টালিগঞ্জে শোকের ছায়া নেমে এসেছে বলে জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যম।

Leave a Comment

error: Content is protected !!