দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৭৯

দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৭৯, বাংলাদেশে ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জয় লাভ করে; তারা জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২০৭টি আসন লাভ করে। মোট ভোট সংগৃহীত হয়েছিল ৫১.৩%।

দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৭৯


← ১৯৭৩ ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ ১৯৮৬ →

জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের
সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার জন্য প্রয়োজন ১৫১টি আসন

নিবন্ধিত ভোটার ৩,৮৩,৬৩,৮৫৮
ভোটের হার ৫১.৩ হ্রাস ৩.৮ শ
Ziaur Rahman 1979.jpg বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ব্যাজ.svg
নেতা/নেত্রী জিয়াউর রহমান আসাদুজ্জামান খান
দল বিএনপি আওয়ামী লীগ
নেতা হয়েছেন ১৯৭৮ ১৯৭৯
সর্বশেষ নির্বাচন নতুন ২৯৩ আসন
আসনে জিতেছে ২০৭ ৩৯
আসন পরিবর্তন বৃদ্ধি ২০৭ হ্রাস ২৫৪
জনপ্রিয় ভোট ৭৯,৩৪,২৩৬ ৪৭,৩৪,২৭৭
শতকরা ৪১.২% ২৪.৫%

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পূর্বে
জিয়াউর রহমান
বিএনপি
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী
শাহ আজিজুর রহমান
বিএনপি

 

ফলাফল

দল ভোট % আসন +/-
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ৭,৯৩৪,২৩৬ ৪১.২ ২০৭ নতুন
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৪,৭৩৪,২৭৭ ২৪.৫ ৫৪
বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ১,৯৪১,৩৯৪ ১০.১ নতুন
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ৯৩১,৮৫১ ৪.৮
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (মিজান) ৫৩৫,৪২৬ ২.৮ নতুন
ন্যাপ(মুজাফ্‌ফর) ৪৩২,৫১৪ ২.২ নতুন
বাংলাদেশ গণ ফ্রন্ট ১১৫,৬২২ ০.৬ নতুন
বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল (মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট) ৭৪,৭৭১ ০.৪ নতুন
বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ৬৯,৩১৯ ০.৪
জাতীয় একতা পার্টি ৪৪,৪৫৯ ০.২ নতুন
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ৩৪,২৫৯ ০.২ নতুন
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ৯৩০,৫৮১ ৪.৮
স্বতন্ত্র ১,৯৬৩,৩৪৫ ১০.২ ১১
অবৈধ/খালি ভোট ৪০২,৫২৪
মোট ১৯,৬৭৬,১২৪ ১০০ ৩০০
উৎস: Nohlen et al.

বাংলাদেশে নির্বাচন: ১৯৭৩ থেকে ২০১৮: কোন নির্বাচনের কী ফল

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল নির্বাচনের ফল মেনে না নেয়াকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী যদি ১৯৭০-এর নির্বাচনের ফল মেনে নিত, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো। দুর্ভাগ্যজনক দিক হচ্ছে- বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গণতন্ত্র স্থায়িত্ব লাভ করেনি, কিন্তু গণতন্ত্রের নামে এ দেশের মানুষ নানা কিসিমের নির্বাচন দেখেছে। এর মধ্যে বিরোধী দলবিহীন একতরফা নির্বাচন থেকে শুরু করে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার মতো নির্বাচন ছিল। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ থেকে শুরু করে এখন নির্বাচনের মাঠ থেকে বিরোধী দলের প্রার্থীদের সরিয়ে দেয়ার নির্বাচনও হচ্ছে।

স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম নির্বাচন ছিল বিতর্কিত। দৃশ্যত এটি ছিল একদলীয় নির্বাচন। ক্ষুদ্র বিরোধী শক্তিকে হুমকি মনে করেছিল ক্ষমতাসীন মহল। পাকিস্তানের শাসকদের মেনে না নেয়া পাকিস্তানের কাঠামোয় অনুষ্ঠিত ’৭০-এর শেষ নির্বাচনে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদে নির্বাচিত লোকদের নিয়ে গণপরিষদ গঠন করে তাতে ১৯৭২-এর সংবিধান পাস করা হয়।

সেই সরকারের অধীনে স্বাধীন দেশে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। এই নির্বাচনে ১৪টি দলের এক হাজার ৯১ জন প্রার্থী থাকলেও আওয়ামী লীগ শুরুতেই ১১টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। বাকি ২৮৯ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এক কোটি ৯৩ লাখ বা ৫৫ শতাংশ প্রদত্ত ভোটের মধ্যে এক কোটি ৩৮ লাখ বা ৭৩ শতাংশ ভোট নিয়ে আওয়ামী লীগ ২৮২ আসনে জয়ী হয়। আওয়ামী লীগের ছাত্রলীগ ভেঙে সিরাজুল আলম খানের তৈরি করা জাসদ ২৩৭ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সোয়া ১২ লাখ বা ৬.৫২ শতাংশ ভোট আর একটি আসন পায়। আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগ পায় একটি আসন। ১২০ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী ৫ শতাংশ ভোট ও পাঁচটি আসন লাভ করে।

স্বাধীন দেশে প্রথম সংসদীয় পদ্ধতির নির্বাচনেই ১৯৭৩ সালে ভোট কারচুপির নজির ব্যাপক প্রকৃতি লাভ করেছিল। তাতে এ দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ শুরুতেই মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ জন্মের পরে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচন যদি নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হতো, তাহলে এ দেশের গণতন্ত্রচর্চার ইতিহাসও অন্যরকম হতো। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মোকাবেলা করার মতো কোনো প্রার্থী না থাকা সত্ত্বেও দলটি নির্বাচনে অসদুপায়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। কমপক্ষে ১৫টি নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগ মারদাঙ্গা, এজেন্ট হাইজ্যাক ও ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটায়। এ প্রবণতাই পরে নির্বাচন গুলোতে ঘটতে থাকে।

১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান একটি গণভোটে তার ক্ষমতাকে বৈধ করার জন্য জনসমর্থন চান। তাতে ৮৮ দশমিক ৫ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে আসে বলে সরকারি বার্তা সংস্থা প্রচার করে। ১৯৭৮ সালে সামরিক শাসন থেকে সংবিধানসম্মত রাষ্ট্রপতি পদে উত্তরণের জন্য জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের হয়ে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আয়োজন করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্থপতি জেনারেল (অব:) ওসমানী এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের প্রার্থী হিসেবে। এ নির্বাচনে ভোটার হাজির হয় ৫৪ শতাংশ। জিয়াউর রহমান নিজ পক্ষে দেয়া ৭৭ শতাংশ ভোট পান। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার পর জিয়াউর রহমান রাজনীতিক হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেন। ১৯৭৯ সালের এ নির্বাচনে তিন কোটি ৮৩ লাখ ভোটারের মধ্যে এক কোটি ৯৭ লাখ ভোটার বা ৫০ শতাংশ ভোট দিয়েছিল বলে হিসাব আছে।

২৯টি দলের দুই হাজার ১১৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে বিএনপি লাভ করে ২০৭টি। আওয়ামী লীগ (মালেক) ২৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩৯টি আসনে জয়ী হয়। আওয়ামী লীগ (মিজান) শূন্য দশমিক ৩৬ শতাংশ ভোট পেয়ে দু’টি আসন পায়, মুসলিম লীগ ও আইডিএল ২৬৬ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১০ শতাংশ ভোট এবং ২০টি আসন পায়। জাসদ ২৪০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৫ শতাংশ ভোট ও আটটি আসন পায়। ন্যাপ (মো:) কুঁড়েঘর নিয়ে সোয়া ২ শতাংশ ভোট ও একটি আসন, একতা পার্টি একটি আসন লাভ করে। মজার ব্যাপার হলো- এই নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীদের অনেকে অভিযোগ করেন, সরকার তাদের ইচ্ছাকৃতভাবে পরাজিত করে বিরোধী দলকে আসন দিয়েছে। ৪২২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী ১০ শতাংশ ভোট ও ১৬টি আসন পান। সব মিলিয়ে এটাই ছিল প্রথম বড় বিরোধী দল সজ্জিত সংসদ।

মনে রাখতে হবে, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের পর সাতজন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য সংসদে গ্রুপ গঠনের অনুমতি পাননি। আর ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি একদলীয় বাকশাল শাসন কায়েমের পর এই সাতজনকে বাকশালের সদস্য পদ গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছিল। তখন আওয়ামী লীগের দু’জন এমপি পদত্যাগ করে তার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তারা হলেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ও জেনারেল এম এ জি ওসমানী। ’৭৩-এ সংসদীয় গণতন্ত্রের সম্ভাবনা তিরোহিত হয়। ’৭৯-এর সংসদের মধ্য দিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র একটি কার্যকর রূপ লাভ করে। এটাই সম্ভবত বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে জিয়াউর রহমানের বড় সার্থকতা।

১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর বিপথগামী সদস্যরা হত্যা করে। তার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এ দেশ গণতন্ত্রে উত্তরণে আবার এক ধাপ হোঁচট খায়। জেনারেল এরশাদের তত্ত্বাবধানে বিচারপতি আবদুস সাত্তারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সম্পন্ন হয়। ১৯৮১ সালের নির্বাচনে ৫৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে আসে। এ ভোটের সাড়ে ৬৫ শতাংশ ভোট পেয়ে আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাত পোহাতেই সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতার অধীশ্বর হয়ে যান।

এরশাদ তার ক্ষমতার বৈধতার জন্য নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ভোট কারচুপিতে ধীমান এ প্রেসিডেন্ট সব রেকর্ড ভঙ্গ করেন। তিনি ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি দিলেন ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি। তাতে তার সরকারের বিরুদ্ধে তেজি রাজনৈতিক বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। তিনি এই বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের জন্যও নির্বাচনের ভাবনা জোরদার করেন। ধরে নিলেন বিক্ষোভের একাংশ তাকে সংসদ নির্বাচন করতে বলছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তখন বড় দুই রাজনৈতিক দল। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন চাইলেন। এরশাদ কিছু কনসেশন দিয়ে ২৬ এপ্রিল নির্বাচনের দিন স্থির করলেন। রাজনৈতিক দলগুলো স্বৈরাচারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না, এমন ঘোষণা প্রকাশ্যে দিলো। কিন্তু হঠাৎ করে এক রাতে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে বসল। নির্বাচনে অংশ নিলো জামায়াত। বিএনপির নেতৃত্বে সাত দল ও বাম ধারার পাঁচ দল ১৯৮৬ সালের নির্বাচন বর্জন করে।

নির্বাচন হয়েছিল রামদা উঁচিয়ে, বন্দুক ও বল্লম হাতে ভোটকেন্দ্র থেকে প্রতিপক্ষকে তাড়া করার এক চর দখলের লড়াইয়ের মতো। ঢাকার ডেমরা থেকে আওয়ামী লীগের তৎকালীন ডাকসাইটে নেতা ড. কামাল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে একজন এরশাদভক্ত তরুণের কাছে পরাজিত হন। ভীতি প্রদর্শন, হিংসাত্মক কার্যকলাপ, চরম নৈরাজ্য ছিল এ নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য। নির্বাচনের পর সংবাদপত্র খবর দিলো ১৫ জন মানুষ খুন হয়েছে, ৭৫০ জনকে হাত-পা কেটে জখম করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি উভয় দলই পরস্পরকে ভোট ডাকাত বলে অভিহিত করল।

মূলত এ নির্বাচনের পর থেকে নির্বাচন কারচুপি, ভোট জালিয়াতি, ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যুর মতো শব্দ রাজনীতিতে হাজির হলো। হালে যোগ হয়েছে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং।

এরশাদের প্রশাসন ৫৪ শতাংশের বেশি ভোটার ভোট দিয়েছিল বলে জানিয়েছিল। স্বাধীন পর্যবেক্ষকদের ধারণা, প্রকৃতপক্ষে ১৫ শতাংশের বেশি ভোটার ভোটকেন্দ্রের ধারে-কাছে আসেনি। নির্বাচনের ফল দাঁড়াল ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এক কোটি ২১ লাখ ভোট নিয়ে ১৫৩ আসনে বিজয়ী হয় জাতীয় পার্টি। ২৫৬ আসনে নেমে ৭৫ লাখ ভোট সংগ্রহ করে ২৬ শতাংশ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ ৭৬ আসন পায়। ৪ শতাংশ ভোট নিয়ে ১০টি আসন পায় জামায়াত। মনি সিংহের কমিউনিস্ট পার্টি আড়াই লাখ ভোট নিয়ে পাঁচটি আসন লাভ করে। মো: ন্যাপ পায় দু’টি, ন্যাপ, বাকশাল তিনটি, জাসদ চারটি, জাসদ (সিরাজ) তিনটি, মুসলিম লীগ চারটি, ওয়ার্কার্স পার্টি তিনটি ও স্বতন্ত্র থেকে ৩২টি আসন পায়।

এরশাদের গড়া নির্বাচনে যোগ দিয়ে এ সুখের ঘরে যারা গিয়েছিলেন, তারা বেশি দিন থাকতে পারেননি। অন্য দিকে এ নির্বাচন এরশাদের ক্ষমতার জন্য কাল হয়ে উঠেছিল। সুখের সংসদ ছেড়ে বিরোধী দল বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয় ১৯৮৭ সালে। বেরিয়ে আসার আগে একটা পার্লামেন্টারি ক্যু ঘটানোর চেষ্টা চলে। ১৯৮৭ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে। ১৯৮৭ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে হরতাল, অবরোধ ও বিক্ষোভের মুখে এরশাদ বিরোধী দলের দুই নেত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে স্বগৃহে অন্তরীণ করেন। ১৯৮৭ সালের ২৭ জুন দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সংসদ ভেঙে দিয়ে এরশাদ সংসদ থেকে বিরোধী দলের পদত্যাগ বন্ধ করেন। এ সময় ঘোষিত হয়, ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

এবার এরশাদের কৌশল ব্যর্থ হয়। বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াত ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। জাতীয় পার্টি ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে সেই বর্জনের প্রতিশোধ নিয়েছে বলেই কোনো কোনো মহল মনে করে।

১৯৮৬ সালের নির্বাচনের কাণ্ডকারবারে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপরই মানুষের কোনো বিশ্বাস ও ভক্তি ছিল না। রাজনীতির এক রহস্যপুরুষ সিরাজুল আলম খানের কিছু বাঘের বাচ্চা এ নির্বাচনে অংশ নেন। যাদের লক্ষ্য ছিল পার্লামেন্টে বিরোধী দলের সার্কাস দেখানোর মহড়া দেয়া। আটটি রাজনৈতিক দলের ৯৭৭ জন প্রার্থী ও ২১৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন করা হয়েছিল।

প্রকৃত ভোটার হাজিরা ছিল ১ শতাংশের সামান্য কিছু বেশি। অবশ্য নির্বাচন কমিশন দাবি করে, ৫৫ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়ে গেছে। জাতীয় পার্টি ২৫১ সিট হাত করে। অজ্ঞাত পরিচয় ৭৬টি রাজনৈতিক দল নিয়ে রাজনৈতিক ভাগ্যান্বেষী আ স ম রব ৩২ লাখ ভোট ও ১৮টি আসন পান, স্বতন্ত্র এমপি হন ২৫ জন, ফ্রিডম পার্টি দুই ও শাহজাহান সিরাজ তিনটি আসন পান।

এ সংসদে এরশাদ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী পাস করেন। তাতে হাইকোর্টের একত্বের বৈশিষ্ট্য ভাঙা হয়। রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তিত হয়। ১৯৮৮ সালের বন্যা এরশাদের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এরশাদ-পতন আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ৯ বছরের মহান শাসন ত্যাগ করে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০-এ পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশে সামরিক সরকার, রাজনৈতিক সরকারের পর বিচারপতি-অধ্যাপক-বুদ্ধিজীবীদের একটা সরকার দৃশ্যপটে আসে। যদিও সেটি পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো ছিল না। শুধু নির্বাচন আয়োজনের জন্য একটি অন্তর্বর্তী সরকার।

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি ও প্রশাসক সাহাবুদ্দীন আহমদের দক্ষ প্রশাসনের অধীনে সম্পন্ন হয় ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। প্রকৃতপক্ষে এ নির্বাচনে কেয়ারটেকারের আবির্ভাব ঘটে এবং ১৯৯৬ সালের একতরফা সংসদ তাকে স্থায়ী করে যায়।

১৯৯১ সালের সংসদে ৭৬টি দল দুই হাজার ৩৫০ জন প্রার্থী দাঁড় করায়। স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন ৪২৪ জন। ৩০টি মহিলা আসন থাকায় জামায়াত দুই আসনের বিনিময়ে বিএনপিকে সমর্থন দেয়। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৭২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৩৫টি আসন পায়। এরশাদ ও খালেদা পাঁচটি করে আসনে জয়ী হন।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে ফল আসে নিম্নরূপ- বিএনপি ১৪০, আওয়ামী লীগ ৮৮, জাপা ৩৫, জামায়াত ১৮, সিপিবি ৫, বাকশাল ৫, স্বতন্ত্র ৩, ন্যাপ (মো:) ১, গণতন্ত্রী পার্টি ১, ওয়ার্কার্স পার্টি ১, জাসদ সিরাজ ১, ইসলামী ঐক্যজোট ১ ও এনডিপি ১।

মোট ভোটের ১৭ শতাংশ প্রদত্ত ভোটের ৩১ শতাংশ পেয়ে বিএনপি ৪৭ শতাংশ আসন পায়। মোট ভোটের সাড়ে ১৬ ভাগ, প্রদত্ত ভোটের ৩০ ভাগ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ ৩০ শতাংশের কিছু কম আসন পায়। মোট ভোটের সাড়ে ৬ ভাগ এবং প্রদত্ত ভোটের ১২ ভাগের বেশি ভোট পেয়ে জামায়াত ছয়টি আসন পায়। এ নির্বাচনে ৫৫ ভাগ ভোটার ভোট দেয়। ছয় কোটি ২২ লাখ ভোটের মধ্যে বৈধ প্রদত্ত ভোট দাঁড়ায় তিন কোটি ৪১ লাখ। বিএনপি পায় এক কোটি পাঁচ লাখ ভোট; আওয়ামী লীগ এক কোটি দুই লাখ ভোট; জাতীয় পার্টি সাড়ে ৪০ লাখ এবং জামায়াত সাড়ে ৪১ লাখ ভোট পায়।

বিএনপি ক্ষমতাসীন হওয়ার দুই বছরের মাথায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়। আওয়ামী লীগের সাথে এ আন্দোলনে জামায়াতও যোগ দেয়। তখন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা পেশ করার কৃতিত্বের দাবিদার জামায়াতও আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। আন্দোলনের নতুন রূপে আমলাদের একটি অংশ প্রজাতন্ত্রের দায়িত্ব ছেড়ে প্রকাশ্য রাজনীতিতে নেমে পড়ে।

জ্বালাও-পোড়াও ধ্বংসাত্মক রাজনীতির পর ১৯৯৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে পাস হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। বিএনপি-আওয়ামী লীগের মতো জামায়াতও ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়। জাতীয়তাবাদী ইসলামি শক্তির ভোট বিভাজন আওয়ামী লীগের ক্ষমতা লাভ অনেকটা সহজ করে দেয়। এ নির্বাচনে আমলা-কামলা-এনজিও সবাই সক্রিয় হয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য, সেকুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এরা সবাই আওয়ামী লীগকে সহায়তা প্রদান করে। ভোটের ফল আওয়ামী লীগ ৩৭.৪৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৪৬ আসন, বিএনপি ৩৩.৬০ শতাংশ ভোট পেয়ে ১১৬ আসন, জাতীয় পার্টি ২৯৩ আসনে নির্বাচন করে ১৬.৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩২ এবং জামায়াত ৮.৬১ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩ আসন পায়।

সরকার গঠনে এরশাদের ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের সুখের ঘরের সঙ্গী জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করে। ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে এতটাই দক্ষ ছিল, রাষ্ট্র পরিচালনায় তারা তেমন কোনো সাফল্যই দেখাতে পারেনি। সেই পুরনো কায়দায় ভারতের সাথে মাখামাখি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও বিদ্যুৎ সঙ্কটে দিশেহারা মানুষ দেখল বিদ্যুৎ লাইনের নাটবল্টু খোলার অভিযোগ এনে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। এর সাথে অকার্যকর সংসদের কারণে সরকারবিরোধী আন্দোলন জমে ওঠে। বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে চারদলীয় জোট। তার পরও নির্ধারিত মেয়াদ পূরণ করে বিচারপতি লতিফুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী লীগ নির্বাচনের মাঠে নামে। কিন্তু তত দিনে ভোটের রাজনীতির হিসাব পাল্টে গেছে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়। নির্বাচনে বিএনপি ২৫২ আসনে প্রার্থী দিয়ে ৪০.৯৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৯৩ আসন লাভ করে। আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে ৪০.১৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ৬২ আসন, জাতীয় পার্টি ২৮১ আসনে প্রার্থী দিয়ে ৭.২৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৪ আসন, জামায়াত ৩১ আসনে প্রার্থী দিয়ে ৪.২৮ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৭ আসনে বিজয়ী।

দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করলেও সরকারের গতিতে এর প্রভাব কমই পড়েছে। বরং আওয়ামী লীগ প্রভাবিত মিডিয়ায় দুর্নীতির কেচ্ছাকাহিনী প্রতিদিন প্রকাশ হতে থাকে। সদ্যক্ষমতা ছাড়া আওয়ামী লীগ কল্পনাও করেনি নির্বাচনে এতটা বিপর্যয় হবে। যথারীতি এ নির্বাচনে তারা কারচুপির অভিযোগ তোলে। চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়। আগের ধারায় সংসদ অকার্যকর থাকে। ক্ষমতার শেষ পর্যায়ে জোট সরকার বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে আওয়ামী লীগের হাতে আন্দোলনের নতুন অস্ত্র তুলে দেয়। কে হবে কেয়ারটেকার সরকার এ নিয়ে যখন মারামারি, রক্তারক্তি, লগি-বৈঠা দিয়ে রাজপথে মানুষ হত্যা তখনই দেশী-বিদেশী একটি মহল রাজনীতি নির্বাসনে পাঠানোর আয়োজন করে। বাতিল হয়ে যায় ২২ জানুয়ারির নির্বাচন। নির্বাচিত শাসক, সামরিক শাসক, তত্ত্বাবধায়ক শাসকের পর বাংলাদেশের মানুষের সামনে এবার আসে সেনাসমর্থিত অভিনব শাসক।

তারা ক্ষমতা গ্রহণের পর দুই বছরের এক রোডম্যাপ ঘোষণা করে। জানিয়ে দেয় তিন মাস নয়, তারা কমসে কম দুই বছর থাকবে। এক জেনারেলকে দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠিয়ে দেয়। রাজনীতির কই, পুঁটি, চিতল, বোয়াল- সবাইকে গ্রেফতারের আয়োজন করে। অভিযোগ সেই পুরনো, এরশাদ যেমন বলেছিলেনÑ দুর্নীতি দমন করতে হবে। তাদের সাথে যোগ দেয় রাজনীতিবিরোধী অন্যরকম রাজনৈতিক শক্তি সুশীলসমাজ। হাসিনা-খালেদা গ্রেফতার হন। খালেদার ছেলেদেরও ধরা হয়। হাড়হাড্ডি ভাঙার অভিযোগ ওঠে। রাজনৈতিক আন্দোলনও দানা বাঁধতে থাকে। এর মধ্যে এক নেত্রী বিশেষ সুবিধা নিয়ে বিদেশ চলে যান। যিনি আগে দাবি করেছিলেন এই সরকার তার আন্দোলনের ফসল। যদিও সরকার চেয়েছিল দু’জনই চলে যাক। বিরাজনীতিকরণের পথের কাঁটা সরে যাক। একজনের জিদের কাছে হার মানে সরকার। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে নির্বাচনের চাপ বাড়তে থাকে। এর মধ্যে একে একে ছাড়া পান দুর্নীতির অভিযোগে আটক নেতারা। মুক্তি পান খালেদাও। বিদেশে যাওয়া হাসিনাও ফিরে আসেন।

অবশেষে ঘোষণা- বছরের একেবারে শেষে ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন। জোট আর মহাজোটের এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ছিল আওয়ামী লীগের জোট শরিক। অপর দিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। খালেদা জিয়া প্রথমে নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি ছিলেন না। জোটসঙ্গী জামায়াতের চাপে রাজি হন। কারণ, তার দল ছিল তখন পর্যুদস্ত। দলের মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতারা দল ছেড়ে সংস্কারপন্থী বনে যান। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৫৯ আসনে বিজয়ী হয়। বিএনপি ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়ে বিএনপির ভাগ্যে জোটে ৩০ আসন। ৭ শতাংশ ভোট পেয়ে জাতীয় পার্টি ২৭ আসন। ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেয়ে জামায়াত দুই আসনে বিজয়ী হয়। রাজনৈতিক এতিম হিসেবে পরিচিত ইনু ও বাদলের দলও মশাল মার্কা নিয়ে তিন আসন পেয়ে যায়। এই নির্বাচনে প্রথম দেখা গেল অনেক ভোটকেন্দ্রে বিএনপির প্রার্থীদের এজেন্ট নেই। ভোটের আগে অদৃশ্য ভয়ের সংস্কৃতি চালু হয়। এই নির্বাচনে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং শব্দটি ব্যবহার করা হয়। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা থেকে প্রস্থানের জন্য আওয়ামী লীগের সাথে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে এই নির্বাচন হয় বলে বিএনপির অভিযোগ।

২০০৮ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনা সরকার আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তুলে দেয়। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন শুরু করে। যে আন্দোলন ১৯৯৩-’৯৬ সালে শেখ হাসিনা করেছিলেন। কিন্তু এই আন্দোলনের কাছে মাথানত না করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে শেখ হাসিনা সরকার। বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। এরশাদও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর কৌশল নেন। নির্বাচনে অংশ নেয়ার উপকারিতা ও সাহস জোগাতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকা এসে সাবেক সেনাপ্রধান এরশাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। তিনি রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাকে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন হাসপাতালে ভর্তি করেন। অন্য দিকে জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ফর্মুলা নিয়ে আলোচনা হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে দলীয় সরকারের অধীনে এই নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর মধ্যে এরশাদও ছিলেন। তিনি হাসপাতাল থেকে সরাসরি এমপি হিসেবে শপথ নিতে সংসদ ভবনে যান। তার দল জাতীয় পার্টি হয় বিরোধী দল। কিন্তু তিনজন এমপি আবার মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। সরকারে থেকে বিরোধী দলের এমন নজির গণতন্ত্রের ইতিহাসে বিরল। নির্বাচনে বাকি আসনে ৫ শতাংশের কম মানুষ ভোট প্রদান করে। এই নির্বাচনে ভারত ও ভুটান থেকে মাত্র চারজন পর্যবেক্ষক এসেছিলেন নির্বাচন পর্যবেক্ষণে।

এই সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষে ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠানো হয়। খালেদা নির্বাচনে অংশ নেয়ার আবেদন করলেও আদালত মঞ্জুর করেননি। পরিস্থিতি এমন যে আদালত, পুলিশ ও মিডিয়া ক্ষমতাসীনদের রঙিন চশমায় দেখা গণতন্ত্রের রূপ দেখতে চায়। বিরোধী দলের প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণায় নামতে পারছেন না। শেখ হাসিনার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টে তার দলের এক সময়ের অনেক নেতাও আছেন। নির্বাচন কেমন হবে তার আভাস ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে। দলীয় সরকারের অধীনে এই নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের ১৭ আসনে কোনো প্রার্থী নেই। নির্বাচনের আগেই কারাগারে পাঠানো হয়ে ১৬ জন প্রার্থীকে। বলপ্রয়োগের এই নির্বাচনের ফলাফল দেখার জন্য আর মাত্র ক’দিন অপেক্ষা করতে হবে।

কখনো ভোটে হারেনি ক্ষমতাসীন দল

১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৮৮, ২০১৪ এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি—দেশের ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনেই জয়ী হয়েছে ক্ষমতাসীনেরা ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে চার মাসের ব্যবধানে দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু দুটি নির্বাচনের ফলাফল ছিল দুই রকম। ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’র কারণে বিরোধী দলহীন যে নির্বাচনটি করেছিল সেটিতে তারা ‘নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা’ অর্জন করলেও ১২ জুন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পরের নির্বাচনটিতে হারই সঙ্গী হয়েছিল বিএনপির।

বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তার প্রতিটিতেই জয়ী হয়েছে ক্ষমতাসীনেরা। ১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৮৮—বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চিত্রই এক। ১৯৯০ সালের শেষে এক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের সংক্ষিপ্ততম সময়ের জন্য গঠিত সংসদেই পাস হয়েছিল নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান। এরপর ১৯৯৬, ২০০১ আর ২০০৮ সালে তিনটি নির্বাচন এভাবেই হয়েছে। আর এই তিন নির্বাচনে ফল পুরোপুরি গেছে সর্বশেষ ক্ষমতায় থাকা দলটির বিরুদ্ধে। পরে আওয়ামী লীগ শাসনামলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয় এবং আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলই জয়ী হয়।

১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের মানুষের এক নতুন অভিজ্ঞতা। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছেন দলে দলে, সেখানে কোনো বাধা ছাড়াই তাঁরা ভোট দিচ্ছেন, কোথাও কোনো সংঘাত নেই, সংঘর্ষ নেই, চারদিকে উৎসবের আবহ—স্বাধীনতার পর এই দৃশ্য কখনোই দেখা যায়নি। নির্বাচন বলতে এর আগে মানুষের অভিজ্ঞতা ছিল শক্তিশালী প্রার্থীর সমর্থকদের সন্ত্রাস আর জাল ভোটসহ নানা ধরনের অনিয়মের সাক্ষী হওয়া। একানব্বইয়ের নির্বাচন ছিল পুরোপুরিই অন্য রকম। ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’, এই বাক্যের প্রয়োগ প্রথমবারের মতোই সেবার অনুভব করেছিলেন বাংলাদেশের ভোটাররা।

ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শাসনামলে অনুষ্ঠিত ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসনামলের ১৯৭৯ সালের নির্বাচন ছিল পুরোপুরি অংশগ্রহণমূলক। নিবন্ধিত প্রায় সব রাজনৈতিক দলই দেশের ইতিহাসের প্রথম দুটি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ছিল একটু ব্যতিক্রম। আপাতদৃষ্টিতে অংশগ্রহণমূলক হলেও এতে বিএনপির মতো একটি বড় রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। যদিও আওয়ামী লীগ ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও ১৯৮৮-তে বয়কট করে।

১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ স্বাধীন দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অবস্থান ছিল খুব শক্ত। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি সে সময় বিরাট বিজয় পাবে, এটাই ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। সেবার ২৮৯ আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর দেখা যায় আওয়ামী লীগ ২৮২টি আসন লাভ করেছে। বিরোধী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছেন বাকি ৭টি আসন। বিরোধী রাজনৈতিক দল সে নির্বাচনে মাত্র দুটি আসন লাভ করে, যার একটি পান জাতীয় লীগের বর্ষীয়ান নেতা আতাউর রহমান খান আর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) আবদুস সাত্তার।

অবশ্য ক্ষমতাসীনদের অধীনে নির্বাচনগুলো একেবারে বিতর্কমুক্ত ছিল না। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় প্রত্যাশিত ছিল। তবে প্রয়াত রাজনীতিবিদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী তাঁর ‘রাজনীতির তিনকাল’ বইয়ের ১৪২ পৃষ্ঠায় ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচন সম্পর্ক বলেছেন, ‘এ নির্বাচন সর্বাংশে শান্তিপূর্ণ ও অবাধ হয়েছিল, তা বলা যাবে না। কোনো কোনো আসনে বিরোধীদলীয় প্রার্থীকে বলপূর্বক পরাজিত করা হয়েছে বলে নির্বাচনের পর অভিযোগ আনা হয়।’

জিয়ার আমলে ১৯৭৯ সালের নির্বাচন নিয়ে মূল অভিযোগ হচ্ছে, এতে সরকারি দল বিএনপির প্রার্থীদের ব্যাপকভাবে প্রশাসনিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদান। এ ব্যাপারে মিজানুর রহমান চৌধুরী তাঁর ‘রাজনীতির তিনকাল’ গ্রন্থের ১৯০ পৃষ্ঠায় ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে বলেছেন, ‘নির্বাচনী ফল নিয়ে সে সময় দেশে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়। নীলনকশা অনুযায়ী এমন নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন একটা সদ্য গঠিত রাজনৈতিক দলের পক্ষে সম্ভব হয়েছে একটি মাত্র কারণে, সেটা হলো দলটির প্রধান দেশের রাষ্ট্রপতি নিজে এবং ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করা।’

১৯৭৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা-পরবর্তী সময়ে এমনিতেই আওয়ামী লীগ সে সময় ছিল অনেকটাই দিগ্ভ্রান্ত, অভিভাবকহীন। নির্বাচনের আগে দলে বিভক্তি দেখা দেয়। ‘আওয়ামী লীগ’ নাম নিয়েই আরও একটি দল নিবন্ধিত হয়। তারাও নির্বাচনে অংশ নেয় এবং দুটি আসন লাভ করে। মূল আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩৯টি আসন। ২০৭টি আসন নিয়ে ‘সরকারি দল’ বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়াও ১৯৭৯-এর সংসদ নির্বাচনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ৮টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ৮টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ৫টি, আওয়ামী লীগ (মিজান) ২টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ১টি, জাতীয় গণফ্রন্ট ২টি, জাতীয় লীগ ২টি, জাতীয় একতা পার্টি ১টি ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ১টি আসন লাভ করে। সে নির্বাচনে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ১১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৮৬ সালে এরশাদের নির্বাচনটিও অনেকটা ১৯৭৯-র আদলে হয়েছিল। পূর্বসূরি সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের মতোই এইচ এম এরশাদের উদ্দেশ্য ছিল, একটা নির্বাচন করে নিজের রাজনৈতিক উত্তরণ আর সামরিক শাসনের বৈধতা। সে লক্ষ্যেই ৭ মে দেশের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরশাদের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি এ নির্বাচনে ‘সরকারি দল’ হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। অনেক নাটকীয়তার পর এতে অংশ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) তিনটি অংশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-মোজাফ্ফর), ওয়ার্কার্স পার্টি (নজরুল) প্রভৃতি দল। তবে ‘স্বৈরাচারের অধীনে’ বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। নির্বাচনে ব্যাপক সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছিল বিরোধী পক্ষের তরফ থেকে। বহু জায়গায় জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের পক্ষে কেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপারে সিল মারার অভিযোগ ওঠে। ‘মিডিয়া ক্যু’র মাধ্যমে রেডিও-টেলিভিশনে ফলাফল পাল্টে দেওয়ার ব্যাপারে অভিযোগ ছিল আওয়ামী লীগের। এ নির্বাচনে সদ্য প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি ১৫৩ আসনে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ পায় ৭৬ আসন। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামী ১০টি, কমিউনিস্ট পার্টি ৬টি, মুসলিম লীগ ৪টি, জাসদ (রব) ৪টি, জাসদ (সিরাজ) ৩টি, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) ৩টি, ওয়ার্কার্স পার্টি (নজরুল) ৩টি আর ন্যাপ ২টি আসনে জয়লাভ করে। উল্লেখ্য, এই নির্বাচনে ৩০ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে এসেছিলেন। এদের ২৮জন অবশ্য নির্বাচনের পরপরই সরকারি দল জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন।

ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির প্রতিবাদ জানিয়ে আওয়ামী লীগ প্রথমে সংসদ অধিবেশনে অংশ নেয়নি। পরে অবশ্য তারা সংসদে যোগ দেয়। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতেই, এই নির্বাচনের অনিয়ম, কারচুপির অভিযোগ থেকে বিরোধী রাজনীতিকদের মধ্যে একটা উপলব্ধির জন্ম দেয় যে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন পুরোপুরি অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে পারে না।

ছিয়াশির সংসদ বেশি দিন টেকেনি। ১৯৮৭ সালের শেষ দিকে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার হলে রাষ্ট্রপতি এরশাদ সংসদ ভেঙে দেন। তোড়জোড় শুরু করেন চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের। কিন্তু এ নির্বাচনে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় কেউই অংশ নেয়নি। ছিয়াশির নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে তারা এ সিদ্ধান্ত নেয়। রাজনীতিবিদ মিজানুর রহমান চৌধুরী তাঁর ‘রাজনীতির তিনকাল’ বইয়ে এ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো নিয়ে রীতিমতো কৌতুক করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ সংসদ নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো আগেই এ নির্বাচন বয়কট ও প্রতিরোধের কথা ঘোষণা করেছিল। ফলে দেখা গেল মাঠে জাতীয় পার্টি ছাড়া আর কেউ নেই। এ অবস্থায় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের লক্ষ্যে নাম, সাইনবোর্ড ও প্যাডসর্বস্ব কিছু ‘পায়ে দল’, ‘হোন্ডা দল’কে বিরোধী দল আখ্যা দিয়ে আসন ছেড়ে দেওয়ার লক্ষ্যে নির্বাচনে নামতে রাজি করানো হয়।’

এই নির্বাচনে সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনার জন্ম দেন জাসদের একাংশের সভাপতি আ স ম আবদুর রব। তিনি ছোট ছোট দল নিয়ে একটা বিরাট রাজনৈতিক জোট গঠন করে ফেলেন। সেটির নাম দেওয়া হয় ‘সম্মিলিত বিরোধী দল’ বা ‘কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি—কপ’। নির্বাচনে এই ‘কপ’ ১৯টি আসন পেয়েছিল। রব নির্বাচিত হয়েছিলেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল ফারুক রহমান ও আবদুর রশিদের ফ্রিডম পার্টিও সংসদে আসন লাভ করে।

জাতীয় পার্টি এ নির্বাচনে ২৫১টি আসন পায়। কপ ১৯টি আসন নিয়ে পরিণত হয় দ্বিতীয় বৃহত্তম দলে। শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন আরেকটি ‘জাসদ’ ৩টি আসন পায়। ফ্রিডম পার্টির আসনসংখ্যা ছিল ২টি। এ নির্বাচনে ২৫ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হন।

১৯৮৮-র নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘প্রহসন’ হয়েই আছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির অনুপস্থিতিতে কার্যত এতে সরকারি দল জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভোটাররা ভোট দিতে যাননি। ফলে ভোটারবিহীন এ নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থীরা নিজেরাই সন্ত্রাসের মাধ্যমে কেন্দ্র দখল করে ভোটের বাক্স ভর্তি করার মহড়া দিয়েছিলেন।

১৯৯১ সালের নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষের কাছে ছিল ভিন্ন ধরনের এক অভিজ্ঞতা। স্বতঃস্ফূর্ত ও অংশগ্রহণমূলক সে নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে বিএনপি। নির্বাচনে দলটি ১৪০ আসন পেলেও তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিরঙ্কুশ ছিল না। সেবার জামায়াতে ইসলামীর ১৮ জন প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিএনপি জামায়াতের সেই ১৮ সংসদ সদস্যের সমর্থন নিয়েই গঠন করেছিল এরশাদ শাসন-পরবর্তী সরকার। নির্বাচনে ৮৮ আসন নিয়ে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। সদ্য বিদায়ী সরকারি দলে জাতীয় পার্টি পেয়েছিল ৩৫ আসন। এ ছাড়া বাকশাল ৫টি, সিপিবি ৫টি আসন লাভ করে। ন্যাপ (মোজাফ্ফর), জাসদ (সিরাজ), এনডিপি, গণতন্ত্রী পার্টি লাভ করে ১টি করে আসন। সেবার ৩ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটেছে বলা হলেও বিএনপি সরকারের আমলে নির্বাচনী সংস্কৃতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। ১৯৯৩ সালের দিকে মাগুরা ও মিরপুরে দুটি উপনির্বাচনে সেটি প্রমাণিত হয়। আসন দুটিতে সরকারি দল বিএনপির বিজয় মোটামুটি নিশ্চিত থাকলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। এর পরপরই আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের মতো বিরোধী দলগুলো সংবিধানে স্থায়ীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের দাবি তোলে এবং ইস্যুটি নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৯১-১৯৯৬ সালের বিএনপি সরকার অবশ্য সে দাবি মানেনি। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি হয় অনিশ্চয়তা। বিএনপি সরকার মরিয়া হয়ে ওঠে নিজেদের অধীনে নির্বাচন করানোর, বিরোধী দলগুলো দাবি করতে থাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের। এমনই একটা সময়ে ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’ রক্ষার জন্য ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এ নির্বাচন বয়কট করে। ফলে এটি পরিণত হয়ে ১৯৮৮ নির্বাচনের মতোই আরও একটি ‘নামকাওয়াস্তে’ নির্বাচনে। বিএনপির প্রার্থীদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল না। ’৮৮-এর নির্বাচনের মতোই এতে অংশ নেয় ফারুক-রশিদের ফ্রিডম পার্ট। ৪৮টি আসনে বিএনপির প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। ২টি আসনে ব্যাপক গোলযোগের কারণে নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয়নি। ২৫০টি আসনে শেষ পর্যন্ত ভোটের এক ধরনের মহড়া হয়।

নির্দলীয় ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর দেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি ও জামায়াতের বয়কটের মুখে একতরফা নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়। তাদের দাবি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন। ১৫৩টি আসনে সেবার কোনো নির্বাচনই হয়নি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মহাজোটের প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে যান। এ নির্বাচন দেশের ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত আগের নির্বাচনগুলির মতোই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে।

এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে। এই নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকাসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ করছে বিরোধী জোট ও দলগুলো।

এবারের নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ এ ব্যাপারে বলেন, ‘আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। যখন যে দলের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তখন তারা নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের জন্য সাধারণ মানুষের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারেনি। কেউ কেউ তো নিজেদের অধীনে নির্বাচনকে রীতিমতো প্রহসনে পরিণত করেছিল। তবে আমরা আস্থা রাখতে চাই এই সরকারের ওপর। বিশ্বাস রাখতে চাই।

এক নজরে ১০টি সংসদের ভোটের ফলাফল:

প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ স্বাধীন দেশে সর্বপ্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। মোট ১৫টি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।

প্রাপ্ত আসন– বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২৯৩টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ একটি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল একটি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পাঁচজন বিজয়ী হন।

সংসদ নেতা নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান/মোহাম্মদ মনসুর আলী। এ সংসদের মেয়াদ ছিল দুই বছর ছয় মাস।

দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন
১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় । নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২০৭টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে। মোট ৩০টি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।

প্রাপ্ত আসন- বিএনপি ২০৭টি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-মালেক ৩৯টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ দুটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-মিজান দুটি, জাসদ আটটি, মুসলিম ও ডেমোক্র্যাটিক লীগ ২০টি, ন্যাপ একটি, বাংলাদেশ গণফ্রন্ট দুটি, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল একটি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দল একটি, জাতীয় একতা পার্টি একটি এবং স্বতন্ত্র ১৬ প্রার্থী নির্বাচিত হন।

সংসদ নেতা নির্বাচিত হন শাহ আজিজুর রহমান। বিরোধীদলীয় নেতা হন আসাদুজ্জামান খান।

এ সংসদের মেয়াদ ছিল তিন বছর।

তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন
১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে। বিএনপি এ নির্বাচন বর্জন করে। মোট ১৩টি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।

প্রাপ্ত আসন- জাতীয় পার্টি ১৫৩টি, আওয়ামী লীগ ৭৬টি, কম্যুনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ পাঁচটি, ন্যাপ-মোজাফফর দুটি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পাঁচটি, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ তিনটি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-রব চারটি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-সিরাজ তিনটি, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ১০টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ চারটি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি তিনটি এবং স্বতন্ত্র ৩২ প্রার্থী নির্বাচিত হন।

সংসদ নেতা নির্বাচিত হন মিজানুর রহমান চৌধুরী। বিরোধীদলীয় নেতা হন শেখ হাসিনা।

এ সংসদের মেয়াদ ছিল ১৭ মাস।

চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বর্জন করে। ফলে জাতীয় পার্টি ২৫১টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে। নির্বাচনে মোট ছয়টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে।

প্রাপ্ত আসন- জাতীয় পার্টি ২৫১টি, সম্মিলিত বিরোধী দল ১৯টি, স্বতন্ত্র ২৫টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-সিরাজ তিনটি এবং ফ্রিডম পার্টি দুটি আসন লাভ করে।

সংসদ নেতা নির্বাচিত হন ব্যরিস্টার মওদুদ আহমেদ/কাজী জাফর আহমেদ। বিরোধীদলীয় নেতা হন আ স ম আব্দুর রব।

এ সংসদের মেয়াদ ছিল দুই বছর সাত মাস।

পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। এ নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে। মোট ২১টি রাজনৈতিক দল এতে অংশ নেয়।

প্রাপ্ত আসন – বিএনপি ১৪০টি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৮৮টি, জাতীয় পার্টি ৩৫টি, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ-বাকশাল পাঁচটি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ-সিরাজ একটি, ইসলামী ঐক্যজোট একটি, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ১৮টি, সিপিবি পাঁচটি, ওয়ার্কার্স পার্টি একটি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এনডিপি একটি, গণতন্ত্রী পার্টি একটি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ একটি এবং অন্যান্য দল তিনটি আসন লাভ করে।

সংসদ নেতা নির্বাচিত হন বেগম খালেদা জিয়া। বিরোধীদলীয় নেতা হন শেখ হাসিনা।

সংসদের মেয়াদ চার বছর আট মাস।

ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নির্বাচনটি বর্জন করায় বিএনপি ২৭৮টি আসন পেয়ে একতরফা জয়লাভ করে। মোট তিনটি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।

প্রাপ্ত আসন- বিএনপি ২৭৮টি, ফ্রিডম পার্টি একটি এবং স্বতন্ত্র ১০ প্রার্থী নির্বাচিত হন।

সংসদ নেতা হন বেগম খালেদা জিয়া। এ সংসদের মেয়াদ ছিল মাত্র ১১ দিন।

সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসনে জয়লাভ করে। এটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
মোট আটটি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।

প্রাপ্ত আসন – আওয়ামী লীগ ১৪৬টি, বিএনপি ১১৬টি, জাতীয় পার্টি ৩২টি, ইসলামী ঐক্য জোট একটি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল একটি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী একটি, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ তিনটি আসনে জয়ী হয়।

সংসদ নেতা নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। বিরোধীদলীয় নেতা হন বেগম খালেদা জিয়া।

সংসদের মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর।

অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ছিলেন লতিফুর রহমান। নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে। মোট ১৯টি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।

প্রাপ্ত আসন- বিএনপি ১৯৩টি, আওয়ামী লীগ ৬২টি, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ১৭টি, জাতীয় পার্টি-এ-ইসলামী ঐক্য ফ্রন্ট ১৪টি, জাতীয় পার্টি- না-ফি চারপি, জাতীয় পার্টি-মঞ্জু একটি, ইসলামিক ঐক্যজোট দুটি, কৃষক শ্রমিক জনতালীগ একটি ও স্বতন্ত্র ছয়জন নির্বাচিত হন।

সংসদ নেতা নির্বাচিত হন বেগম খালেদা জিয়া। বিরোধীদলীয় নেতা হন শেখ হাসিনা।

সংসদের মেয়াদ হয় পাঁচ বছর।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন আহমদের অধীনে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে। মোট ১০টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।

প্রাপ্ত আসন- আওয়ামী লীগ ২৩০টি, বিএনপি ৩০টি, জাতীয় পার্টি ২৭টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল তিনটি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি দুটি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি একটি, জামায়াতে ইসলামী দুটি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি একটি ও স্বতন্ত্র চার প্রার্থী নির্বাচিত হন।

সংসদ নেতা নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। বিরোধী দলীয় নেতা হন বেগম খালেদা জিয়া।

সংসদের মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর (পূর্ণমেয়াদ)।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে মোট ১৪৭টি আসনে ভোটগ্রহণ হয়। মোট ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন আওয়ামী লীগসহ এর শরিকরা। মোট ১৭টি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।

প্রাপ্ত আসন (১৪৭টি)- আওয়ামী লীগ ৯৬টি, জাতীয় পার্টি ১২টি, ওয়ার্কার্স পার্টি চারটি, জাসদ দুটি এবং স্বতন্ত্র ১৪ প্রার্থী নির্বাচিত হন।

সংসদ নেতা নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। বিরোধী দলের নেতা হন রওশন এরশাদ।

ফিরে দেখা ১০টি সংসদ নির্বাচন

স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ১০টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১০টি নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) চারবার করে মোট আটবার এবং বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি দুবার সরকার গঠন করে।

আওয়ামী লীগ প্রথম, সপ্তম, নবম ও দশম সংসদ নির্বাচনে; বিএনপি দ্বিতীয়, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও অষ্টম সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে। জাতীয় পার্টি তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোর মধ্যে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়ে। এ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৮৭ শতাংশ ভোট পড়ে। অন্যদিকে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোট পড়ে। এ নির্বাচনে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট পড়ে।

এছাড়া প্রথম সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়ে ৫৪ দশমিক ৯ শতাংশ, দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ, তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে ৬১ দশমিক ৩ শতাংশ, চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ, পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ৫৫ দশমিক ৪ শতাংশ, সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ৭৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ, অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ৭৫ শতাংশ এবং দশম সংসদ নির্বাচনে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পড়ে।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বর্জন করে। বিএনপি একতরফাভাবে ২৭৮টি আসনে বিজয়ী হয়। এ সংসদের মেয়াদ ছিল মাত্র ১১ দিন।

১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ থেকে বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৩০ ডিসেম্বর (রোববার) অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

 

Leave a Comment

error: Content is protected !!