ধান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে কৃষক

মো: জাহিদ হাসান: “ধনধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা”, “চৈত্র মাসে চাষ দিয়া না বোনে বৈশাখে, কবে সেই হৈমন্তিক ধান্য পেয়ে থাকে”, ” নতুন ধানে, নতুন চালে, নতুন ভাতের হাসি, আমন ধান কাটতে ব্যস্ত বাংলার সকল চাষী”- এমন শত শত গান, কবিতা রয়েছে ধানকে ঘিরে। ধান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে কৃষক

বাংলা সাহিত্যের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে রয়েছে ধানের ঐতিহ্য। সমাজ, সংস্কৃতির সাথে ধানের কতটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল, তা কবি সাহিত্যিকরা স্পষ্টত অনুমান করেছেন! তাই সাহিত্যে ধানের এত আনাগোনা। আনাগোনা থাকবেই বা না কেন! এদেশের কৃষি বলতে মূলত ধানকেই বোঝানো হতো এক সময়। শুধু কৃষি নয়, উৎসব বলতেও ধানকেই বোঝানো হত। জীবনযাত্রার সকল কিছু ছিল কৃষি নির্ভর। আর কৃষির সিংহভাগ দখল করে ছিল ধান, তাই ধানের এত গুরুত্ব। কিন্তু বর্তমান সময়ে ধানের পুরনো অতীত, শুধুই অতীত। হারাতে বসেছে পুরনো ঐতিহ্য।

সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে ধান নির্ভর কৃষ্টি। নবান্নের সেই চেনা রুপ আজ নেই বললেই চলে। অগ্রহায়ন মাসের শুরুতে নতুন ধান দিয়ে পিঠা, পায়েস তৈরি হত। কৃষকের বছরই শুরু হতো অগ্রহায়ন মাস দিয়ে। নবান্নের সময়টাতে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার নিয়ম আজ অনিয়মে পরিনত হয়েছে। সেই সাথে ফিকে হয়েছে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা।

দীর্ঘদিন আত্মীয়ের বাড়িতে থাকার দিনগুলো, আজ শুধু লোকমুখে শোভা পায়। নাইওর যাওয়ার এবং নেওয়ার সুন্দর ঐতিহ্য আমাদের আর তেমন ভাবে নেই। এজন্য দায়ী রয়েছে অনেকগুলো বিষয়। ধান চাষের আগ্রহ হারিয়ে যাওয়া এর মধ্যে প্রধান কারণ।

বিশেষজ্ঞদের মতে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের তুলনায় প্রায় চারগুণ ধান উৎপাদিত হচ্ছে। জমির পরিমাণ কমে গেলেও উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধি করতে গিয়ে উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রায় ১০০টি নতুন উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন করেছে। আগে যে জমিতে ১মণ ধান হত, সেই জমিতেই এখন উৎপাদিত হচ্ছে ৯থেকে ১০মণ ধান। তবে হারিয়ে গেছে দেশীয় জাতের ধান। গত শতাব্দীর শেষের দিকে প্রায় ১৮ হাজার প্রজাতির দেশীয় জাতের ধানের তথ্য পাওয়া যায়।

কিন্তু বর্তমানে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাছে ৮৬০০ প্রজাতির দেশীয় ধান সংরক্ষিত আছে। এগুলো থেকেই নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবনের কাজ করা হয়। দেশীয় জাতের ধানের মধ্যে আছে কালোমেখী, পাকরী, যশোয়া, সূর্যমুখী, নোনাকুর্চি, লালটেপা, কলসকাটি, ঝিংগাশাইল, তিলকাবুর,পোড়াবিন্নি, দাদখানি, কাটারিভোগ, মহিষদল, ফুলবাদাল, মধুশাইল, রাঁধূনীপাগল, মাটিচাক, হরিলক্ষী, ফুলমালা, মধুমালতী, ফুলমুক্তা, সরিষাফুলি, যাত্রামুকুট, গান্ধীভোগ, কালামানিক, ঘিগজ, জলকুমারী ইত্যাদি।

তবে এসব জাতের ধানের চাষ প্রায় নাই বললেই চলে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধান উৎপাদিত হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, চীন, জাপান, মায়ানমার, ফিলিপাইন, জাভা, উত্তর আমেরিকা, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া। আশার কথা হল, বর্তমানে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ছেলে তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। দেশে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ জমিতে চাষ হয় রুপা আমন ধান। কিন্তু উৎপাদনের দিক দিয়ে প্রথমে রয়েছে বোরো ধান। প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ লক্ষ হেক্টর জমিতে এদেশে ধান চাষ হয়। পূর্বের সময়ের তুলনায় বর্তমান সময়ে ধান চাষের জমির পরিমাণ কমলেও উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্য সংকট রোধ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশে খাদ্য ঘাটতি ছিল ৩০ লক্ষ টন। যা মোট উৎপাদনের ৩০ শতাংশ। কিন্তু বর্তমানে সেই ঘাটতি নেই।

সরকার কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দিয়েছে। ২০০৮ থেকে ২০১৪ সালে চাল উৎপাদন হয় যথাক্রমে ৩১৩.১৬, ৩১৯.৭৫, ৩৩৫.৪১, ৩৩৮.৯০, ৩৩৮.৩৩, ৩৪৩.৫৬ এবং ৩৪৭.১০ লক্ষ মেট্রিক টন।লক্ষনীয়, খাদ্যশস্যের উৎপাদন প্রতি বছরই ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় মাঠ পর্যায়ে কৃষকরা ধান চাষের আগ্রহ দিন দিন হারিয়ে ফেলছে। এর মূল কারন ধানের দাম। কৃষকরা ধানের দামের কথা ভেবে চাষ করতে আগ্রহী হোন না। শ্রমিক দিয়ে যারা ধান চাষ করান, তাদের অবস্থা সূচনীয়। মজুরি দিয়ে ধান চাষ করে যে পরিমাণ ধান উৎপাদন করেন, বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে পূঁজি উঠানো মুশকিল হয়ে পড়ে। যে সব কৃষক নিজে কাজ করেন মাঠে, তারা টিকে আছেন দু’মুঠো খেতে হবে এই ভেবে। বাপ দাদার জমি খালি পড়ে থাকলে অসম্মানজনক, এই ভেবেও চাষ করে যাচ্ছেন অনেকে।

কৃষকদের মতে, ধানের দামের কথা ভাবলে ধান চাষ বন্ধ করে দিতে হবে। ধানের সাথে পাওয়া খড় বিক্রি করে খরচ কিছুটা পুষিয়ে নেন তারা। তাছাড়া ধানের কুড়ো দিয়ে মাছ, মুরগির খাদ্য তৈরি করেন। এসব আনুষঙ্গিক সুবিধা না থাকলে ধান চাষ বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকতো না। জমির প্রতি মায়ার টানেও ধান চাষ করে যাচ্ছেন ধানচাষীরা।অনেক কৃষক ধান চাষ বন্ধ করে দিয়ে মাছ চাষের দিকে যাচ্ছেন। এতে করে জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। কমে যাওয়ার পরিমাণটা বিপদজনক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। যদিও মাছ চাষ আমাদের অর্থনীতির জন্য সহায়ক কিন্তু ধানকে বাদ দেয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাই মাছ চাষে কম জায়গা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করছে মৎস অধিদপ্তর। প্রচারের চেষ্টা করা হচ্ছে বায়ুফ্লক মাছ চাষ পদ্ধতির। এ পদ্ধতিতে কম জায়গায় বেশি পরিমাণ মাছ চাষ করা যায়। এ পদ্ধতি মাছ চাষীদের মধ্যে প্রচারের সময়, ধানের জমি কমে যাওয়ার ক্ষতিকর দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হচ্ছে, যাতে করে কম জমিতে বায়ুফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে চাষীরা আগ্রহী হয়।

ধান ছেড়ে কৃষকরা মাছ চাষে আগ্রহী হওয়ার পেছনের কারণও মাছের দাম। ধানের চেয়ে অনেক বেশি লাভবান হওয়ার দরুন সহজেই মাছের দিকে ঝুঁকছেন চাষী। ধানের দাম কম হওয়ায় মাছ চাষের এই প্রসার। প্রসারটা হয়তো একসময় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যখন অনেক কম জমিতে, পুরো জাতির চাহিদা অনুযায়ী ধান উৎপাদন করতে হবে। বিপদ সামনে আসার আগে আমাদের তৈরি হওয়া উচিত। ধানের যে অর্থনৈতিক গুরুত্ব তা স্মরনে রেখে, ধানের দাম বাড়ানোর বিষয়ে দরকার সঠিক পরিকল্পনা। ধান উৎপাদনে খরচ কমানোর জন্য দরকার সরকারি সঠিক ব্যবস্থাপনা। সেচের সুবিধার পাশাপাশি, প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা দরকার।

সরকারিভাবে ধান কেনার বিষয়ে প্রয়োজন কিছু পরিবর্তন। সরাসরি মাঠ পর্যায় থেকে ধান কেনার ব্যবস্থা করা জরুরি। এতে করে কৃষক ন্যায্য দামের পাশাপাশি নতুন ফসল ফলানোতে বেশি সময় পাবে। ধান মাড়াই থেকে গুদামজাত করা পর্যন্ত দীর্ঘ সময়টুকু বেঁচে গেলে কৃষক লাভবান হবেন। কৃষিপ্রধান এদেশে কৃষির সৌন্দর্য ধান। সেই ধানের পুরোনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে দিতে, কৃষককে লাভবান করার কোন বিকল্প নেই। নয়তো একসময় মানুষের টাকা থাকবে কিন্তু সেই টাকায় চাল মিলবে না। চাহিদার তুলনায় কম উৎপাদন দাম বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে।

কৃষি অধিদপ্তর থেকে কৃষকদের ধান চাষে উৎসাহ দেওয়া হয়। কিন্তু শুকনো কথায় চিঁড়ে বেশিদিন হয়তো ভিজবে না। যেদিন জমির প্রতি কৃষকের আবেগ কাজ করবে না, ধানের দাম নিয়ে অসন্তুষ্টি চরমে উঠবে, ধান চাষ করার চেয়ে জমি বিক্রি করে ব্যাংকে টাকা রাখা বেশি লাভজনক মনে হবে, সেদিন চাইলেও ধানের সুদিন ফেরানে সম্ভব হবে না। নচিকেতার গানের কথায় বলতে হয় ” দেয়ালে ঠেকলে পিঠ লড়াই জীবন” -কৃষকদের দেয়ালে পিঠ ঠেকার আগেই তাদের দিকে নজর দেয়া উচিত। কৃষক পাল্টে গেলে সুষ্ঠু কৃষি ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে পড়বে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!