প্রতিটি শিশুই অসীম সম্ভবনাময়—শরীফুল্লাহ মুক্তি

প্রতিটি শিশুই অসীম সম্ভবনাময়। মেধা এক অমূল্য ধন। এর কোনো বিকল্প নেই, ক্ষয় নেই, ধ্বংস নেই। মেধাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারে না। এটি এমন এক সম্পদ যার দ্বারা পৃথিবী জয় করা যায়। আবার এটি এমন এক অস্ত্র যার আঘাত প্রতিহত করার ক্ষমতা কারো নেই। মেধা সৃষ্টিকর্তার দান; এটি কারো ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, কোনো দল-মতের সম্পত্তি নয়, এটি গোটা দেশ, জাতি তথা বিশে^র সম্পদ। মেধা একটি বিশেষ গুণ বা বিশেষ দক্ষতা যা দ্রুত শেখা, আয়ত্ত করা, মনে রাখা এবং সঠিক প্রয়োগ করতে পারাকে বোঝায়। মেধার সাথে বুদ্ধি, ধীশক্তি, বোধশক্তি, স্মৃতিশক্তি সম্পর্কিত।

হাওরের ছেলে মো. আবদুল হামিদ পর পর দু’বার বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হবেন- এটা কী কেউ পূর্বে ভেবেছিলো? আব্রাহাম লিংকনের মতো একজন মানুষ হবেন আমেরিকার শ্রেষ্ঠ শাসক কে জানত? বারাক ওবামার মতো কৃষ্ণাঙ্গ, গরিব পরিবারের ছেলে আমেরিকার সফল প্রেসিডেন্ট হবেন পূর্বে কেউ চিন্তা করেছিলো? কে জানত, নরেন্দ্র মোদির মতো একজন চা বিক্রেতার ছেলে হবেন ভারতের মতো এত বড় দেশের প্রধানমন্ত্রী! নেলসন ম্যান্ডেলার কথা আমরা সবাই জানি। তাঁর মতো একজন কালো বর্ণের লোক হয়ে উঠবেন বর্ণবৈষম্যহীন সমাজের প্রতিষ্ঠাতা- কে জানত?

এ রকম শত শত উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। এ সবই সম্ভব হয়েছে মেধার গুণে। কেউ জানত না, মহাত্মা গান্ধীর (করমচাঁদ গান্ধী) মতো একজন সাধারণ মানুষ গোটা ভারতের স্বাধীনতার জন্য অবদান রাখবেন।

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার অজ পাড়াগাঁয়ে জন্ম নেয়া শেখ মুজিবুর রহমান হবেন বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্যমণি- এটা কি কেউ ভেবেছিল? মায়ের কোলের ছোট্ট খোকাই যে একদিন বিশ^রত্ন হবেন এটা তাঁর মা নিজেই হয়তো জানতো না। কে জানত, বিকলাঙ্গ হয়েও স্টিফেন হকিং হবেন বর্তমান শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ পদার্থ বিজ্ঞানী, অটিজমে আক্রান্ত শিশু মোজার্ট হবে বিশ্বখ্যাত সুর¯্রষ্টা।

শিশু কাদামাটির মতো। কাদামাটিকে সহজেই যে কোনো আকৃতি দেয়া যায়। কাদামাটি দিয়ে যেমন দুর্গার মুর্তি গড়া যায় তেমনি অসুরও তৈরি করা যায়। কাদামাটি দিয়ে যেমন সুন্দর ফুলদানি গড়া যায়, আবার তামাক খাওয়ার কলকিও তৈরি করা যায়। শিশু বয়সের যত্ন ও পরিচর্যা একটি শিশুকে যেমন সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখড়ে নিয়ে যেতে পারে, আবার তেমনি শিশু বয়সের অযত্ন ও অবহেলা একটি শিশুকে ধ্বংসের চরম সীমায়ও নিয়ে যেতে পারে। এর পেছনে কাজ করে শিশুর মেধার যথাযথ বিকাশ হচ্ছে কি-না বা মেধা কোন্ দিকে ব্যবহার করা হচ্ছে সেটি পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর। শিশুর মেধার সঠিক ও যথাযথ বিকাশ খুবই জরুরি। শিশুর মেধার যথাযথ বিকাশের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত সুযোগ, প্রয়োজন সুন্দর অনুকূল পরিবেশ। মাদার তেরেসা একবারই পৃথিবীতে আসবেন এমন নয়। প্রত্যেক কন্যাশিশুই মাদার তেরেসার মতো হতে পারে, হতে পারে শিরিন এবাদির মতো বিশ^শান্তির দূত। কোনো শিশু মায়ের পেট থেকে আইনস্টাইন হয়ে জন্মায় না, তাকে আইনস্টাইন হওয়ার সুযোগ করে দিতে হয়।

একটি দেশ তথা জাতির উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সব ধরনের মেধাবী ও দক্ষ জনবল যা একটা রাষ্ট্রকে সব দিক থেকে পরিপূর্ণ করে তুলবে। কোনো কাজকেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। একটি দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সব স্তরেরই যোগ্য লোক আবশ্যক। অধিকন্তু প্রয়োজন দক্ষ রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিজ্ঞানী, আমলা, খেলোয়াড়, কবি, সাহিত্যিক ইত্যাদি; মোট কথা মানবসভ্যতার উন্নয়নের জন্য যে ধরনের মহাপুরুষ দরকার তার সবই থাকতে হয়।

‘যতনে বাড়ে রতন’- কথাটি সামান্য একটি প্রবাদ হলেও এর তাৎপর্য ও গুরুত্ব অনেক। আজকের রেল বা বাস স্টেশনে গান করা শিশুটিকে সুযোগ করে দিতে পারলে মাইকেল জ্যাকসনের মতো বা তার চেয়ে বড় শিল্পী বা তারকা আমরা পেতে পারি; পেতে পারি নোলক-সালমার মতো তারকা-শিল্পী। রিক্সাওয়ালা আকবরের কথা আমরা সবাই জানি। ঘরের উঠোনে বা ঘরের আঙিনায় ফুটবল খেলা ছোট ছেলেটা হয়তো একদিন হতে পারে পেলে-ম্যারাডোনা-মেসির মতো বিশ^খ্যাত তারকা ফুটবলার। অনেক মাশরাফি, মুস্তাফিজ ছড়িয়ে আছে বাংলার আনাচে-কানাচে। জয়নুল আবেদিন বা কামরুল হাসানের মতো অনেক চিত্রকর লুকিয়ে আছে বাংলার ঘরে ঘরে। উপযুক্ত সুযোগ পেলে অনেকেই হতে পারে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু। সামান্য সুযোগ হয়তো একটি শিশুর প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে। বাংলার মাটিতে নিউটন বা পেলে জন্ম নেবে না এমন কোনো বিধান নেই। এই বাংলার মাটিতেই জন্ম নিয়েছে অনেক মেধাবী; যাদের মেধা আজকে পথিবীকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে।

প্রতিটি শিশু অনন্য। প্রতিটি শিশুই অসীম সম্ভবনাময়। আজকের ছ্ট্টো একটি শিশুর মধ্যে কী সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে তা পূর্ব থেকে বলার কোনো সুযোগ নেই। তাই প্রতিটি শিশুর প্রতি আমাদের আস্থা রাখতে হবে। কাউকে অবজ্ঞা বা খাটো করে দেখা যাবে না। সকলকে সমভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে সব শিশু এক রকম নয়। সব শিশু একভাবে শেখে না। শিশুরা ভিন্ন ভিন্নভাবে শেখে। একেক শিশুর শেখার ধরন একেক রকম। কেউ দেখে, কেউ শুনে, কেউ ধরে বা ছুঁয়ে, কেউ হাতে-কলমে কাজ করে শেখে, কেউ-বা তাল-ছন্দ বা গানের মাধ্যমে শেখে। আবার কেউ একাকী চিন্তা করে শেখে, কেউ দলে কাজ করে শেখে, কেউ যুক্তি খাটিয়ে শেখে, আবার কেউ খেলার ছলে শেখে। কেউ অনুকরণ করে শেখে, কেউ-বা অনুসরণ করে শেখে। সবার শেখার ধরন এক রকম নয়। আবার যে দেখে শেখে সে যে শুনে বা অন্য কোনোভাবে শেখে না তাও ঠিক নয়। যে দেখার মাধ্যমে শেখে সে অন্যভাবেও শিখতে পারে। তবে দেখার মাধ্যমে সে সহজে শেখে। তার কারণ দৃষ্টির ছাপ তার শিখনকে দৃঢ় করে। মূলকথা ভিন্ন ভিন্ন শিশু ভিন্ন ভিন্নভাবে সহজে শেখে। কাজেই সকল শিশুকে একভাবে শেখাতে চাওয়া যৌক্তিক ও ফলপ্রসূ নয়।

একেক শিশু একেকভাবে শেখে। অর্থাৎ একেক শিশুর বুদ্ধিমত্তা বা মেধা একেক রকম। শিশুর বুদ্ধিমত্তা নানা প্রকার। গবেষণায় দেখা যায় শিশুরা কমপক্ষে নয় ধরনের বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে শেখে। যেমন- মৌখিক ও ভাষাবৃত্তীয় বুদ্ধিমত্তা, যৌক্তিক ও গাণিতিক বুদ্ধিমত্তা, দৃষ্টি ও অবস্থানমূলক বুদ্ধিমত্তা, অনুভূতি ও শরীরবৃত্তীয় বুদ্ধিমত্তা, ছন্দ ও সংগীতমূলক বুদ্ধিমত্তা, অন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তা, আন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তা, প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তা ও আধ্যাত্মিক বুদ্ধিমত্তা। এ বুদ্ধিমত্তাসমূহ মানুষের মস্তিষ্কের কতগুলো নির্দিষ্ট স্থানে বিদ্যমান। আর এ নির্দিষ্ট স্থানগুলো কখনও স্বাধীনভাবে কখনও-বা সমষ্টিগতভাবে পরিচালিত হয়। এই বুদ্ধিমত্তাসমূহের মাত্রাও সকল শিশু তথা মানুষের ক্ষেত্রে সমান নয়। কারো কোনো বুদ্ধিমত্তা প্রবল/প্রকট, আবার কারো কোনো বুদ্ধিমত্তা দুর্বল/প্রচ্ছন্ন। আচরণ ও কার্যকলাপ থেকে এ পার্থক্য সহজে বোঝা যায়। ভিন্ন ভিন্ন বুদ্ধিমত্তার লক্ষণও ভিন্ন ভিন্ন। যেমন- বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৌখিক ও ভাষাবৃত্তীয় বুদ্ধিমত্তা এবং ছন্দ ও সংগীতমূলক বুদ্ধিমত্তা প্রবল ছিল। তেমনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের দৃষ্টি ও অবস্থানমূলক বুদ্ধিমত্তা, স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তা, ম্যারাডোনার অনুভূতি ও শরীরবৃত্তীয় বুদ্ধিমত্তা, আইনস্টাইন এবং নিউটনের যৌক্তিক ও গাণিতিক বুদ্ধিমত্তা প্রবল ছিল

শিশুর বুদ্ধিমত্তার লক্ষণগুলো থেকে কোন্ শিশু কোন্ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী তা সহজে নির্ধারণ করা যায়। যথাযথ কার্যক্রম ও পরিচর্যার মাধ্যমে শিশুদের প্রবল বুদ্ধিমত্তাকে আরও শক্তিশালী ও দুর্বল/লুকানো বুদ্ধিমত্তাকে শক্তিশালী/বের করে আনা সম্ভব। শিশুদের প্রবলতম বুদ্ধিমত্তাসমূহ ব্যবহার করে শেখালে তাদের শিখন সহজ ও নিশ্চিত করা যায়। যেমন- যে শিশুর ছন্দ ও সংগীতমূলক বুদ্ধিমত্তা প্রবল তাকে গান-নাচের মাধ্যমে শেখালে সহজেই শেখানো সম্ভব, আবার যে শিশুর অনুভূতি ও শরীরবৃত্তীয় বুদ্ধিমত্তা প্রবল তাকে যদি খেলার ছলে শেখানো যায় তাহলে সে সহজেই শিখতে পারবে। অন্যদিকে যে শিশুর মধ্যে যে বুদ্ধিমত্তা প্রচ্ছন্ন/লুকিয়ে আছে তাকে সেই বুদ্ধিমত্তার কাজ দিয়ে তার মধ্যে লুকানো বুদ্ধিমত্তাটিকে বের করে আনা সম্ভব।

যেমন- একটি অন্তঃব্যক্তিক শিশু একা একা পড়তে বা শিখতে পছন্দ করে। তাকে যদি দলগতভাবে পড়ার বা দলে কাজ করার সুযোগ করে দেয়া হয় তবে আস্তে আস্তে তার মধ্যে আন্তঃব্যক্তিক বুদ্ধিমত্তা জাগ্রত হবে। শিশু কোনো কিছুতে উৎসাহিত হলে তাকে সেই সুযোগ করে দিতে হবে, তার কাজের প্রশংসা করতে হবে। কোন্ শিশু কোন্ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী তা চিহ্নিত করে যদি সেভাবে শেখানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় তবে সে একদিন কালজয়ী হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান ক্রিকেটার না হয়ে যদি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতেন তবে নিশ্চয়ই এত খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করতে পারতেন না। আবার ডা. প্রাণগোপাল দত্ত ডাক্তার না হয়ে যদি ক্রিকেটার হতেন তবে নিশ্চয়ই তিনি বিশ^সেরা অলরাউন্ডার হতে পারতেন না।

মহান সৃষ্টিকর্তা সকল শিশুকেই মেধা ও বুদ্ধি দান করেছেন। কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষাপটে তা বিভিন্ন রকম হয়। কারো মেধা অল্প সময়ে বিকশিত হয়, আবার কারো মেধা দীর্ঘদিন সুপ্ত থাকার পর বিকশিত হয়। কারো মেধা আস্তে আস্তে বিকশিত হয়, আবার কারো মেধা সঠিক যত্ন ও পরিচর্যার অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। আজকের সুস্থ, সবল ও বুদ্ধিদীপ্ত মেধাবী শিশু আমাদের ভবিষ্যৎ। তাই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কর্ণধার এই শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশে পিতামাতা, পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণকারী শিশুর উপর নিজের ইচ্ছা, প্রভাব, স্বপ্ন চাপিয়ে দেয়া যাবে না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। মেধার সুষ্ঠু ও যথাযথ বিকাশের জন্য কোন্ শিশু কোন্ মেধাসম্পন্ন বা কোন্ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন তা জানা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।

লেখক: শরীফুল্লাহ মুক্তি
প্রাবন্ধিক, শিক্ষা-গবেষক ও ইন্সট্রাক্টর,
উপজেলা রিসোর্স সেন্টার (ইউআরসি),
বারহাট্টা, নেত্রকোনা।
ই-মেইল- [email protected]

Leave a Comment

error: Content is protected !!