বাঁশ খান, সুস্থ থাকুন; জেনে নিন বাঁশের কার্যকারিতা

বাঁশ খান, সুস্থ থাকুন বাঁশের কার্যকারিতা জেনে নিন: প্রচলিত জনপ্রিয় ধারার একটি শব্দ ‘বাঁশ’। একে অ’পরকে ক্ষতি করার ক্ষেত্রে অথবা উপহাস করার ছলে ‘বাঁশ’ শব্দটি বলে থাকেন। বিভিন্ন রোগ থেকে খুব সহজেই মুক্তি দিতে বাঁশের কার্যকারিতা অ’পরিসীম।

এমনকি চিনা সভ্যতায় বাঁশ শুভশক্তির প্রতীক। বাড়ির আশেপাশে বা ভেতরে বাঁশ রোপণ তাদের ঐতিহ্য। তবে বাঙালি বাঁশ নিয়ে খুব সংবেদনশীল। সহজে বাঁশের ধারে কাছে যান না। অথচ আমাদের দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে বাঁশ খুবই সুস্বাদু একটি খাবার।

বাংলাদেশের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকজন বাঁশের চোঙে রাঁধেন, বাঁশও থাকে রেসিপিতে। আমাদের গ্রামেও ছোটবেলায় দেখেছি, বাঁশঝাড়ে শিশুবাঁশের মুখে হাঁড়ি বাঁধা হচ্ছে, হাঁড়ির ভেতরে বাঁশ সাপের মতো পেঁচিয়ে বড় হবে, পরে তা রেঁধে খাওয়া হবে। কাজেই বাঁশ বাঙালির খাদ্যতালিকায় চিরকালই ছিল।

দৈহিক সুস্থতায় বাঁশ খুবই উপকারী। বিভিন্ন রোগ থেকে খুব সহজেই মুক্তি দিতে বাঁশের কার্যকারিতা অপরিসীম। তাইতো চীনারা বাঁশের কোড়লকে বলেন ‘স্বাস্থ্যকর খাবারের রাজা’। চলুন তবে জেনে নেয়া যাক বাঁশের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতাগুলো-

বাঁশের পুষ্টিগুণ:

তাজা বাঁশের কোঁড়লে ৮৮-৯৩% পানি, ১.৫-৪% প্রোটিন, ০.২৫-০.৯৫% চর্বি, ০.৭৮-৫.৮৬% চিনি, ০.৬০-১.৩৪% সেলুলোজ এবং ১.১% খনিজ পদার্থ আছে। এতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিনও বিদ্যমান।

বাঁশের উপকারিতা:

বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা গেছে দেহের নানা রোগ প্রতিরোধ করে বাঁশ। চলুন জেনে নেয়া যাক সেগুলো-
১. বাঁশের কোঁড়ল দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
২. এটি উচ্চ রক্তচাপ কমায় ও ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমায়।
৩. কোষ্ঠ্যকাঠিন্য দূর করতে বাঁশের জুড়ি নেই।
৪. তাছাড়া হাঁপানী, ডায়াবেটিস, তীব্র জ্বর, মৃগি রোগে মূর্ছা যাওয়া ইত্যাদি নিরাময়েও যথেষ্ট অবদান রাখে বাঁশ।
৫. কচি বাঁশের সবুজ রং দৃষ্টিশক্তি সতেজ রাখে এবং স্নায়ুতন্ত্রকে স্নিগ্ধতা দেয়।
৬. সেরিব্রাল কর্টেক্স ও রেটিনার পক্ষে এ রং অতি উপকারী।
৭. বাঁশও এক ধরনের গাছ। বাঁশও অক্সিজেন ত্যাগ করে বাতাস শুদ্ধ করে।
৮. ভেতরে ফাঁপা ও বাইরে শক্ত এ গাছ নেগেটিভ এনার্জিকে প্রতিহত করে।
৯. ৩৫-১২০ বছরে বাঁশগাছে ফুল আসে। এ ফুল সৌভাগ্যের প্রতীক।
১০. ঋতু অনুযায়ী বাঁশের রং বদল ঘরের একঘেয়েমি দূর করে। মনকে সতেজ রাখে।
১১. বাড়ির ভেতরে বাঁশ রোপণ করলে তা অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করে।

যেকোনো সবজির সঙ্গে তুলনা করলে বাঁশের কোঁড়ল কোনোভাবেই হেলাফেলার নয়। তাই খাদ্য তালিকায় অবশ্যই চেষ্টা করুন বাঁশের কোঁড়ল রাখার।

জীবনে বাঁশ গাছের ভূমিকা

বাঁশ নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও নিজের অস্তিত্ব অটুট রাখতে ও বেড়ে উঠতে পারে। বহু ঝড়-ঝাপটা বাঁশ সইতে পারে।

ফেংশুই মতে, বাঁশ সৌভাগ্যের প্রতিক। কেবল তাই নয়, বাঁশ গাছ সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ জীবনের সঙ্কেত দেয়।

বাঁশঝাড় না হোক, আপনার বাড়িতে যদি, দু-চারটি বাঁশগাছ থাকে তা হলেই যথেষ্ট। এই গাছ আপনাকে সর্ব দিকে সৌভাগ্য প্রদান করবে।

বাড়িতে যদি বাঁশ গাছ রাখার সুবিধা না থাকে, তা হলে বাঁশগাছের ছবি ঘরে রেখেও আপনি আপনার বাড়ির শুভ প্রাণশক্তিকে প্রবল ভাবে সক্রিয় করে তুলতে পারেন।

বাড়ি বা দোকানের সুরক্ষার জন্য আপনি বাঁশের ছবি না রেখে যদি বাঁশের একটা ৬-৮ ইঞ্চি লম্বা দণ্ড বা কঞ্চি প্রধান প্রবেশ পথের ভিতর বিপরীত দেওয়ালের ওপরে লাগিয়ে রাখতে পারেন।

এর ফলে আপনার বাড়ির স্থায়িত্ব দীর্ঘ হবে। আপনার ব্যবসা সকল প্রকার সঙ্কটের মধ্যেও বাঁশের মতোই টিকে থাকবে।

কেবল তাই নয়, যেহেতু বাঁশ গাছ সুস্বাস্থ্য ও সৌভাগ্যদায়ক, সুতরাং আপনার পড়তি ব্যবসারও উন্নতি বিধান হবে দোকানে বা ব্যবসাস্থলে বাঁশের একটি কঞ্চি রাখলে।

যদি বাঁশের দণ্ড বা কঞ্চি রাখতে চান, তা হলে তার গায়ে লাল সুতো জড়িয়ে নেবেন। কঞ্চি এক জোড়া হলে লাল সুতো দিয়ে সেগুলো বেঁধে নেবেন। তবে কঞ্চি বা দণ্ডগুলির মুখগুলি যেন দু’দিক থেকে খোলা থাকে।

কোন বাঁশ কী কাজে লাগে

উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বলেন, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সাত ধরনের বাঁশ বেশি দেখা যায়। এর মধ্যে বরাক, করজবা, বাইজ্জা, তল্লা, মাকলা, ভুদুম অন্যতম। এসব প্রজাতির বাঁশের কাণ্ড পুরু ও কাষ্ঠল বলে ঘরের বেড়া ও খুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া পাকা বাড়ি তৈরির সময় ছাদ ঢালাই দিতেও এসব বাঁশের প্রয়োজন হয়।

সিলেট অঞ্চলে বেশি দেখা যায় তল্লা, মাকলা ও করজবা বাঁশ। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাইজ্জা, যশোর ও খুলনা অঞ্চলে বরাক এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলে পাওয়া যায় ভুদুম বাঁশ। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ প্রায় সারা দেশেই মুলি বাঁশের দেখা মেলে। এই বাঁশ রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনায় অবস্থিত কর্ণফুলী কাগজের কলের প্রধান কাঁচামাল।

২০১০ সালে চীনের বাঁশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই উদ্যান থেকে দেশি মুলি বাঁশের বীজ সংগ্রহ করে। বিনিময়ে তারা চায়না বাঁশের প্রজাতি দেয়। চীন, জাপানসহ বিশ্বের অনেক দেশের গবেষক এই উদ্যান দেখতে আসেন।

বিএফআরআইয়ের সাবেক গবেষক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ১৯৭৩ সালে যখন এই উদ্যান গড়ে তোলা হয়, তখন এশিয়া মহাদেশে কেবল জাপান ও চীনে এ ধরনের উদ্যান ছিল।

সরবরাহ হয় চারা

প্রতিবছর কয়েক হাজার চারা এই উদ্যান থেকে উত্তোলন করা হয়। বর্তমানে উদ্যানের নার্সারিতে ভুদুম, ওরা, বাইজ্জা, তেতুয়া ও চায়না বাঁশের আট হাজার চারা রয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাগান ও বন সৃজনে এই উদ্যানের চারা ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০০৮ সালে এই কেন্দ্র থেকে ১০ হাজার বাঁশের চারা নিয়ে মধুপুর অঞ্চলের বনে লাগানো হয়।

উদ্যানের খাড়া পথ বেয়ে ওঠা পথের দুধারে লাগানো হয়েছে শোভাবর্ধনকারী হেজ বা বেড়া বাঁশ। তার পাশেই দেখা যাবে ছোট আকৃতির চায়না বাঁশ। এই বাঁশের কচি কাণ্ড সুস্বাদু। মূলত সবজি হিসেবে ব্যবহারের কথা মাথায় রেখে চীন থেকে এই প্রজাতির বাঁশ এনে উদ্যানে লাগানো হয়েছে।

বিশাল উদ্যানে ছড়ানো বাঁশগুলোর কোনোটির কাণ্ড সরু, কোনোটির লতানো, কোনোটির রং সোনালি, কোনোটি আবার ছাতার মতো ঘন আচ্ছাদন তৈরি করেছে মাথার ওপর। ছায়া-সুনিবিড় ব্যাম্বো সেটামে বাঁশ পাতার ঝিরিঝিরি শব্দে কান পাতা দায়। একটু জোরে বাতাস বইলে শোনা যায় একটা বাঁশের সঙ্গে আরেকটা বাঁশের ঠোকাঠুকির শব্দ।

পাহাড়ের ঢালে কাঁটা বাঁশগুলো যেন নিজেদের চারদিকে বর্ম তৈরি করে রেখেছে। প্রায় ৫০ ফুট উঁচু বাঁশগুলোর প্রতি গিঁট থেকে বেরিয়েছে কাঁটাযুক্ত শাখা। বাঁশঝাড়টির গোড়া থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত এমন দুর্ভেদ্য কাঁটার বর্ম। থাইল্যান্ড থেকে সংগ্রহ করা এই বাঁশের বেশ কয়েকটি ঝাড় রয়েছে এই উদ্যানে।

বাগানের একটা জায়গায় এসে বাঁশের শিকড়ে ছাওয়া মাটি দেখিয়েছিলেন মাঠকর্মী মোনায়েম ভূঁইয়া। তিনি বলেন, কার্পেটের মতো শিকড় মাটি আঁকড়ে ধরে থাকে। একইভাবে বাঁশ পাহাড় ধরে রাখে। আর বাঁশ নেই বলেই পাহাড়ধস হচ্ছে।

উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা বলেন, বাঁশ দ্রুত বর্ধনশীল। চারা লাগানোর পর একটি বাঁশঝাড় পাঁচ বছরেই পূর্ণাঙ্গ ঝাড়ে পরিণত হয়। পাঁচ বছর পর একটি ঝাড় থেকে বছরে পাঁচটি বাঁশ কাটা যায়। এরপরের বছর থেকে আরও একটি করে বেশি বাঁশ পাওয়া যায় বাঁশঝাড়ে। একমাত্র মুলি বাঁশই ঝাড় ছাড়া জন্মায়।

সংরক্ষণাগারের চেয়ে বেশি কিছু

সিলভি কালচার জেনেটিকস বিভাগের প্রধান মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রজাতি সংরক্ষণের পাশাপাশি বাঁশঝাড় ব্যবস্থাপনা, চারা উৎপাদন, বীজ সংরক্ষণ ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবেও কাজ করছে এই উদ্যান। এখানে বাঁশের জিনবৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এই উদ্যান ঘিরে চারা উত্তোলনের টিস্যু কালচার সেন্টার ও নার্সারিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ পর্যন্ত তিন প্রজাতির বাঁশের টিস্যু কালচারের মাধ্যমে চারা উত্তোলন করা গেছে। কঞ্চি কলম পদ্ধতিতে বাকি প্রজাতিগুলোর চারা তৈরি হচ্ছে।

উদ্যানের পাশেই বাঁশ গবেষণাগার। সেখানে হরেক প্রজাতির বাঁশের বীজের দেখা মিলবে। এর কোনোটি গমের মতো, কোনোটির চেহারা পেঁয়াজের মতো। ২৫ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে বাঁশে ফল ধরে ও বীজ আসে। বাঁশের বংশবৃদ্ধিতে এখন কলম ও টিস্যু কালচার পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিবছর কয়েক হাজার চারা এই কেন্দ্র থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণও করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল গফুর বলেন, দেশি জাতের বাঁশের জিনবৈচিত্র্য এখানে সংরক্ষিত হচ্ছে। এর মধ্যে ভুদুম, মুলি ও বাইজ্জার অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক। এসব প্রজাতির বাঁশের জিনবৈচিত্র্য বিশ্বের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বাঁশ উৎপাদনে বাংলাদেশ অষ্টম

দুর্যোগ প্রতিরোধী, জলবায়ুসহিষ্ণু এবং পরিবেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত বাঁশ হারিয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী কুটিরশিল্পের উৎপাদনও কমে আসছে। বাঁশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে নিয়মিত গবেষণা করছে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)।

প্রতিষ্ঠানটি ৩৩ জাতের বাঁশও সংরক্ষণ করেছে চট্টগ্রামের ষোলশহরে ইনস্টিটিউটের বাঁশ উদ্যানে। এসব বাঁশ সারাদেশে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। এদিকে বিএফআরআই জলবায়ুসহিষ্ণু আরও ৬টি নতুন প্রজাতির বাঁশের জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে দুটি জাতের বাঁশের কাণ্ড সবজি হিসেবেও খাওয়া যাবে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) গ্লোবাল ব্যাম্বু রিসোর্সেস প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রজাতিবৈচিত্র্য ও উৎপাদনগত দিক বিবেচনায় ৩৩ প্রজাতির বাঁশ নিয়ে বাংলাদেশ বর্তমানে সারাবিশ্বে অষ্টম স্থানে রয়েছে। ৫০০ প্রজাতির বাঁশ নিয়ে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে রয়েছে চীন। ব্রাজিল ২৩২ প্রজাতি নিয়ে রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে।

বাঁশের তৈরি নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন হস্তশিল্প বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। উত্তরা ইপিজেডে তৈরি হচ্ছে বাঁশের কফিন, যা রফতানি হচ্ছে ইউরোপে। রফতানি হচ্ছে বাঁশের বাঁশি। কাগজ তৈরি হচ্ছে বাঁশ দিয়ে। বাঁশের তৈরি পণ্য পরিবেশবান্ধব হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ মোকাবেলা ও ভূমিক্ষয় রোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বাঁশঝাড়।

গ্রামাঞ্চলে বাঁশের গুরুত্ব অপরিসীম। স্কুল ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পতাকার স্ট্যান্ড বানানো হয় বাঁশ দিয়ে। গৃহনির্মাণ থেকে শুরু করে হস্তশিল্পসহ নিত্যদিনের ব্যবহার্য বিবিধ জিনিসপত্র তৈরির কাজে বাঁশ বহুল ব্যবহূত। ঘর, ক্ষেতের বেড়া ও খুঁটি, সবজির মাচায় ব্যবহূত হয় বাঁশ। ছোট খাল পেরুতে লাগে বাঁশের সাঁকো। তোরণ ও প্যান্ডেল তৈরি, শহরের ভবন নির্মাণেও লাগে বাঁশ। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে করপোরেট অফিস- সবখানেই নানাভাবে ব্যবহূত হয় বাঁশ।

বাঁশের মণ্ড থেকে বস্ত্রশিল্পের তুলা ও সুতা তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন প্রকার ভেষজ ওষুধ হচ্ছে। বেদে সম্প্রদায়ের ব্যাম্বু ম্যাসেজ একটি অতি পরিচিত থেরাপি। এমনকি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দূরতম অনেক শহরেও প্রাকৃতিক উপায়ে চিকিৎসা দিতে গড়ে উঠেছে ব্যাম্বু থেরাপি সেন্টার। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কাজে লাগে এই বাঁশ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ড. শায়লা সারমীন বলেন, বাঁশ পুষ্টিও জোগায়। কচি বাঁশের নরম কাণ্ড এশিয়াজুড়ে খাওয়া হচ্ছে। খাদ্যগুণ ও স্বাদের কারণে চীন, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারে বাঁশ ভেজিটেবল হিসেবে বেশ সমাদৃত। কচি বাঁশের ডগা বা বাঁশ কড়াল মুখরোচক সবজি হিসেবে খাওয়ার উপযোগী। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বর্ষা মৌসুমে বাঁশের কাণ্ড খেয়ে থাকে। বাঁশের শাখা ও পাতা উত্তম পশুখাদ্য। বিরল প্রজাতির পান্ডা কচি বাঁশ ও পাতা খেয়েই বেঁচে থাকে। পৃথিবীর বৃহৎ স্তন্যপ্রায়ী প্রাণী হাতির কাছেও বাঁশ পাতা একটি প্রিয় খাবার।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মোবারক হোসেন বলেন, বাঁশ অন্যান্য গাছপালার চেয়ে বেশি পরিমাণে অক্সিজেন উৎপন্ন করে, অথচ বেশি মাত্রায় কার্বন ডাই-অক্সসাইড নেয়। নদীভাঙন ও ভূমিক্ষয় রোধে বাঁশের রয়েছে বিশাল ক্ষমতা।

বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিলভিকালচার (বন সংরক্ষণবিদ্যা) জেনেটিক্স বিভাগের প্রধান গবেষক ড. মো. মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, খুব শিগিগিরই বাঁশের নতুন ছয়টি জাত উন্মুক্ত করা হবে। তিনি জানান, জলবায়ুসহিষ্ণু ও দেশের আবহাওয়া উপযোগী এসব বাঁশ পাহাড়ধস, ভূমিক্ষয় ও নদীভাঙন রোধে কাজ করবে।

ইতিমধ্যে তিনটি বাঁশের বৈজ্ঞানিক নামকরণ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- ম্যাসু বাঁশ, এস্পার বাঁশ ও ল্যাটি ফ্লোরাস বাঁশ। চীন বিশ্বে বাঁশ ও বাঁশজাত পণ্য রফতানি করে বিপুল অর্থ আয় করছে। বাঁশের ফার্নিচার ও আসবাবপত্র পরিবেশবান্ধব। জাপানে নদীভাঙন রোধ ও বাঁধ রক্ষায় বাঁশ ব্যবহার বাধ্যতামূলক।

বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) পরিচালক ড. খুরশীদ আকতার সমকালকে বলেন, ১৯৭৩ সালে পাঁচ একর জায়গার ওপর গড়ে তোলা হয় বাঁশ উদ্যান। এটি দ্রুত বর্ধনশীল একটি উদ্ভিদ। কম বিনিয়োগে বাঁশ চাষে বেশি লাভ হয়। জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে এই গাছ। বাঁশ উদ্যান বাঁশের প্রজাতি সংরক্ষণের পাশাপাশি বাঁশঝাড় ব্যবস্থাপনা, চারা উৎপাদন, বীজ সংরক্ষণ এবং প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবেও কাজ করছে। এ দেশে হারিয়ে যাওয়া অনেক বাঁশের বীজের একটি জার্মপ্লাজম সংরক্ষণাগার তৈরি করা হয়েছে।

বিএফআরআই বাঁশ উদ্যানে ২৬টি দেশি ও ১৩টি টিস্যু কালচারের মাধ্যমে চারা উদ্ভাবন করা হয়েছে। বাঁশের প্রজাতিগুলোতে ২৫ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে ফল ধরে ও বীজ আসে। বাঁশের বংশবৃদ্ধিতে এখন টিস্যু কালচার পদ্ধতি বিশেষ জনপ্রিয়। ভবিষ্যতে এর চাষাবাদ আরও বাড়বে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!