বাঙালি জীবনে বাঁশ

বাঙালি জীবনে বাঁশ। বাঙালির সঙ্গে পান্ডার মিল আছে, অমিলও আছে। উভয়েই জীবনভর বাঁশ খায়। অমিল হলো পান্ডা বিলুপ্তপ্রায়, বাঙালি বর্ধিষ্ণু জাতি। বাঙালির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বাঁশ। জন্মের পর বাঁশের চাঁছি দিয়ে নাড়ি কাটা হয়। তারপর বাঁশের তৈরি দোলনায় দোল খায় বাঙালি শিশুরা। মৃত্যুর পর বাঁশের খাটিয়ায় তুলে বাঙালি শেষযাত্রা করে। কবরের ওপরে বাঁশ বিছিয়ে তারপর মাটি দেওয়া হয়। বাঙালির দোলনাও বাঁশের, সমাধিও বাঁশের।

বাংলাদেশের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকজন বাঁশের চোঙে রাঁধেন, বাঁশও থাকে রেসিপিতে। আমাদের গ্রামেও ছোটবেলায় দেখেছি, বাঁশঝাড়ে শিশুবাঁশের মুখে হাঁড়ি বাঁধা হচ্ছে, হাঁড়ির ভেতরে বাঁশ সাপের মতো পেঁচিয়ে বড় হবে, পরে তা রেঁধে খাওয়া হবে। কাজেই বাঁশ বাঙালির খাদ্যতালিকায় চিরকালই ছিল। বাঙালি বাঁশের ঘরে থাকে, তার চাঁদ ওঠে বাঁশবাগানের মাথায়। তার বাঁশের খাটিয়ায় শয়ন, বাঁশের খুঁটিতে ব্যাংকিং, বাঁশের চালুনিতে ফুটো অন্বেষণ, বাঁশের চোঙায় ফুঁ দিয়ে বাঁশের লাকড়িতে রান্নাবাড়া, বাঁশের চাটাইয়ে স্লোগান লিখে বাঁশের খুঁটি দিয়ে বহন। বাঁশের লগি, বাঁশের বইঠা! এমনকি আমরা ছোটবেলায় হকি খেলেছি বাঁশের ব্যাটে।

বাঁশের বেতের বাড়ি খেয়ে গরু থেকে মানুষ হয়েছি, বাঁশের মই বেয়ে ওপরে উঠে দেখেছি কে যেন সেটা সরিয়ে নিয়েছে, বাঁশের বাঁশি আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে ডাকাতিয়া, আমাদের চিত্রপট বাঁশের, আমাদের খেলনা বাঁশের, আমাদের বিদ্যুতের খুঁটি বাঁশের, আমাদের পতাকার স্ট্যান্ড বাঁশের, আমাদের কোদালের হাতল বাঁশের, আমাদের গরুর গাড়ি বাঁশের, ছই বাঁশের। আমাদের লাঠিয়ালদের লাঠিও বাঁশের। এমনকি আমাদের খড়মেও বাঁশ ছিল, কাঠের আসবাবে আমরা ব্যবহার করেছি বাঁশের পেরেক। আমাদের কাগজও বাঁশের, কলমও ছিল বাঁশের। আমরা বাঁশের টঙে বসে চা খাই, নৌকা থেকে নামি বাঁশের জেটিতে। আমাদের মাচা বাঁশের, খাঁচা বাঁশের। লালন অবশ্য বলেন, খাঁচা কাঁচা বাঁশের।

তো এমন যে বাঁশ, তা হঠাৎ আবার আলোচনায় এসেছে। চুয়াডাঙ্গার দর্শনার কোটি টাকার ভবনে ঠিকাদার ইস্পাতের বদলে ব্যবহার করেছেন বাঁশ। সেই ছবি দেখে আমাদের চক্ষু বাঁশঝাড় হয়ে উঠেছে। আমাদের সরকারি নির্মাণকাজে যে ভীষণ রকম জোচ্চুরি চলেছে যুগের পর যুগ ধরে, ওই বাঁশের ছবি তা স্পষ্ট করে তুলেছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঠিকাদার–প্রকৌশলী মিলে যে ভবন বা সড়ক বা সেতু বানানো হয়, তার মান খুবই খারাপ। বিল্ডিংগুলো বছর যেতে না যেতেই ঝুরঝুর করে ঝরতে থাকে, দরজা-জানালা খুলে যেতে থাকে। পিচঢালা পথ ঘেয়ো কুকুরের পিঠের মতো হয়ে যায়, খোয়া বেরিয়ে আসে। পুকুরচুরি বললেও কম বলা হয়।

কাজেই দর্শনায় স্বাস্থ্য বিভাগের এই ভবন আমাদের বিন্দুর মাঝে সিন্ধু দর্শনের সুযোগ করে দিয়েছে। আমাদের দার্শনিক চিত্ত দুলে উঠেছে। আমি বলি, ওই প্রকৌশলী ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা উচিত। তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু তার পাশাপাশি আমার এই আবেদনও থাকবে, তাঁদেরকে পদার্থবিজ্ঞানে অপরিসীম অবদান রাখার জন্য নোবেল দেওয়া হোক। এই নোবেল অবশ্য তাঁরা শান্তির জন্যও পেতে পারেন।

কারণ, ছবি দেখে যা বুঝলাম, প্রকৌশলী ও ঠিকাদার মিলে সেখানেই এই বাঁশ ব্যবহার করেছেন, যেখানে শুধু টেনশন বা টান পড়বে। বাঁশের টান নেওয়ার ক্ষমতা ইস্পাতের চেয়ে বেশি। স্টিলের টেনশন নেওয়ার ক্ষমতা ২৪ হাজার পিএসআই, আর বাঁশের ২৮ হাজার পিএসআই। আমরা স্টিলের বিজ্ঞাপন দেখি, বুয়েট পরীক্ষিত! বুয়েটে যে ধরনের পরীক্ষা হয়, সেই ধরনের পরীক্ষায় বাঁশ ইস্পাতের চেয়ে বেশি শক্তিশালী বলে প্রমাণিত।

১৯৬৪ সালেই ইউএস নেভি ইস্পাতের বদলে বাঁশ দিয়ে কংক্রিট বানানোর পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। আপনি ওয়েবসাইটে অন্বেষণ করলে বহু গবেষণা পাবেন, গবেষণাপত্র পাবেন, যেখানে ইস্পাতের বদলে বাঁশ ব্যবহার নিয়ে কাজ করা হয়েছে। বাঁশের ভালো দিক হলো, এর চাপ নেওয়ার ক্ষমতা ও টান নেওয়ার ক্ষমতা ইস্পাতের চেয়ে বেশি বই কম নয়। বাঁশ গাছ নয়, বাঁশ ঘাস। কিন্তু এর অসুবিধার দিকটা হলো, বাঁশ পানি শুষে নেয়। ফলে সে কংক্রিটের ভেতরে বাড়া-কমা করে। তখন কংক্রিট ফেটে যায়।

অধ্যাপক জামিলুর রেজা স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ব্যাপারটা নিয়ে। স্যার জানালেন, তিনিও কংক্রিটে বাঁশ ব্যবহার নিয়ে বহু আগে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। অধ্যাপক নজমুল হক ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে বাঁশের কংক্রিটের একটা ঘরও বানিয়েছিলেন। ওই ঘর অচিরেই ভেঙে পড়ে। ইস্পাতের বদলে বাঁশ ব্যবহার করে তিনি আরেকটা ভবন বানিয়েছিলেন।

আমার সহপাঠী বন্ধু অধ্যাপক সুকোমল মোদক যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে বসে নানান গবেষণা করেন। ড. মোদকের একটা ভাবনা হলো, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হচ্ছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে, তাহলে কেউ আর কাঁচা বাড়িতে থাকবে না। সবাই চাইবে পাকা বাড়ি। আমেরিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার ঘরবাড়ি কাঠের তৈরি।

বাংলাদেশে সবাই যদি ইটের ইমারতে থাকতে চায়, তাহলে বাংলাদেশের সব মাটি পুড়িয়ে ইট বানাতে হবে। তাহলে পরিবেশগত দামটা দিতে হবে খুব বেশি। ড. মোদকের গবেষণার বিষয় হলো, বাঁশকে কীভাবে পাকা বাড়ি বানানোর উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আজ হোক কাল হোক, ড. মোদকের গবেষণা বা পৃথিবীর আরও আরও বিজ্ঞানীদের গবেষণা সাফল্যের মুখ দেখবে। আমরা বাঁশ দিয়ে ইমারত তৈরি করতে পারব।

  • বাঁশের বেতের বাড়ি খেয়ে গরু থেকে মানুষ হয়েছি, বাঁশের মই বেয়ে ওপরে উঠে দেখেছি কে যেন সেটা সরিয়ে নিয়েছে, বাঁশের বাঁশি আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে ডাকাতিয়া, আমাদের চিত্রপট বাঁশের, আমাদের খেলনা বাঁশের, আমাদের বিদ্যুতের খুঁটি বাঁশের, আমাদের পতাকার স্ট্যান্ড বাঁশের, আমাদের কোদালের হাতল বাঁশের, আমাদের গরুর গাড়ি বাঁশের, ছই বাঁশের

সেই কাজে সফলতার দিনে আমাদের কি মনে থাকবে সেই ঠিকাদারের কথা, সেই প্রকৌশলীদের কথা, যাঁরা দর্শনায় ভবনে ইস্পাতের বদলে বাঁশ দিয়েছিলেন? থাকবে না। কাজেই যা করার আজই করুন।

প্রথমত, চুক্তিভঙ্গের জন্য তাঁদের সাজা দিন। দৃষ্টান্তমূলক সাজা। যেন আর কেউ জোচ্চুরি করতে না পারে। পুকুরচুরি করতে সাহস না পায়। দ্বিতীয়ত, তাঁদের এই প্রকৌশল-নিরীক্ষার জন্য পুরস্কার দিন। আমাদের প্রস্তাব হলো, তাঁদের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হোক। পদার্থবিজ্ঞানে হতে পারে। শান্তিতেও হতে পারে। শান্তিতে কেন? কারণ, বাংলাদেশের সব মাটিকে ইট বানানো বা বাংলাদেশে জাহাজ ভেঙে লোহা বানানোর প্রক্রিয়া থামতে পারে, যদি আমরা এর বদলে বাঁশ ব্যবহার করতে পারি। তাহলে এই বাঁশ আমাদের পরিবেশকে বাঁচাবে। আর পরিবেশ বাঁচলে বাঁচবে মানুষ। মানুষের মনে শান্তি আসবে।

তার চেয়েও বড় কথা, বাঙালির শয়নে-স্বপনে, ঘুমে-জাগরণে, জন্মে-মৃত্যুতে যেখানে বাঁশের বিকল্প নেই, সেখানে কংক্রিটের ভেতরে কেন আমরা বাঁশ দেব না? তো যে ঠিকাদার ও প্রকৌশলী মিলে আমাদের এই বাঁশ দিয়েছেন, কর্তৃপক্ষের উচিত হবে তাঁদেরও কিছু বাঁশ দেওয়া।

লেখাটা ছাপা হয়েছে পয়লা বৈশাখে। বছরের প্রথম দিনটা আমাদের সবার জন্য শুভ হোক। বাঁশ থেকেই তো বাঁশি হয়, বাঁশির মধুরতম সুরে ভরে উঠুক আমাদের প্রত্যেকের দিনরাত, সারা বছর, সারাজীবন। শুভ নববর্ষ।

আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

Leave a Comment

error: Content is protected !!