বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্য- মাহফুজার রহমান মণ্ডল

বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্য। সূর্যোদয়ে আনন্দ মিলে, এ যেন নিত্য দিনের খোরাক। নবজাতকের উদায় নতুন দম্পতির স্বপ্নে বোনা বীজ। শস্য কেটে ঘরে আনা কৃষকের মুখে হাসি। এধরণের শত উদারণও তুলনা হয় না বিজয়ের হাসি। হ্যাঁ, সেই হাসি ৩০ লক্ষ শহিদের বিনিময়ে আমদের অর্জিত হয়েছে। অনেক চড়াই-উৎরায়ের পর এই জম্মভুমির দামাল ছেলেরা আজ সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পেরেছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিতে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে। এটা কোন দয়া দখিনা নয়; নয় সেই ব্রিটিশদেরকে দেওয়া ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব যা ভারত-পাকিস্তান নামে দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম। এটা হাজারও মায়ের বুক ফাটা আর্তনাদ, বীভৎস, লাঞ্ছিত, কোলখালি আজাহারি লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে বিজিত রাষ্ট্র। ফলে এই দিনে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্প অর্পন করেন। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক, অনলাইন ও অফলাইন মিডিয়ার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আলোচনা, কবিতা পাঠ ও সঙ্গীতসহ নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

“৫২’র ভাষা আন্দোলন”, এ কিরকম জাতি! বাংলার কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছিল। “উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা” পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহ এই ঘোষণা দেন। তার এই বক্তব্য মেনে নিতে পারেনি বাংলার সর্বস্তরের জনগণ ফলে ফুসে উঠলো সাধারণ জনতা চলতে থাকলো মিশিল মিটিং। এই মিশিল মিটিং এত তীব্র আকার ধারন করলো যে পুলিশ আর সামাল দিতে পারছিল না। তাই আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, মিটিং, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু ছাত্র জনতা কি আর মানে তাই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিশিল মিটিং অব্যাহত রাখল। সেদিন ছিল ২১শে ফেব্রুয়ারী অব্যাহত মিশিলে পুলিশ গুলি চালায় ফলে রফিক, সালাম, বরকত ও আব্দুল জব্বারসহ আরও অনেকে বাংলার মাটিতে লুটিয়ে পরে। পেরেছে কি কণ্ঠরোধ করতে, তবুও কি শিক্ষা হয়েছে তাদের। বাঙালি কি না করতে পারে, তারা বুঝে ওঠার আগে দামাল ছেলেরা জীবন দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি। নেত্রিতের অভাবও বুঝতে দেননি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নিরংকুশ বিজয় লাভের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর স্বপন পূরণের আশা কিন্তু ঘাতকদের কি তৃষ্ণা মিঠে আর সহজে কি গদি ছেড়ে দিতে চায়। তাই ১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারী রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় শেখ মুজিব জনপ্রতিনিধিদের শপথ পাঠ করান। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যরা ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা এবং জনগণের প্রতি অনুগত থাকার শপথ নেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভূ্ট্টো কোয়ালিশন সরকার গঠনের ঘোষণা দিলেও শেখ মুজিব ও ভূট্টোর তিন দিনের আলোচনায় তাঁরা ব্যর্থ হন। এরপর রাজনীতির প্রেক্ষাপট দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান ভূট্টোর পক্ষ নিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা দেন। এবার এই বাংলার বন্ধু আর থেমে না থেকে ৭ই মার্চ ঘোষণা করেন- “রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ্‌”।

তাইতো ২৫শে মার্চ নেত্রিতের কারনে পাকিস্তান কারাগারে যেতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করেননি। আর তাঁরেই কণ্ঠে ঘোষিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা, এ যেন হানাদার বাহিনী ইয়াইয়া খানের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব আর এই অসম্ভবকে সম্ভব করে ছিল বাংলার সর্বস্তরের মানুষ সৃষ্টি হয় ২৫শে মার্চের কালো রাত্রি। ভয়াবহ এই কালো রাত্রির কথা ভুলার নয়, ভুলার নয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচার। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু বাংলার বিদ্রোহী সমাজ এক সুরে এক কথা স্বাধীনতা চাই; ঝরুক রক্ত বৃথা যেতে দিব না। টানা ৯মাস যুদ্ধ চলে, যুদ্ধ চলা কালীন প্রতিদিন প্রতিরাতকে কলঙ্খিত করেছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। নিরস্ত্র নর-নারী, শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার রক্তে রঞ্জিত হয়েছিলো বাংলার মাঠ-ঘাট, নদী-নালা। অগ্নিসংযোগ, নারীভোগকারি, পাকিস্তানী দালাল ও লুটতরাজে জরিত হয়েছিলো বাংলার কিছু জনগণ কিন্তু বাংলার দামাল ছেলেরা তা পরোয়া না করে ঝেঁপে পড়েছিল পাকিস্তানী জল্লাদের উপর সহযোগিতায় ছিলেন ভারত সরকার।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাঙালিরা স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাঙালি সেনাবাহিনী, ইপিআর, আনসার এবং পুলিশ পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললো। শুরু হলো আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ। ভারত স্বাধীনতা যুদ্ধে সার্বিকভাবে সাহায্য করেছিল। যুদ্ধ চলা কালীন সময়ে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিততে ১৭ই মে কুষ্টিয়ার বদ্যনাথ তলায়(মুজিবনগরে) আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ মিলিত হয়ে প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করা হল। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করা হয়। জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করা হলো। এবার মাঠ ঘাট বেঁধে নেমে পড়ল সবাই হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে কিন্তু দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাক হানাদার বাহিনী বাংলার মাটিতে তাণ্ডব লীলা চালায়। যেখানে সেখানে গণকবর ও লাশের স্তুপ বাদ যায়নি শিশু মহিলারাও।

গঠিত হয়েছিল রাজাকার, আলবদর ও আল-শামস বাহিনী যারা মূলত মুক্তিবাহিনীকে প্রতিহত করতো। এদিকে ছাত্র-শিক্ষক, শিল্পী-সাহিত্যিক, ডাক্তার-প্রকৌশলী, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, কৃষক-শ্রমিক সবাইকে নিয়ে গড়ে উঠেছিলো মুক্তিবাহিনী। এই মুক্তির জয়গান ছিল ঘরে ঘরে, তাই হানাদার বাহিনী আর বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। বাধ্য হয়েছিলো বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ তথা বাংলার জনগনের হাতে দেশকে বুঝায়ে দেওয়া। তবে ১৪ই ডিসেম্বর বাংলার বুদ্ধিজীবীদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছিলো তা ভুলার নয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর এ দেশ মুক্ত হয়; জয় হয় বাংলার।

বাংলার স্বাধীনতা লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। এই স্বাধীনতা মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগের ফসল। আমরা গভীরভাবে স্মরণ করি বিদেহী আত্মার যাঁরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে প্রজন্মকে দিয়েছে স্বাধীনভাবে চলার পথ। পাক হানাদারের থাবা থেকে নারীরাও বাদ পরেনি। ইজ্জত লুঠে তারা ক্ষান্ত হয়নি বরং তাঁদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের এ বিজয় শুধু পতাকা বা মানচিত্রে সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙ্গালীর আশার আলো। বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ভিয়েতনামের পর বাংলাদেশ এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যয় শুরু করেছিল। অনেক দেশেই স্বাধীন হয়েছে কিন্তু স্বল্পসময়ে বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে।

আজ ডিসেম্বর মাসটি আমাদের বিজয় মাস হিসেবে পরিলক্ষিত হয়েছে। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকবে বাংলার মুক্তিগামী মানুষ। এবার জাতির সংস্কৃতি স্বতন্ত্রভাবে সংরক্ষিত হবে। মুক্ত থাকবে অর্থনীতি, রাজনৈতিক সুশাসন ও স্বশাসনের আশীর্বাদ দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছাবে। ছিনিয়ে আনা ১৬ই ডিসেম্বর নামে গোলাপটি যেন সুগন্ধ ছড়ায় এটি হবে আমাদের গৌরবের দিন, আনন্দের দিন। এই দিনটি আমরা আজীবন শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করবো ও রাখব হৃদয়ের মণিকোঠায়।

লেখক
মাহফুজার রহমান মণ্ডল
কলামিস্ট, কবি ও সম্পাদক

Leave a Comment

error: Content is protected !!