ভাস্কর্য

ভাস্কর্য (ইংরেজি: Sculpture) ত্রি-মাত্রিক শিল্পকর্মকে ভাস্কর্য বলে।অর্থাৎ, জ্যামিতিশাস্ত্রের ন্যায় ভাস্কর্যকে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং গভীরতা সহ ত্রি-মাত্রিক হতে হবে। বাংলাদেশ এবং চীনের ন্যায় বিশ্বের সর্বত্র বিভিন্ন ধরনের, বহুমূখী আকৃতির ভাস্কর্য দেখতে পাওয়া যায়। রেনেসাঁ এবং আধুনিককালে এটি ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে। পুতুল, মুখোশ, মাটির জিনিসপত্র ভাস্কর্যের উদাহরণ। কিন্তু প্রায় চারশত বছর পূর্বে বিভিন্ন বিধি-নিষেধের কবলে পড়ে সেখানে ভাস্কর্য শিল্পকলার তেমন উন্মেষ ঘটেনি।

যিনি প্রস্তরাদি, কাঠ ইত্যাদি দিয়ে ভাস্কর্য করেন, তিনি ভাস্কররূপে জনসমক্ষে পরিচিতি লাভ করেন।

ভারতীয় উপমহাদেশ


খ্রীষ্ট-পূর্ব ৩৩০০-১৭০০ সালে প্রতিষ্ঠিত সিন্ধু সভ্যতায় প্রথম ভাস্কর্যের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বর্তমান পাকিস্তানের মহেঞ্জোদাড়ো এবং হরপ্পায় দেখা গিয়েছিল। পরবর্তীতে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের উত্তরণে ভারতে ব্রোঞ্জ ধাতু ও পাথরে খোদাই করে সৃষ্টি করা হয় ভাস্কর্যগুলো। সমধিক পরিচিত দেব-দেবীদের মূর্তি ভাস্কর্য আকারে তৈরী করে মন্দির কিংবা উপাসনালয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। তন্মধ্যে ইলোরা এবং অজন্তা’য় পাথরের ভাস্কর্যগুলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ ভাস্কর্য শিল্পকলা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে।

খ্রীষ্ট-পূর্ব ৪র্থ থেকে ৬ষ্ঠ শতকের মধ্যে গুপ্ত সাম্রাজ্যে মথুরা নগরের বেলে পাথর দিয়ে গড়া ভাস্কর্যগুলো খুবই উচ্চ সৌন্দর্যমণ্ডিত ও উন্নত রূচিশৈলীর পরিচয় বহন করে। পরবর্তীতে চীনের সুই রাজবংশের সময়কালীন শিল্পকলার প্রভাব গুপ্ত সাম্রাজ্যে লক্ষ্য করা যায় যা সমগ্র পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। আফগানিস্তানে নতুন ধরনের ভাস্কর্যকলার চর্চা শুরু হয়। এতে শিলা মাটি, কাদা মাটি, চুনাবালি ব্যবহার করার মাধ্যমে গুপ্ত সাম্রাজ্য পরবর্তীকালের বহমান ধারা ও ধ্রুপদী শিল্পকলার প্রভাব বিস্তার করেছিল।

৮৫০-১২৫০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বর্তমান দক্ষিণ ভারতের চোল রাজত্বকালে ব্রোঞ্জের ভাস্কর্যচিত্রে স্বাতন্ত্র্যরূপ ধারণ করে। এ সময়কালের নির্মিত ভাস্কর্য হিসেবে ব্রোঞ্জ পদার্থ দিয়ে গড়া নটরাজ তথা শিবের মূর্তি প্রধান উদাহরণ হিসেবে বিবেচ্য।[২] ভারতীয় ভাস্কর্যকলায় এ ধারাটি বিংশ-একবিংশ শতকে এসেও বিকশিত ও প্রবহমান। এর সাথে যুক্ত হয়েছে গ্রানাইট পাথর যা পল্লব রাজবংশের সময়কালীন মহাবালিপুরামের মন্দিরে দৃশ্যমান। সমকালীন প্রেক্ষাপটে ভারতীয় ভাস্কর্যকলা সাধারণত বহু দেব-দেবীকে ঘিরে আবর্তিত; পাশাপাশি ধ্রুব মিস্ত্রি’র ন্যায় আধুনিক, প্রথিতযশা ভাস্করও গড়ে তুলতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে।

ভাস্কর্য বিরোধী আন্দোলন


একত্ববাদ অর্থাৎ এক ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসের কারণে ইহুদি ধর্মে ভাস্কর্যের প্রতি নিষিদ্ধতা রয়েছে, যার ফলে ১৯ শতক পর্যন্ত রুপক ভাস্কর্য অগ্রহণযোগ্য ছিল, খ্রিষ্ট ধর্মের প্রাথমিক বিস্তৃতির আগ পর্যন্ত যেটি অব্যাহত ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে তারা প্রাথমিকভাবে বড় ভাস্কর্য গ্রহণ করে। খ্রিষ্টধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে ভাস্কর্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যদিও খ্রিষ্টানদের পূর্ব অর্থডক্স মণ্ডলী স্মরণীয় ভাস্কর্য কখনো অনুমোদন করে নি এবং ইসলাম ধারাবাহিকভাবে প্রায় সব রূপক ভাস্কর্য প্রত্যাখ্যান করেছে। অনেকে মূর্তি এবং ভাস্কর্য দুটি ভিন্ন মনে করে থাকলেও সাধারণত দুটো একই। শুধু পার্থক্য হলো মূর্তি স্থাপন করা হয় কোন ধর্মীয় উপাসনালয়ে পুজা করার জন্য আর ভাস্কর্যকে পুজা করা হয়না। তবে সম্মানার্থে নির্মিত করা হয়।

কোনটা ভাস্কর্য কোনটা প্রতিমা!!!


সুপ্রিম কোর্টে ভাস্কর্য নিয়ে এখন এতো রব কেন? যখন জামায়াতের নির্বাচনী প্রতীক দাঁড়িপাল্লা ছিলো তখন রা শোনা যায়নি কেন? দাঁড়িপাল্লা ভাস্কর্য না প্রতিমা? সুপ্রিম কোর্টে ভাস্কর্য প্রতিমা হলে দাঁড়িপাল্লাও প্রতিমা হবে না কেন? তাহলে জাতীয় শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ কি? সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধের সৌধগুলো কি?

আসুন দেখি, ভাস্কর্য আর প্রতিমা কি?ভাস্কর্য হলো-  
ভাস্কর্য (ইংরেজি: Sculpture) এক ধরনের শিল্পকলা বিশেষ। সব মূর্তিই যেমন ভাস্কর্য নয়, তেমনি ভাস্কর্যকে মূর্তি বলা চলে না। অর্থাৎ ভাস্কর্য আর মূর্তি এক জিনিস নয়। তাহলে ভাস্কর্য কি? খুব সহজ করে যদি বলতে হয়, ভাস্কর্য হলো শিল্প। প্রসঙ্গক্রমে অনিবার্য প্রশ্ন, তাহলে শিল্প কী?

নিউইয়র্কের ‘মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট’র আলফ্রেড বার মন্তব্য করেছেন, ‘শিল্পকলার সংজ্ঞা দেওয়া বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়’।   লন্ডনের ‘টেট গ্যালারি’র প্রাক্তণ পরিচালক রথেনস্টাইনের মতে, ‘শিল্পীর ইচ্ছার উপর নির্ভর করে শিল্প’।   জর্জ সায়ান্টানা মনে করতেন, শিল্পের কাজ হচ্ছে ‘মানুষকে আনন্দ দান করা’।মূলত শিল্প তাই, যা মানুষকে ভাবতে এবং সৌন্দর্য উপলব্ধি করাতে বাধ্য করে। 

প্রতিমা হলো-
প্রতিমাকে পূজা করা হয়, তার কাছে প্রার্থনা করা হয়। এছাড়া প্রতিমাকে ভাগ্যবিধাতা, রিজিকদাতা, শক্তিদাতা, এমনকি হুকুমদাতার আসনেও বসানো হয়, যা স্পষ্টই শিরক।

প্রতিমা নির্মাণের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, অতীতে যে সমাজেই মূর্তিকে বিধাতার আসনে বসানো হয়েছে সে সমাজ পরিচালিত হয়েছে মূর্তিগুলোর পুরোহিতদের সিদ্ধান্ত বা ফতোয়ায়। পুরোহিতদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত ধর্মের বিধান বলে স্বীকৃত হয়েছে। বিভিন্ন পুরোহিত বিভিন্ন বিধান, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি রচনা করেছেন এবং প্রয়োগ করেছে, যাকে কেন্দ্র করে বিবিধ অন্যায়, অবিচার, অশান্তির জন্ম হয়েছে। এ কারণে প্রতিমাপূজা ইসলামে নিষিদ্ধ।

সুপ্রিমকোর্টের ভাস্কর্যটিতে পূজা করা হয় না কিংবা এটিকে শক্তির উৎস মনে করা হয় না। তাই এটিকে প্রতিমা বলা যায় না।

ভাস্কর্য একটি প্রাচীনতম শিল্পকলা। একটি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্পকলা, রুচিবোধের নিদর্শন হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়। এই ভাস্কর্য শিল্পের মাধ্যমে হাজার হাজার বছর পূর্বের বিভিন্ন সভ্যতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া আজ সহজ হচ্ছে।

‍সুপ্রিমকোর্টের ভাস্কর্যটি রোমানদের কাছে ন্যায়  এর প্রতীক। রোমান আইন থেকেই যেহেতু আমাদের বিচার ব্যবস্থার উৎপত্তি, তাই অন্যান্য দেশের মতো এখানে এ ভাস্কর্য থাকাটা অপ্রাসঙ্গিক নয়।

ভাস্কর্যটির স্থপতি শিল্পী মৃনাল হক বলেন,  এটা আসলে কোন গ্রিক দেবী নয়, ন্যায় বিচারের প্রতীক৷ এটা উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতিই ঠিক করে দিয়েছেন৷ আমি শিল্পী বা কারিগর হিসেবে তৈরি করে দিয়েছেন মাত্র৷ গ্রিক দেবীরা কি শাড়ি পরে? তাদের মাথার চুল কি লম্বা থাকে? কোনটিই নয়৷ এটি একজন বাঙালি নারীর চিত্র।

মৃনাল বলেন,  ওই নারীর এক হাতে দাঁড়িপাল্লা, আরেক হাতে তলোয়ার এবং চোখ বাঁধা, যা ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ যারা এটাকে গ্রিক দেবী বলছেন তারা ঠিক বলছেন না৷ এটা রিয়েলিস্টিক ফর্মে করা হয়েছে৷

কিন্তু, অন্যান্য দেশে স্থাপিত ভাস্কর্যের সঙ্গে আমাদের দেশের ভাস্কর্যের পার্থক্য রয়েছে। অন্যান্য দেশে ভাস্কর্যের গায়ে স্কার্ফ পরা থাকলেও এখানে শাড়ি পরানো হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধতা অপরাধ, সেই আলোকেই এখানে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

এ উপমহাদেশের অধিকাংশ খ্যাতনামা স্থাপত্যই মুসলমান শাসকদের সৃষ্টি। আফগানিস্তানে তালেবান জঙ্গিরা যখন বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করে, তখন ইরানের পার্লামেন্ট তার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল।

যে যুক্তি দিয়ে এ দেশে ভাস্কর্যের বিরোধিতা করা হয়, সে যুক্তিতে কিন্তু মানুষের ছবি তোলাটাও ঠিক নয়।

মুসলমানদের তীর্থস্থান খ্যাত সৌদি আরবের জেদ্দাতেই আছে দুই দুইটি মূর্তি! একটি উটের ‘মূর্তি’, আরেকটি মুষ্টিবদ্ধ হাত সদৃশ ‘মূর্তি’। এসব নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।

ইরান, মিসর, ইরাকের জাদুঘরে অসংখ্য ভাস্কর্য এবং প্রাচীন শাসক ও দেব-দেবীর মূর্তি তো রয়েছেই, সেসব দেশে উন্মুক্ত স্থানে রয়েছে অনেক ভাস্কর্য। ইরানে আছে একটি বিশাল স্বাধীনতাস্তম্ভ, যার নাম ‘আজাদী’। এ স্থাপত্যটির ডিজাইনার হোসেন আমানত একজন মুসলমান।   মাশহাদ নগরীতে ভাস্কর্য সংবলিত নাদির শাহ সমাধিসৌধটি পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়।

পিরামিডের জন্য দুনিয়াজোড়া খ্যাতি মিসরের। পাথরের তৈরি মূর্তি সংবলিত গিজা পিরামিড সারা দুনিয়ার পর্যটকদের অতি প্রিয়। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে মাহমুদ মোখতারের বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘মিসরের রেনেসাঁ’।

ইরাকেও আছে অনেক ভাস্কর্য। বাগদাদ বিমানবন্দরের সামনে ডানার ভাস্কর্যটি সবার নজর কাড়ে। বাগদাদের পাশে আল-মনসুর শহরে আছে মনসুরের একটি বিশাল ভাস্কর্য। আছে অনেক সাধারণ সৈনিকের ভাস্কর্য। সাদ্দাম হোসেনের বিশাল আকারের ভাস্কর্যটি মার্কিন আগ্রাসনের পর ভেঙে ফেলে সাদ্দামের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, যারা মার্কিন বাহিনীর মদতপুষ্ট।

পারস্যের কবি শেখ সাদী। উনি হচ্ছেন সেই মানুষ যার ‘নাত’-এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা মিলাদে সব সময় পাঠ করে থাকেন ‘বালাগাল উলা বি কামালিহি কাশাফাদ্দুজা বি জামালিহি’- এই শেখ সাদীর মাজারের সামনেই তার একটি মর্মর পাথরের ভাস্কর্য আছে।

ইসলামি রাষ্ট্র ইরানে অবস্থিত কবি ওমর খৈয়াম ও মহাকবি ফেরদৌসির ভাস্কর্য নিয়ে কারো সমস্যা নেই। তেহরানে অজস্র মানুষের প্রতিকৃতি সম্বলিত ‘মূর্তি’ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা নেই সিরিয়ার ন্যাশনাল মিউজিয়ামের ‘মূর্তি’ নিয়েও। সব সমস্যা শুধু বাংলাদেশে।

সুপ্রিম কোর্টের সামনে ভাস্কর্য সরানো হলো, এরপরে  আপত্তি তোলা হল দেশের সবগুলো ভাস্কর্য নিয়েই। এরপর কি? শিখা অনির্বাণ, জাতীয় শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ? ঢাবির ‘অপরাজেয় বাংলা’, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) ‘শান্তির পায়রা’, সড়ক দ্বীপের ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’, তারপর?

Leave a Comment

error: Content is protected !!