মধুবালা-দ্যা আল্টিমেট ডিভা অব বলিউড

আফজালুর ফেরদৌস রুমনঃ বলিউড সিনেমার শতবর্ষের ইতিহাসে সেরা সুন্দরীর কথা বললে যার নামটি সবার আগে আসে— তিনি হচ্ছেন মধুবালা। নার্গিস, মীনা কুমারী বা পরবর্তীতে ওয়াহিদা রহমানদের যুগেও যিনি স্বীয় অভিনয় প্রতিভা ও রূপের যাদুতে মাতিয়ে রাখতেন গোটা বোম্বে সিনে-পাড়া।

স্বল্প সময়ের ক্যারিয়ারে যশ ও খ্যাতির চুড়ান্ত শীর্ষে আরোহণ করলেও ব্যক্তিগত জীবনে পিছু ছাড়েনি নিষ্ঠুর নিয়তি। তার জীবন-কাহিনী ট্র্যাজিক সিনেমার গল্পকেও যেনো হার মানায়! আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি বলিউডের এই কিংবদন্তি অভিনেত্রীর জন্মদিন।

ভারতীয় সিনেমার এই কিংবদন্তির বেড়ে ওঠা দিল্লীর এক দরিদ্র ও রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে। অভাব, দারিদ্র্য এবং হতাশার মধ্য বেড়ে উঠেন তিনি। কিন্তু তার অভাবনীয় সৌন্দর্য্য এবং স্বাভাবিক দক্ষ অভিনয় প্রতিভা তাকে এক সময় পুরো ভারতবর্ষের সেরা সুন্দরী অভিনেত্রীর তকমা এনে দেয়। মমতাজ জাহান নাম দিয়ে অভিনয় শুরু করলেও অভিনেত্রী দেবিকা রানী তার নাম দেন মধুবালা।

মধুবালা শিশুশিল্পী হিসেবে বলিউডে অভিনয় শুরু করলেও মূল নারী চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন ১৪ বছর বয়সে কিদার শর্মার ‘নীলকমল’ ছবিতে রাজকাপুরের নায়িকা হয়ে। ১৯৪৮- ১৯৬০ সাল পর্যন্ত স্বল্প সময়ের ক্যারিয়ারে তিনি আরোহণ করেন যশ ও খ্যাতির শীর্ষে। কিন্তু এড়াতে পারেননি নিষ্ঠুর নিয়তিকে। সত্য হয়েছিল সে দরবেশের কথাই যিনি খুব ছোটবেলায় তাঁকে দেখে বলেছিলেন “এ মেয়ে অনেক খ্যাতি লাভ করবে, কিন্তু সুখী হতে পারবে না”। বাস্তব জীবনে তাই ঘটেছিল তার সাথে। খ্যাতি, নাম, যশ, টাকা সবই অর্জন করেছেন তিনি কিন্তু প্রকৃতভাবে সুখী হতে পারেননি তিনি।

মাত্র নয় বছর বয়সে শিশু শিল্পী হিসেবে মধুবালা ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেও প্রথম প্রধান অভিনেত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেন কিদার শর্মার একটি ছবিতে। স্ক্রিন টেস্টের সময় এই পরিচালক নাকি মধুবালার রুপে বিমোহিত হয়ে পড়ছিলেন। ইনিয়ে বিনিয়ে ভালোবাসার কথা বললেও এই নায়িকা কখনো বোঝার চেষ্টা করেনি। এটা ছিলো একপাক্ষিক ভালোবাসা। তবে একজন নবাগতা হয়েও তার ব্যক্তিগত জীবনের এই উৎপাত তিনি কখনোই ক্যামেরায় সামনে আসতে দেননি।

১৯৪৭ সালে ‘নীল কমল’ নামক একটি সিনেমায় শোম্যান খ্যাত রাজ কাপুরের সাথে অভিনয় করেন তিনি। তার সৌন্দর্য্য এবং অভিনয় দক্ষতা নজর কাড়ে সবার। তবে ১৯৪৯ সালে রিলিজ হওয়া মধুবালার ‘মহল’ সিনেমাটি বক্স অফিসে বেশ বড় সাফল্য পায়। বলা যায়, এই সিনেমাটিই ছিলো তার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। এবং এই সিনেমার সাফল্যেই তিনি রাতারাতি তারকা বনে যান।

কমল আমরোহি ও মধুবালার দেখা হয় এই ‘মহল’ সিনেমার সেটেই। তাদের প্রেম ছিল বলে গুঞ্জন থাকলেও এর কোন সত্যতা মেলেনি। এরপর একে একে দুলারি, বেকসুর, তারানা, বাদল, হাওড়া ব্রিজ সহ অসংখ্য সুপারহিট সিনেমা উপহার দিয়ে তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং ওই সময়ে সবচেয়ে বেশী পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেত্রী হিসেবে রাজত্ব করেন হিন্দি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে।

ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে ১৯৫২ সালের আমেরিকান ম্যাগাজিন ‘থিয়েটার আর্টস’ এ তাকে নিয়ে “The Biggest Star in the World – and she’s not in Beverly Hills” শিরোনামে একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়। এছাড়া একাডেমী এ্যাওয়ার্ড বিজয়ী আমেরিকান পরিচালক ফ্রাঙ্ক ক্যাপরা তাকে অভিনয়ও করতে চেয়েছিলেন হলিউডে। কিন্তু তার বাবা রাজি না হওয়ায় সে আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেন তিনি। তবে তার ড্রেস সেন্স, চাহনী, লুক সব মিলিয়ে সেই সময়ের হিসেবে যথেষ্ট আধুনিক এবং শৈল্পিক এক শিল্পী ছিলেন তিনি।

পঞ্চাশের দশকে হিন্দি সিনেমার মহানায়ক দিলীপ কুমার ও মধুবালা জুটির অমর প্রেম কাহিনী আজও লোক মুখে ফেরে। ‘তারানা’ ছবির শুটিং সেটেই মূলত একে অপরের প্রেমে পড়ে তারা। ওই সময়ের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত এই অভিনেত্রী অনেকের সাথে সম্পর্কে জড়ালেও সত্যিকারভাবে মন কিন্তু দিলীপকেই দিয়েছিলেন। এক সময় তারা গাঁটছড়া বাঁধার চুড়ান্ত পরিকল্পনা করলেও বাবা আতাউল্লাহ খানের কারণে শেষ পর্যন্ত আর হয়ে ওঠেনি।

কথিত আছে যে, এমনিতে পেশাগত ও পারিবারিক জটিলতায় আগে থেকেই আতাউল্লাহ খান ও দিলীপ কুমারের মধ্যে একটি বৈরী সম্পর্ক শুরু হয়। এর মধ্যে ‘নয়া দৌড়’ সিনেমা নিয়ে একটা বড় ধরণের লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যায়। দিলীপ কুমারের বিপরীতে এ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য ভূপালে যেতে হবে মধুবালাকে। কিন্তু বাবা আতাউল্লাহ মধুকে ভূপাল যাওয়ার অনুমতি দেননি।

এদিকে প্রযোজক বি আর শর্মা বেশ বিপাকে পড়ায় বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। অভিনেতা হিসেবে আদালতে আতাউল্লাহ খানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন দিলীপ কুমার। বিষয়টি বাবাভক্ত মধুবালাকে ভীষণভাবে আঘাত করে। যাই হোক, সবশেষে দিলীপ কুমার মধুবালাকে বিয়ে করার জন্য দুটি শর্ত দিয়েছিলেন। প্রথমত, তাকে পরিবার ছাড়তে হবে।

দ্বিতীয়ত, অভিনয় ছাড়তে হবে। মধুবালা অভিনয় ছাড়তে রাজী হলেও পরিবার ছাড়ার কথা ভাবতে পারেননি। পাহাড় সমান অভিমান বুকে চেপে সম্পর্ক ভেঙে দেন মধুবালা। দিলীপ কুমার ও মধুবালার সম্পর্কের উত্থান পতনের সাক্ষী ছিল কালজয়ী হিন্দি সিনেমা ‘মুঘল-ই-আজম’। তাদের সম্পর্কের গুঞ্জন যখন ছড়াতে শুরু করেছে, এমন সময় পরিচালক কে আসিফ তাদের কাছে আসেন এ সিনেমা নিয়ে। তিনি চেয়েছিলেন তাদের বাস্তব জীবন মন দেয়া নেয়ার রসায়ন যাতে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠে রূপোলী পর্দায়।

নয় বছর ধরে নির্মিত হওয়া এ সিনেমাটি সাক্ষী হয় আরও বেশী কিছুর। দিলীপ কুমার-মধুবালার বাস্তব জীবনের তুমুল প্রেম, সে প্রেমে ভাঙনের সুর, এরপর বেদনা-বিধুর বিচ্ছেদ জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠে পর্দার সেলিম-আনারকলির চরিত্রে।

এ সিনেমার নির্মাণকালে এমন অনেক সময় গেছে যখন তারা পরস্পরের সাথে কথাও বলতেন না। তবু ক্ষত-বিক্ষত হৃদয় চেপে রেখে সিনেমার কাজটি তারা করেছিলেন নিজেদের সবটুকু দরদ দিয়ে, উপহার দিয়েছেন নিজেদের সেরা অভিনয়। আর এর ফলে সিনেমাটি কেবলমাত্র তাদের ক্যারিয়ার সেরা সিনেমাই নয়, গোটা হিন্দি সিনেমার ইতিহাসেই একটি মাইলফলক হয়ে আছে।

বলা হয়ে থাকে শুধুমাত্র দিলীপ কুমারকে ভুলে থাকতে এবং অনেকটা জেদের বশেই মধুবালা আচমকা বিয়ে করেন গায়ক ও অভিনেতা কিশোর কুমারকে। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। ব্যর্থ প্রেমের যন্ত্রণায় তাদের দাম্পত্য জীবন মোটেও সুখকর ছিলো না।

কিশোর কুমারকে বিয়ে করলেও মধুবালা আশা করতেন একদিন হয়তো দিলীপ কুমার ফিরে আসবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। তবে স্বামী হিসেবে গায়ক এবং অভিনেতা কিশোর কুমার তাকে ভালোবেসে গেছেন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত।

জানা যায়, জন্মগতভাবে মধুবালার হৃৎপিণ্ডে একটি ছিদ্র ছিল। তিনি আগে থেকেই নিজের এ অসুখ সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু কাজ না পাওয়ার ভয়ে তার বাবা এটি প্রকাশ করতে বারণ করেন। পরবর্তীতে এটি বড় আকার ধারণ করে।অসুখের কথা জানার পর মধুবালাকে লন্ডনে নিয়ে যান কিশোর কুমার। চিকিৎসকরা জানান, তিনি সর্বোচ্চ দু-এক বছর বাঁচবেন।

কারণ, ততোদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। যাই হোক, দুঃসহ যন্ত্রণা আর দিলীপ কুমারকে বুকে নিয়ে তিনি আরও নয়টি বছর বেঁচেছিলেন। এরপর ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৩৬ বছর বয়সে অনেকটা দুঃখ, কষ্ট ও ক্ষোভ নিয়ে মহাজগতে পাড়ি জমান রুপালী পর্দার এই অপরুপ সুন্দরী অভিনেত্রী। তবে ক্ষনজন্মা এই অভিনেত্রী আজো অম্লান তার অভিনীত সিনেমা গুলোর মধ্য দিয়ে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!