মুক্তিযুদ্ধে হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধে হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর ভূমিকা। উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুজুর্গ ও আলেমে দীন হযরত মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ. ১৮৯৫ সালে লক্ষীপুর জেলার রায়পুর থানাধীন লুধুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৭ সালের ৭ মে ঢাকায় ইন্তেকাল করেন।

তিনি ছিলেন, বাংলাদেশের আলেম সমাজের অবিসংবাদিত নেতা। শেষ জীবনে তিনি রাজনীতির মাঠে এসে ব্যপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ১৯৮১ ও ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮১ সালের নির্বাচনে ১.৭৯% ভোট পেয়ে তৃতীয় এবং ১৯৮৬ সালে ৫.৬৯% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন।

তিনি সব মত ও পথের রাজনৈতিক নেতাদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন- আসুন, মন থেকে সব ধরনের কলুষতা মুছে তওবা করে দেশ-মাতৃকার উন্নয়নে রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করি।

তওবা প্রসঙ্গে কুরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো, নিশ্চয়ই তোমরা কামিয়াব হবে।’

তিনি দেশবাসীকে কুরআনের এ আয়াত উল্লেখ করে কলুষতা মুক্ত তাওবার রাজনীতির প্রতি আহবান জানান। এজন্য হাফেজ্জী হুজুরকে তওবার রাজনীতির প্রবর্তক বলা হয়।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর ভূমিকা কী ছিল তা নিয়ে এখনো অনেকের মনে রয়ে গেছে নানান জল্পনা-কল্পনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কি প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন নাকি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং রাজাকাদের পক্ষে ছিলেন এ নিয়ে এখনো চলে অজানা বিতর্ক।

ইতিহাস চেপে রেখে তথাকথিত সুশীল সমাজের কিছু ইসলামবিদ্বেষী এখনো দাবি করে থাকেন, হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. পাকিস্তান সমর্থক ছিলেন। ২০০১ সালে হাফেজ্জী হুজুর স্মরণে নগরভবন সংলগ্ন সাবেক ফিনিক্স রোডের নামকরণকরা হয় ‘মওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রোড’ নামে।

সম্প্রতি তথাকথিত এই সুশীল দাবিদারদের গাত্রদাহের কারণে ‘মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর রোডে’র নাম পরিবর্তন করা হয়।

প্রশ্ন হলো সত্যিকারার্থে হাফেজ্জী হুজুর রহ. কোন পক্ষে ছিলেন। দেশের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে? নাকি জুলুমবাজ পাকিস্তানি হানাদারদের পক্ষে।

এ ব্যাপারে হাফেজ্জি হুজুরের বড় ছেলে মাওলানা আহমদুল্লাহ আশরাফকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, বাবা খুব বেশি কথা বলতেন না। সব সময় জিকিরে মগ্ন থাকতেন। এজন্য হয়তো প্রকাশ্যে বক্তব্য বিবৃতি দেননি। কিন্তু সে সময় অনেক মুক্তিযুদ্ধাকেই দেখেছি বাবার কাছে দোয়া নিতে এসেছেন।

আলেম ওলামাদের মধ্য থেকে যারা বাবার কাছে আসতেন বা যুদ্ধের ব্যপারে জানতে চাইতেন তখন তিনি বলতেন, ‘এই যুদ্ধ ইসলামের বিপক্ষে নয়, বরং এটা জালেমের বিরুদ্ধে মাজলুমের সংগ্রাম। পাকিস্তানিরা জালেম তারা আমাদের উপর জুলুম করতেছে অতএব আমরা মাজলুমে তাই আমাদের ‍মাজলুমের পক্ষে থাকতে হবে’।

মাওলানা আহমদুল্লাহ আশরাফ বলেন, আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে সাহায্য সহযোগিতা করেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ইন্ডিয়ান আর্মির ক্যাপের মতো করে ক্যাপ বানিয়ে দোকানে বিক্রি করেছি। কামরাঙ্গীচর মাদরাসায় বাবার সমানে রাজাকারদের প্রতিহত করেছি। মাদরাসায় তারা অস্ত্র রাখতে চেয়েছিলো আমি তা দেইনি।

১৯৬৩ সাল থেকে যুদ্ধচলাকালীন সময়ে আমি ছিলাম বায়তুল মোকাররমের মুয়াজ্জিন। পাশাপাশি মসজিদের পাশে আমার একটি টুপি ও আতরের দোকান ছিলো। মাদরাসায় রাজাকারদের অস্ত্র রাখতে না দেয়ায় পরবর্তীতে তাদের ষড়যন্ত্রে যুদ্ধের ৬মাস আমি বায়তুল মুকাররমে মুয়াজ্জিনের চাকরি করতে পারিনি। মসজিদের পাশে দোকান দেয়ার অযুহাতে আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

আমি যখন দোকান দিতাম তখন একদিন একজন পাকিস্তানি আর্মি জায়নামাজ কেনার জন্য এসেছিলো। কম দামে কিনতে চেয়েছিলো সে। আমি তাকে কমদামে জায়নামাজ না দিয়ে বরং ধমক দিয়ে বলেছি জোর করে নিতে চাইলে এই জায়নামাজে তোদের নামাজ হবে না।

এই কারণে সে আমাকে মুক্তিযোদ্ধা অভিহিত করে গুলি করতে চাইলে অন্যরা বলল, ও তো দোষ করেনি প্রয়োজনে ওকে গ্রেফতার করে নিয়ে নাও।

তারা আমাকে গাড়িতে করে যাত্রাবাড়ী আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেই জায়নামাজ ক্রেতা সেনা ক্যাম্পে নেয়ার পর অফিসারে কাছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলে ও মুক্তিযোদ্ধা ওকে হত্যা করতে হবে। তখন অন্য সৈন্য বলেছিলো ওর কোনো দোষ নেই।

আমি জানতে চেয়েছিলাম আমার অপরাধ কি? আমাকে কেন এখানে আনা হয়েছে? আমি কেন জানতে চাইলাম আমাকে ধরে নেয়ার কথা- এজন্য আমাকে ইচ্ছেমতো মেরে ডোবায় পাঠানোর হুকুম দেয়া হয়। অর্থাৎ ডোবায় নিয়ে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আমাকেও হত্যা করা হবে।

পুনরায় গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি যখন ডোবার উদ্দেশ্যে ছাড়বে ঠিক সেই সময়ে এক সৈন্য আমাকে ডেকে গাড়ি থেকে নামালো এবং দৌড়ে পালাতে বলল। তখন ভেবেছিলাম দৌড় দিলে হয়তো পেছন থেকে গুলি করবে। যাই হোক আল্লাহর উপর ভরসা করে দৌড় দিয়ে সেবারের মতো বাঁচলাম।

এরপর আরেকবার কারফিউ চলাকালীন রাস্তায় বের হওয়ায় লালবাগ থেকে আমাকে ধরে ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠানো হচ্ছিলো। তখন এক মুসলিমলীগ নেতা আমাকে বায়তুল মুকাররমের মুয়াজ্জিন পরিচয় করিয়ে দিয়ে ছাড়িয়ে দেন।

বাবার চোখের সামনেই এতো কিছু হয়েছে।দু’দুবার মৃত্যু মুখ থেকে বেঁচে ফেরা, মুয়াজ্জিনের চাকরিটা চলে যাওয়া সবই তো জানতেন বাবা। কিন্তু এতো কিছুর পরও বড় ছেলে হিসেবে আমাকে কখনোই তিনি এসব করতে নিষেধ করেননি। তিনি কখনোই বলেননি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যেও না। বরং তিনি এক প্রকার মৌন সম্মতিই দিয়েছিলেন।

দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এলে আমাকে এক প্রকার বাসা থেকে ধরে নিয়ে আবার বায়তুল মুকাররমের মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করেন।

এর থেকেই বিষটি স্পষ্ট হয় আমার বাবা উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ. রাজারকার বা রাজাকারদের সমর্থনকারী ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন অপাদমস্তক স্বাধীনতাকামী বীর বাঙালিদের পক্ষে।

(তথসুত্র: শাকের হোসাইন শিবলি রচিত ‘আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে’, উইকিপিডিয়া বাংলা, ইন্টারনেট।)

Leave a Comment

error: Content is protected !!