যুদ্ধের এই ক্ষত চিহ্ন আর দেখতে চান না এলাকাবাসী

“একাত্তরে কংক্রিটের সেতু ডিনামাইটের আঘাতে ভেঙ্গে ফেলে মুক্তিবাহিনী” “যুদ্ধের এই ক্ষত চিহ্ন আর দেখতে চান না এলাকাবাসী” ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্টের দিনে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে পাকবাহিনীর আস্তানায় হামলার পরিকল্পনা মুক্তি বাহিনীর।

পিছন থেকে যেন পাকবাহিনী তাদের উপর আক্রমণ করতে না পারে। সে জন্য ১৩ আগস্ট রাতে তৎকালীন ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুর ইউনিয়নের বলুহা শিবপুর এলাকার একটি কংক্রিটের সেতু ডিনামাইটের আঘাতে ভেঙ্গে ফেলে মুক্তিবাহিনী।

এরপর দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫১ বছর কেটে গেলেও ডিনামাইটের আঘাতে কংক্রিটের ভাঙ্গা ব্রীজের ক্ষত চিহ্ন রয়েই গেছে। সেই ব্রীজের দুই পাশের গাইডওয়াল এখনো দাড়িয়ে আছে। তার উপরে রয়েছে রেললাইনের একটি পাত। সেই পাতের উপর দিয়ে চলাচল করে দুই থেকে তিন গ্রামের মানুষ। এলাকাবাসী এই ক্ষত চিহ্ন আর দেখতে চাননা। এলাকাবাসীর দাবী প্রয়োজনে এই ব্রীজ ভরাট করা হোক অথবা নতুন সেতু করে দেয়া হোক।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রামগোপালপুর ইউনিয়নের বলুহা-শিবপুর এলাকার ওই রাস্তাটি এলজিইডির আওতাধীন। রাস্তার আইডি নম্বর ৩৬১২৩৩০২১। রাস্তার দৈর্ঘ্য ১৫৪৫ মিটার ও প্রস্থ ২ দশমিক ৯ মিটার। তবে, রাস্তাটি কত সালে এলজিইডির আওতায় এসেছে তা জানাতে পারেননি এলজিইডির কর্মকর্তারা।

সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, ১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ সড়ক গৌরীপুর উপজেলা রামগোপালপুর ইউনিয়নের বলুহা ও শিবপুর গ্রামের ওপর দিয়ে গিয়েছিল। তখন ওই রাস্তাটি প্রশস্ত ছিল ৪০ ফুট। বর্তমানে ওই রাস্তা কোথাও ১০ ফুট, কোথাও ৫ ফুট আবার কোথায় দখল করে ঘরও তৈরি করা হয়েছে। তৎকালীন সময় ওই রাস্তা ইটের সলিং করা ছিল। তখন ওই রাস্তা দিয়ে বাস-ট্রাক ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ চলাচল করতো।

১৯৬৯ বা ৭০ সালের দিকে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়ক সরলীকরণ করার জন্য ওই পুরাতন সড়কের দেড় কিলোমিটার রাস্তা বাদ দিয়ে রামগোপালপুর বাসষ্ট্যান্ড থেকে শিবপুর বাসষ্ট্যান্ড পর্যন্ত নতুন রাস্তা করার প্রস্তুতি নেয়। পরে দেশে যুদ্ধ শুরু হলে নতুন সড়কের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তবে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পুনরায় ওই রাস্তার কাজ শুরু হয়।

পরে পুরাতন ওই রাস্তাটি চলাচলের জন্য বাতিল করে নতুন রাস্তা চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এরপর থেকেই পুরাতন ওই রাস্তাটি বন্ধ হওয়ায় কেউ কোন খোঁজ খবর নেয়নি। যে কারণে ওই সড়কের সেতুটি বলুহা ও শিবপুর সহ কয়েক টি গ্রামের মানুষের গলার কাটায় পরিনত হয়েছে। বর্তমানে ওই পুরাতন রাস্তা দিয়ে বলুহা ও শিবপুর গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ চলাচল করে।

স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক বলেন, ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট আমরা ঈশ্বরগঞ্জে পাকবাহিনীর আস্তানায় হামলার পরিকল্পনা করি। তবে, পেছন থেকে যেন পাকবাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ করতে না পরে সে জন্য ১৩ আগস্ট রাতে বলুহা ও শিবপুর গ্রামের ওই ব্রিজ ও আরও দুটি রেলব্রিজ ডিনামাইট দিয়ে ভেঙে ফেলি। পরদিন ১৪ আগস্ট আমরা ২৮ জন মুক্তিযোদ্ধা ঈশ্বরগঞ্জের পাকবাহিনীর আস্তানায় হামলা করি। এতে আমাদের টিম লিডার শহীদ হন।

তিনি আরও বলেন, বলুহা শিবপুর গ্রামের ওই সেতুটি জন্য কয়েকটি গ্রামের মানুষ চরম ভোগান্তিতে আছেন। এছাড়াও ওই এলাকার প্রায় কয়েকশত শিক্ষার্থী স্কুল কলেজ মাদ্রাসায় আসা যাওয়া করতে খুব কষ্ট হয়। যদি ওই সেতুটি নির্মাণ করা হয়। তাহলে হয়তো ওই গ্রামের মানুষ নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারবে।

বলুহা গ্রামের আব্দুস সালাম বলেন, লাঙলপুরে জমিদার আমলে বড় একটা বাজার ছিল। ওই বাজারে স্কুল আছে, কলেজও তৈরি হচ্ছে। এখন এই ব্রিজ ভাঙা থাকার কারণে ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে যেতে পারে না। কারণ, ওই ব্রিজের ওপর একটি রেল লাইনের পাত আছে। যেটি দিয়ে শিক্ষার্থীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। আব্দুস সালাম আরও বলেন, গত দুই-তিন বছর ধরে শুনছি, এই ব্রীজ নাকি ঠিক করা হবে কিন্তু হচ্ছে না। আমাদের দাবি, দ্রুত এই ব্রিজ নির্মাণ করে যেন চলাচলের উপযোগী করা হয়।

শিবপুর গ্রামের ফজলুল হক বলেন, রামগোপালপুর বাজারে প্রাইমারী স্কুল ও হাইস্কুল আছে। এই রাস্তা দিয়ে ওই দুই স্কুলে পায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী চলাফেরা করে। তাই এই ব্রীজটা আমাদের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু, এই রাস্তার বিকল্প রাস্তা তো সরকার তৈরী করেছে।

সেখান দিয়ে চলাফেরা করেন না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওইটা তো একটা মহাসড়ক। যে কারণে শিক্ষার্থীরা ভয়ে চলাফেরা করে না। যে কারণে এই রাস্তাটা জরুরী মেরামত করার দাবি করেন তিনি।

এ বিষয়ে এলজিইডি’র অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. কামরুল আহসান বলেন, উপজেলা শহরের এত কাছে এতদিন যাবত একটি সেতু এভাবে পড়ে আছে জানা ছিল না। তবে, স্থানীয় প্রশাসনের অনেক আগেই আমাদের জানানোর প্রয়োজন ছিল। এবার যেহেতু বিষয়টি আপনারা নজরে এনেছেন। যত দ্রুত সম্ভব একটা সেতু করার চেষ্টা করব।

Leave a Comment

error: Content is protected !!