যে গল্প বদলে দিতে পারে জীবন-সাইফুল ইসলাম তালুকদার

জগৎখ্যাত রুশ কথা সাহিত্যিক লিও টলস্টয়ের লেখা একটি ছোট গল্প “দ্য থ্রী কোশ্চেনস” আশির দশকে নবম-দশম শ্রেণীতে অধ্যায়ন কালে পড়েছিলাম। দীর্ঘসময়ের পরিক্রমায় প্রশ্ন ও উত্তর গুলো প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। মানুষের জীবনে বই পড়ার গুরুত্ব বিষয়ে কিছু লেখার তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে পেয়ে গেলাম সেই বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক এর জীবন বদলানোর মতো মজার ছোট গল্পটি। বিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক টলস্টয়ের গল্পটির মর্ম উপলব্ধি করতে পারলে বদলে যেতে পারে আমাদের জীবন। তাই শিক্ষনীয় ছোট গল্পটি আমাদের বর্তমান প্রজন্মের জন্য একটি শিক্ষনীয় উপাচার। এখন সেই শিক্ষনীয় গল্পটি উপস্থাপন করছি।

একদিন এক রাজা ভাবলেন, আচ্ছা যদি আমি জানতাম, কোন কাজ শুরু করার সঠিক সময় কখন? যদি জানতাম, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটা কে? আর সর্বোপরি কোন কাজটা করা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন? তাহলে আমার রাজ্য পরিচালনার কাজে এবং ব্যক্তি জীবনে কোন ভুল হতো না। তিনি তাঁর রাজ্যজুড়ে ঘোষণা দিয়ে দিলেন যে, যে তাঁর এই প্রশ্ন তিনটির উত্তর দিতে পারবে তাকে তিনি পুরস্কৃত করবেন। রাজ্যের সকল জ্ঞানী পন্ডিত এসে উপস্থিত হলেন। কিন্তু তাদের সবার কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর পাওয়া গেল।

প্রথম প্রশ্নের জবাবে তারা কেউ কেউ বললো, সঠিক কাজ সঠিক সময়ে করার জন্য আগে থেকেই দিন-তারিখের চক করে কার্যসূচি লিখে রাখতে হবে এবং তা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। কেউ আবার বলল, প্রতিটা কাজের সঠিক সময় আগে থেকে জানা কখনোই সম্ভব নয়। যা করতে হবে তা হল অলস অবসর না কাটিয়ে সময়ের সাথে এগিয়ে যাওয়া। আর যখন যেটি করা প্রয়োজন সেটি করতে হবে। আবার কেউ পরামর্শ দিলো, চোখ-কান যতই খোলা রাখা হোক না কেন, তবু একার পক্ষে সবসময় কাজের সঠিক সময় নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তাই জ্ঞানী লোকদের পরামর্শ নিতে হবে। কেউ আবার প্রতিবাদ করে বললেন, জীবনে কিছু কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মাত্র কয়েক মুহুর্ত সময় বরাদ্দ থাকে। সে ক্ষেত্রে জ্ঞানী লোকের পরামর্শ নেওয়ার মতো যথেষ্ট সময় হাতে থাকে না। সুতরাং সব কাজের সঠিক সময় জানতে জ্যোতিষীদের পরামর্শ চাইতে হবে। একইভাবে দ্বিতীয় প্রশ্নের জন্য ও ভিন্ন ভিন্ন মতামত আসল। কেউ বলল রাজার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার পরামর্শদাতারা। কেউ বলল যাজক, কেউ ডাক্তার, আবার কেউবা বলল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ তাঁর সৈন্যদল। তৃতীয় প্রশ্নের জন্য উত্তর আসলো, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বিজ্ঞান শিক্ষা, কেউ বলল যুদ্ধ বিদ্যাশিক্ষা, আবার কেউ বলল ধর্মীয় আরাধনা করা।

রাজা সকলের উত্তরের বৈচিত্র্যের কারণে কারো সাথেই একমত হতে পারলেন না এবং কাউকে পুরস্কৃতও করলেন না। তবুও তার প্রশ্নগুলোর উত্তর মিলবে সেই আশায় এক সন্ন্যাসীর নিকট যেতে মনস্থির করলেন। যার জ্ঞান ও বুদ্ধির সুনাম রয়েছে রাজ্যজুড়ে। সেই সন্ন্যাসী বহুদিন যাবৎ বনে বাস করত এবং খুব সাধারণ মানুষ ব্যতীত কেউ সেখানে যেত না। তাই রাজা সাদাসিধে বেশ নিয়ে গেলেন সন্ন্যাসীর কাছে। তাঁর ঘরের অনেক দূরেই ঘোড়া থেকে নামলেন এবং তাঁর দেহরক্ষীদের তার সাথে আসতে মানা করলেন। রাজা কাছে গিয়ে দেখলেন সন্ন্যাসী তাঁর কুড়ে ঘরের সামনে মাটি খনন করছে। রাজাকে দেখে সে সালাম দিয়ে আবার মাটি খনন করতে লাগল। তাকে খুব ক্লান্ত লাগছিল।

প্রতিবার মাটিতে কোদাল দিয়ে আঘাত করার সময় সে ভারি নিঃশ্বাস ফেলছিল। রাজা বললেন, ‘হে জ্ঞানী সন্ন্যাসী! আমি তোমার কাছে এসেছি আমার তিনটি প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে। বলতে পারো, কোন কাজের সঠিক সময় কোনটি? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি কে? এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি কি? তা কিভাবে জানবো? সন্ন্যাসী তার কথাগুলোর কিন্তু কিছুই বললো না। সে মাটি খনন কাজ চালিয়ে গেল। রাজা বললেন, তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। তোমার কোদাল দাও, আমি কিছুক্ষণ কাজ করি। সন্ন্যাসী তাকে ধন্যবাদ জানালো, এবং কোদালটি তাঁর হাতে দিয়ে সে মাটিতে বসে পড়ল। বেশ কিছুক্ষণ কাজ করার পর রাজা থামলেন, এবং তার প্রশ্নগুলো আবার করলেন। কিন্তু এবারও সন্ন্যাসী কিছুই বললেন না। সে কোদাল চেয়ে নিয়ে বলল আপনি এবার বিশ্রাম নেন। আর আমাকে কাজ করতে দিন। কিন্তু রাজা তাকে কোদাল না দিয়ে কাজ করতেই লাগলেন। ঘন্টার পর ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেলো। গাছের আড়ালে অস্তায়মান সূর্য উঁকি দিচ্ছিল। অবশেষে রাজা থামলেন এবং বললেন, “হে জ্ঞানী সন্ন্যাসী! আমি তোমার কাছে এসেছিলাম উত্তরের জন্য। তুমি যদি প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে না পারো তাহলে বল আমি বাড়ি ফিরে যাই।

সন্ন্যাসী বলল “কে যেন আসছে!” দেখা যাক সে কে! রাজা ঘুরে তাকিয়ে দেখলেন একজন দাড়িওয়ালা লোক তার রক্তাক্ত পেটে দু’হাত চেপে দৌড়ে আসছে। লোকটি তাদের কাছে এসেই মাটিতে আছড়ে পড়ল। রাজা ও সন্ন্যাসী তার গায়ের পোশাক খুলে দেওয়ার পর তার পেটে এক প্রকান্ড ক্ষত আবিষ্কার করলেন। রাজা যতটা সম্ভব ভালো করে জায়গাটা পরিষ্কার করে তার নিজের রুমাল ও সন্ন্যাসীর তোয়ালে দিয়ে বেঁধে দিলেন। তাকে পানি পান করালেন। সন্ন্যাসী মুখ ঘুরিয়ে বললেন, উত্তর গুলো তো আপনি পেয়েই গেছেন। সন্ধ্যা হয়ে এলে লোকটিকে নিয়ে রাজা ঘরে গেলেন। লোকটি কোন কথা বললো না। রাজা ক্লান্তি বোধ করলেন এবং অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়লেন। সকালে উঠে রাজা নিজে কোথায় তা আবিষ্কার করতে খানিকটা বেগ পেতে হল। তিনি দেখলেন এক দাড়িওয়ালা অচেনা লোক তার দিকে তাকিয়ে আছে।

লোকটি ক্ষীণকন্ঠে বললো, “আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিন”। রাজা অবাক হয়ে জবাব দিলেন, আমি আপনাকে চিনি না। আপনাকে ক্ষমা করার মত কিছু ঘটেওনি। লোকটি বললেন, “আপনি আমাকে না চিনলেও আমি আপনাকে চিনি”। আমি হচ্ছি আপনার সেই শত্রু, যে আপনার উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। কারণ আপনি আমার ভাইকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন এবং তার সম্পত্তি জব্দ করেছিলেন। আমি জানতাম, আপনি সন্ন্যাসীর সাথে একা দেখা করতে এসেছেন, তাই আপনাকে ফেরার পথে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু গতকাল আপনি আর ফিরলেন না। আপনাকে খুঁজতে আড়াল থেকে বের হলাম এবং আপনার দেহরক্ষীদের কবলে পরলাম। তারা আমাকে চিনতে পেরে আমাকে আক্রমন করল। আপনি আমার ক্ষত বেঁধে আমাকে বাঁচালেন। আপনি যদি চান আমি বাকি জীবন আপনার বিশ্বস্থ দাস হতে পারি। আমি আবারও ক্ষমাপ্রার্থী। শত্রুর সাথে এত সহজে মিটমাট হওয়াতে রাজা খুব আনন্দিত হলেন।

তিনি কেবল তাকে ক্ষমাই করলেন না বরং তার সমুদয় সম্পত্তি ফিরিয়ে দিলেন এবং তাকে নিজের দাস ও চিকিৎসকদের অংশীদারি করে দিলেন। ঘর থেকে বেরিয়ে রাজা আরেকবার প্রশ্নগুলোর উত্তর চেয়ে সন্ন্যাসীর খোঁজ করলেন। সন্ন্যাসী ঘরের বাইরেই হাটুগেড়ে বীজ বপন করছিলেন। রাজা বললেন, “আমি শেষবারের মতো তোমার কাছে আমার প্রশ্ন গুলোর উত্তর প্রার্থনা করছি”।

সন্ন্যাসী মুখ ঘুরিয়ে বলল, উত্তরগুলো তো আপনি ইতিমধ্যে পেয়েই গেছেন। রাজা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন উত্তর গুলো পেয়েছি? কিভাবে? সন্ন্যাসী বর্ণনা করলো লক্ষ্য করুন আপনি যদি কাল আমাকে মাটি খননে সাহায্য না করে প্রাসাদে ফিরে যেতেন তাহলে ওই লোক আপনাকে হত্যা করতো। সুতরাং তখন আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল যখন আপনি মাটি খনন করেছিলেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলাম আমি। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল আমাকে মাটি খননের সাহায্য করা। যেহেতু তা আপনার জীবন বাঁচিয়েছে।

একটু থেমে সন্ন্যাসী আবার বলল, আবার আপনি যখন লোকটির ক্ষত বেঁধে দিচ্ছিলেন তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল সেটা, আর ব্যক্তি ওই লোক। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল আমাকে সাহায্য করা যেহেতু তা না হলে সে বাঁচতো না, আর আপনাদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠাও হতোনা। সন্ন্যাসী আবারও একটু বিরতি নিয়ে বলল সুতরাং মনে রাখবেন আপনার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হলো বর্তমান মুহূর্তটি কারণ শুধুমাত্র এর উপরই আপনার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলো যে মানুষটার সাথে আপনি এই মুহূর্তে এখন আছেন, কারণ আপনি কখনই জানেন না সেই মানুষটাই আপনার জীবনের শেষ মুহূর্তের সাক্ষী হতে যাচ্ছে কিনা। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো তার জন্য ভালো কিছু করা কেননা এই উদ্দেশ্যেই আমরা এই পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছি।

সাইফুল ইসলাম তালুকদার
শিক্ষক ও সাংবাদিক

Leave a Comment

error: Content is protected !!