রবিউল আউয়ালের করণীয়-বর্জনীয়

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) রবিউল আউয়াল মাসে জন্মগ্রহণ করে পৃথিবী আলোকিত করেন। আবার এ মাসেই মহান রবের সান্নিধ্যে চলে যান। তিনি উম্মাহর জন্য এক অনন্য আদর্শ রেখে যান। সেই আদর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা উম্মাহ সব সময় চালিয়ে যাবে এটিই উম্মাহর জীবনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

মহানবী (সা.)-এর জন্ম

মহানবী (সা.) সোমবার সুবহে সাদিকের সময় পবিত্র মক্কায় আবু তালিবের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। সোমবার জন্মদিন হওয়ার বিষয়টি হাদিসে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সোমবারের রোজা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘সেদিন আমি জন্মেছি এবং সেদিন আমার প্রতি অহি অবতীর্ণ হয়েছে।’ (মুসলিম, হাদিস: ২৮০৭)

বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী, নবী (সা.) রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ও জুবাইর ইবনে মুতইম (রা.) থেকে এমনই বর্ণিত আছে। তবে প্রসিদ্ধ মত হলো, নবী (সা.)-এর জন্মতারিখ ১২ রবিউল আওয়াল। (সিরাতুল মুস্তফা: ১ / ৫১)

হিজরি সন প্রবর্তনের আগ পর্যন্ত আরবে ঐতিহাসিক কোনো ঘটনাকে স্মারক করে সময়ের হিসাব করা হতো। এমনই এক ঐতিহাসিক ঘটনা হলো হাতি বাহিনীর ঘটনা। আবিসিনিয়ার বাদশা নাজ্জাশি কর্তৃক নিযুক্ত ইয়েমেনের গভর্নর আবরাহা কাবাঘর ধ্বংস করার জন্য হাতি বাহিনী নিয়ে মক্কায় অভিযান পরিচালনা করেছিল। মহান আল্লাহ নগণ্য পাখির মাধ্যমে সেই বাহিনীকে ধুলায় মিশিয়ে দেন। কোরআন মজিদে এ বিষয়ে একটি বিশেষ সুরা (সুরা ফিল) অবতীর্ণ হয়েছে। হাতি বাহিনীর ঐতিহাসিক এ ঘটনার বছরই (আমুল ফিল) মহানবী (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। সেটি ছিল ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাস।

ইসলামে জন্মদিন উদ্‌যাপন

নবী (সা.)-এর জন্মের দিন তাঁর আত্মীয়স্বজনসহ সব সৃষ্টিই আনন্দিত হয়েছিল। আবু লাহাবকে তাঁর দাসী সুয়াইবিয়া এসে ভাতিজা হওয়ার সুসংবাদ দিলে আবু লাহাব আনন্দিত হয়ে সুয়াইবিয়াকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। একজন শিশুর জন্মে আপনজনেরা আনন্দিত হবেন—এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু নবী (সা.) নিজে বা কোনো সাহাবায়ে কেরাম নবী (সা.)-এর জন্মদিনকে জন্মবার্ষিকী হিসেবে উদ্‌যাপন করেননি। বিষয়টি গুরুত্বহীন হওয়ার কারণেই তাঁর জন্ম তারিখ অকাট্যভাবে সংরক্ষিত হয়নি। জন্ম সম্পূর্ণ মহান আল্লাহর দান। তাই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ নবী (সা.) সোমবারে রোজা রাখতেন। কারণ সোমবার তাঁর জন্ম ও নবুয়তপ্রাপ্তির দিন।

মহানবী (সা.)-এর মৃত্যু

নবী (সা.) ১১ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসের সোমবারে ইন্তেকাল করেন। দিনটি প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী ১২ রবিউল আউয়াল হলেও আরও দুটি মত রয়েছে। ১ রবিউল আউয়াল এবং ২ রবিউল আউয়াল। বুখারির ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারিতে ২ রবিউল আউয়াল হওয়ার মতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। (সিরাতুল মুস্তফা: ৩ / ১৭২)

তাঁর মৃত্যুতে সাহাবিদের শোক

নবী (সা.)-এর ইন্তেকালের দিন সাহাবাদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। তাঁরা দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। ওমর (রা.) খোলা তরবারি নিয়ে মসজিদে নববির সামনে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, ‘যে বলবে—আল্লাহর নবী ইন্তেকাল করেছেন, আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেব।’ অর্থাৎ তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে নবী (সা.) ইন্তেকাল করেছেন। আবু বকর সিদ্দিক (রা.) অসীম ধৈর্য অবলম্বন করে অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে সবাইকে কোরআনের একটি আয়াত স্মরণ করিয়ে দিলেন।

আল্লাহ বলেন, ‘মুহাম্মদ একজন রাসুল মাত্র; তার পূর্বে বহু রাসুল গত হয়েছে। সুতরাং যদি সে মারা যায় অথবা সে নিহত হয়, তবে তোমরা কি পেছনে ফিরে যাবে? এবং কেউ পেছনে ফিরে গেলে সে কখনো আল্লাহর ক্ষতি করতে পারবে না; বরং আল্লাহ শিগগিরই কৃতজ্ঞদের পুরস্কৃত করবেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৪৪)

আয়াত জানা থাকলেও সেই কষ্টকর মুহূর্তে সবাই দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। আয়াত শোনার পর সবাই ক্রমান্বয়ে শান্ত হন। পরবর্তীকালে সাহাবায়ে কেরাম, তাদের পর তাবেয়িন বা তাবে তাবেয়িন কেউই নবী (সা.)-এর মৃত্যুবার্ষিকী বা ওফাত দিবস নামে কোনো অনুষ্ঠান বা শোক পালন করেননি।

আমাদের করণীয়

জন্ম-মৃত্যু সব মানুষের থাকবেই। নবী-রাসুলগণও এর বাইরে নন। স্বল্প সময়ের এই পৃথিবীতে আসার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য চিহ্নিত করে তা পূর্ণ করার চেষ্টা অব্যাহত রাখাই হলো মানুষের কাজ। নবী (সা.)-এর পৃথিবীতে আগমনের উদ্দেশ্য হলো আদর্শের বাস্তবায়ন। আর উম্মাহর কাজ হলো তাঁর অনুসরণ। নবী (সা.) তাঁর কথা, কাজ, সম্মতি এবং জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের মাধ্যমে সেই আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই করে গেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘এবং সে (রাসুল) মনগড়া কথাও বলে না। এ তো (কোরআন) অহি, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়।’ (সুরা নাজম, আয়াত: ৩-৪)

আত্মীয়, প্রতিবেশী এবং নবী (সা.)-এর জন্মে আনন্দিত হয়েও আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে আবু তালিব ও আবু লাহাব জাহান্নামি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কোরআনে আবু লাহাব ও তার স্ত্রীর অভিশপ্ত হওয়ার ঘোষণাসংবলিত ‘সুরা লাহাব’ অবতীর্ণ হয়েছে। আবার জায়েদ বিন হারেসা (রা.)-এর মতো একজন ক্রীতদাস নবী (সা.)-এর আদর্শ গ্রহণ করার ফলে মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে কোরআন মজিদে তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। (সুরা আহযাব, আয়াত: ৩৭)

কাজেই উম্মাহর করণীয় হলো—নবী (সা.)-এর আদর্শের অনুসারী হিসেবে নিজেদের যোগ্য করে তোলা। তাহলেই সফল মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করা যাবে, ইনশাআল্লাহ।

লেখক: ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা
সহযোগী অধ্যাপক: আরবি বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Comment

error: Content is protected !!